জবাকুসুম প্রোডাক্টস

লেখক - অরুণ চট্টোপাধ্যায়

চিত্রা চিত্রার্পিতের মত স্থির ভাবে দেখছিল অক্ষয়কে। যে মানুষটা মহালয়ার দিনে তর্পণ পর্যন্ত করে না তার এ কী পরিণতি?

পুকুর এখন এই শহরে একটা প্রাগৈতিহাসিক জলাশয়ের উদাহরণ। কিন্তু তবু অক্ষয়ের বাড়ির পেছনের এই পাঁচ কাঠা জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পুকুরটা দিব্বি এখনও দাঁড়িয়ে আছে নিজের জলের গভীরতায়। প্রোমোটারের আগ্রাসী থাবা তাকে এখনও পর্যন্ত বিব্রত করতে পারে নি সে কেবলই তার নিজের দৌলতে।

নামহীন শরিকদের ঘন জঙ্গল তিনদিক দিয়ে ঘেরা এই পুকুর আপাতত ঢোকার অগম্য। ফ্ল্যাট হলে তার বোর্ডারদের ঢোকার আর বেরোনর সন্ধান পাওয়া যায় নি বলে এটা সুরক্ষিত। তবে কেউ ব্যবহার করে না। ঘরে ঘরে এখন খাওয়ার জন্যে আর-ও ফিল্টার আর বাড়তি কাজের জন্যে রয়েছে মিউনিসিপ্যালিটির অঢেল জলের সাপ্লাই তখন পুকুরে নামার দরকারই বা কী?

কিন্তু তবু অক্ষয় আজ নেমেছে। আর হাঁটু পর্যন্ত পাজামাটা গুটিয়ে তুলে হাতের অঞ্জলিতে জল ভরে যেন মন্ত্র পড়ছেঃ ‘ওঁজবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্‌

                                       ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহ্‌স্মি দিবাকরম্।।

এই গুরুগম্ভীর পরিবেশে তো কিছুই বলা যাচ্ছে না। পুকুরের জলে সূর্যের প্রতিবিম্বটা ঢেউয়ের আঘাতে ভগ্ন আর দোদুল্যমান। বিস্ময়ে বিভোর হয়ে তেমনি দাঁড়িয়ে রইল চিত্রা। বারকয়েক মন্ত্র পড়ে পেছন ফিরল অক্ষয়। তাকাল বৌয়ের মুখের দিকে। বৌয়ের মুখে কোনও হিব্রু ভাষা লেখা নেই যে সে বুঝবে না। সলজ্জ হেসে বলল, এমনি। হঠাৎ ইচ্ছে হল সকালের নিউ বর্ন সানকে একটু সেলিব্রেট করি।

ভেবেছিল চিত্রা হেসে উঠবে তার পাগলামিতে। কিন্তু হল উল্টো। চিত্রা চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করল, এই যে একটু আগে বিশুদ্ধ সংস্কৃতে চমৎকার শ্লোক আবৃত্তি করছিলে তার পরেই এই বিদেশী ভাষায় কথাগুলো বলতে তোমার ইচ্ছে করছে?

-কী করি বল? তুমি তো জানো আমার সংস্কৃত বিদ্যার দৌড় ক্লাস এইট পর্যন্ত। কিন্তু ভাগ্য ভালো মানে বুঝি বা না বুঝি উচ্চারণ তো করতে পারছি।

চিত্রার মেজাজ এবার একটু নরম হল। হেসে বলল, তা পারছ। বেশ ভালোই পারছ। কিন্তু কিন্তু কেন করছ এই কষ্ট তা বুঝতে পারছি না।

পুকুর থেকে উঠে আসতে আসতে অক্ষয় বলল, কষ্টের কথা কী বলছ। সূর্য আমাদের জন্যে কী কষ্ট করছে তা যদি জানতে। সে যদি শক্তি না দিত তো সারা জগত যে অক্ষম থাকত।

তার পাশে পাশে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে চিত্রা বলল, সে আবার কষ্ট কী করবে? এটা তো তার কাজ। নৈমিত্তিক কাজ। আর শক্তি আছে, অফুরন্ত শক্তি তাই ছড়াচ্ছে।

-হ্যাঁ অফুরন্ত বটে। প্রতিদিন অর্থাৎ চব্বিশ ঘন্টায় এই তাপের পরিমাণ প্রায় ১০,৩২০ কুইন্টিলিয়ন জুল বা ১০,৩২০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ জুল। এক বছরে সূর্য থেকে পৃথিবীতে পৌঁছন শক্তির পরিমাণ ৩৭,৬৬,৮০০ কিন্টিলিয়ন জুল বা ৩৭,৬৬,৮০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ জুল।

প্রবল ভাবে কান চেপে ধরে চিত্রা বলল, আঃ একটু আস্তে চেঁচাও। আমি হিস্ট্রির ছাত্রী ভুলে গেলে বুঝি?

হো হো করে হেসে উঠল অক্ষয়, হিস্ট্রির ছাত্রীই বল আর কেমিস্ট্রি্র। সূর্যের থেকে পাওয়া এই দৈনন্দিন শক্তি ছাড়া কোনও কোর্সই তার গতি পেত না খেয়াল রাখবে। সে যা হোক আমার মনে হয় কুইন্টিলিয়ান শব্দটা তোমাকে বেশ ঝামেলায় ফেলেছে এই তো? আসলে ও কিছু নয়। যেকোনো সংখ্যার ডানদিকে যদি তুমি আঠারটা শূন্য বসিয়ে দাও তবেই পাবে এই সংখ্যা। তাই এক কুইন্টিলিয়ন ক্যালোরি মানে হল একের পিঠে আঠারটা শূন্য বসিয়ে যে সংখ্যা হয় তত ক্যালোরি। এটা আমেরিকান পদ্ধতি অনুসারে। আর বৃটিশরা আঠারোর বদলে তিরিশটা শূন্য বসায়।

বাড়ি গিয়ে অফিস যাওয়ার জন্যে তৈরি হল অক্ষয়। সে চলেও গেল। কিন্তু টিফিনে বাক্স খুলে সে তো অবাক। আজ আবার আরও একটা বাড়তি বাক্স দিয়েছে চিত্রা। কৌতূহলী হল এই নতুন বাক্সটা কীসের জন্যে। খুলেই তো হাঁ। গুণে গুণে আঠারোটা সন্দেশ দিয়েছে।

খুব রাগ হল। ডায়াবেয়াটিস নাহয় তার নাই হয়েছে তাই বলে হবে না তার কোনো মানে আছে। খাওয়া ফেলে মোবাইলে রিং।

--হ্যালো চিত্রা তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?

চিত্রা বলল, কেন গো? মাথায় আমার গোবর আছে শুনেছি বারবার। কিন্তু খারাপ এটা কেউ বলেনি।

-আমাকে একেবারে ভাঁড়ার খালি করে সন্দেশ দিয়েছ?

-তাই নাকি? ক’টা শুনি?

অক্ষয় রেগে উঠে বলল, আঠারো খানা-

-রাগ কর না সোনা। বাবা অনেক সন্দেশ এনেছিল। তাই তোমাকে দিতে দিতে ওই কুইন্টিলইয়ান নাকি যেন-

ধাঁধার সমাধান হয়ে গেল। ইতিহাসের ছাত্রীর এ এক ঐতিহাসিক ভুল। না না আজ বাড়ি গিয়ে জবা কুসুম রহস্যের ব্যাপারটা খোলসা করতেই হবে চিত্রার কাছে। নাহলে পরের দিন যদি বৃটিশ পদ্ধতি মেনে তিরিশটা রসগোল্লা দেয় তো- ওরে বাবা।  

সব মিষ্টি ফেরত এনেছিল অক্ষয়। চিত্রা বলল, সকাল থেকে আমার মাথাটা বেজায় ব্যথা।

-মাথা ব্যথা তোমার হল কেন? সেটা তো আমার হওয়ার কথা।

চিত্রা চুপ করে ছিল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন কোনও গোলকধাঁধায় পড়ে গেছে। অক্ষয় হেসে বলল, মাথা তোমার বেজায় ঘুরছে দেখছি চিত্রা। সব না বোঝালে-

চিত্রা চট করে বলে উঠল, দাঁড়াও তোপসে মাছের ফ্রাইয়ের সব কিছু ফ্রিজে করা আছে। শুধু গরম গরম ভেজে দিলেই হবে। আমি এক্ষুনি করে এনে দিচ্ছি।

তোপসের ফ্রাই চিবুতে চিবুতে অক্ষয় বলতে লাগল, আসলে তোমাকে আমি ধাঁধায় ফেলতে চাই নি ডার্লিং। এই জগৎ নিজেই একটা মস্ত ধাঁধা। তুমি তো জান সূর্য আমাদের সব শক্তির আধার। মানে আলো আর তাপ। এগুলো ভিন্ন নয়। তাপ যেখানে আলো সেখানে।

-ঠিক ঠিক। রান্না করতে করতে লোড শেডিং হলেও দেখেছি বার্নারের থেকে দিব্বি আলো বেরোচ্ছে।

-সূর্য হল বিরাট এক তাপের উৎস। এই সৌর জগতের সব গ্রহ উপগ্রহের সব কিছু চলছে তার ছড়ানো শক্তির কৃপায়। আর তুমি জানো শক্তি ছাড়া তো কিছুই করা যায় না। একটা গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ে না।

চিত্রা কিছু বুঝতে না পেরে বলল, এই যা সব মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সূর্য তো রাতের বেলা থাকেই না বাবা। তখন আমাদের দেখাশোনা কে করে শুনি? হ্যাঁ স্বীকার করি সূর্যটা বেশ গরম কিন্তু সে যে সব শক্তির আধার তা মানতে পারি না।

সেদিন রাত হয়ে গিয়েছিল। টিভিতে একটা চমৎকার লাভ স্টোরি দেখতে দেখতে দুজনে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন রবিবার মানে সারাদিন ছুটি। আজ ব্রেকফাস্টের জন্যে একটু তাড়া দিয়েছে অক্ষয়। চিত্রা ভাবছে এই সাতসকালে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ছক কষেছে নাকি তার প্রিয় জীবনভর বন্ধু? অক্ষয়ের ঠোঁটে একটা হালকা হাসি আবার সেই সঙ্গে তার আঙুল দুইই যুগপৎ ছোঁয়ানো। মানে ধীরে বন্ধু ধীরে।

বেলা দশটা না বাজতেই হাতে একটা মাঝারি মাপের আতস কাঁচ নিয়ে বাড়ির বাগানে চলে এল অক্ষয়। পেছন পেছন যেতে যেতে মুচকি হেসে চিত্রা বলল, ঘাসের ভেতর ছোট ছোট পোকা মাকড় দেখবে বুঝি?

-দেখ না কী দেখি।

বাগানে দুজনে বসল। এখানে রোদের অভাব নেই। মাটিতে একটা কাগজের টুকরো রেখে তার ওপর আতস কাঁচ এমন ভাবে মেলে ধরল অক্ষয় যাতে সমস্ত রোদ কেন্দ্রীভূত হয়ে কাগজের এক জায়গায় পড়ে।

মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল কাগজটা। বৌয়ের দিকে ইঙ্গিতবাহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অক্ষয়। চিত্রা ঘাড় নেড়ে বলল, বুঝলুম তোমার জবাকুসুমের কান্ডকারখানা। সত্যি বড় শক্তিমান সে। কিন্তু এই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করা ছাড়া আর সে কী করতে পারে শুনি?

-মাঝে বুধবার একটা ছুটি আছে।

অক্ষয়ের কথায় লাফিয়ে উঠল চিত্রা, কোথায় বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম করছ গো? কাছাকাছি নাকি লং ট্যুর?

-অপারেশন ফোটো ইলেক্ট্রিসিটি।

বুধবার বাগানে বসে বলল অক্ষয়। তার হাতে একটা কাঁচে ঢাকা এক অদ্ভুত যন্ত্র।

ভ্রূ কুঁচকে চিত্রা বলল, এটা আবার কী? ভাবলুম বাইক নিয়ে লং ট্যুরে বেরোবে।

-লং টুরেই যাচ্ছি। হেসে বলল অক্ষয়, জবাকুসুমের কাজ বোঝানোর চেষ্টা। বেশ কয়েকদিন লেগে যাবে।

-বিজ্ঞান! কোনওমতে অজ্ঞান হওয়াটা আটকে আঁতকে উঠে চিত্রা বলল, ওরে বাবা আমার তো ইতিহাসের মাথা।

-তবে তো ভালই। বিজ্ঞানের ইতিহাস বুঝতে বেশ সুবিধে হবে। আর সব বোঝা হয়ে গেলে মানে এই বিপুল বোঝা তোমার মাথায় নেওয়ার পর মাথা হাল্কা করার জন্যে কথা দিচ্ছি-

চিত্রা লাফিয়ে উঠল, লং ট্যুর-

-দু চোখ যেদিকে যায়। মানে বাইকের দু’চাকা যেদিকে গড়ায় আর কী। উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণ।

-বেশ বেশ। খুশিতে উপচে পড়ে চিত্রা বলল, এগুলো কী গো?

-দেখতেই পাচ্ছ এই কাঁচের টিউবের মধ্যে দুটি ধাতুর পাত আছে। একটা বেশ বড় আর চওড়া। এই চওড়া আর অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁকানো পাতে মাখিয়ে দেওয়া হয় কিছু পদার্থ যেগুলি আলোকে উত্তেজিত করে আর তার দিকে টেনে নিয়ে শোষিত হতে বাধ্য করে। এগুলোকে বলে ফোটোসেনসিটিভ পদার্থ। কী বুঝলে?

-আরে না বোঝার কী আছে। এ তো আলোকের মতই সোজা সরল।

অক্ষয় হাসল, ঠিক তাই। এইবার ভেবে দেখ তোমার গায়ে কেউ ধাক্কা মারলে তুমি কী করবে?

-কী আবার করব? ধাক্কাটা সহ্য করে নেব। অথবা ছিটকে যাব। অথবা চেঁচিয়ে গাল পাড়ব।

কথাটা বলে হো হো করে হেসে নিল খুব একচোট।

-একদম ঠিক। তার মানে তোমার মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে তাই তো?

-বটেই তো।

-আলো তো একটা শক্তি স্বীকার করবে? সেদিন দেখেছিলে আতস কাঁচের মধ্যে দিয়ে রোদ গলে গিয়ে কেমন কাগজটা দাউ দাউ করে জ্বলে গেল?

-ঠিক।

-তাই যেই আলো এই বাঁকানো পাতের ওপর পড়ল অমনি সে একটা শক্তি প্রয়োগ করবে এই ধাতুটার ওপর। তুমি তো জানোই বস্তুর ভেতরে মূল উপাদান কণা হিসেবে ইলেক্ট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন আছে? এদের মধ্যে নিউট্রন আর প্রোটন বড়ই আঁটসাঁট। আর থাকে একেবারে পরমাণুর কেন্দ্রে। এদের নড়ানো যায় না। এমন কী নড়াতে গেলে এরা পরমাণুতেই ধরিয়ে দেবে চিড়। কিন্তু ইলেক্ট্রন খুব আলগা ভাবে লেগে থাকে বলে সে ছিটকে বেরিয়ে যায়।

-এ আর না বোঝা যাবে কেন?

-ঠিক। ইলেক্ট্রন কিন্তু নেগেটিভ মানে যার থেকে চলে যাবে সে হয়ে যাবে পজিটিভ আর যার দিকে চলে যাবে সে হবে নেগেটিভ। তার মানে-

চিত্রা খুব উৎসাহিত আর উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, আরে কী মজা কী মজা। আলো পড়লেই তবে একদিক পজিটিভ আর একদিক নেগেটিভ হয়ে যাবে? তার মানে বিদ্যুৎ-

-ঠিক ধরেছে ডিয়ার। বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে। মানে কারেন্ট বইবে।

বিস্ময়ে হাঁ হয়ে ভাবতে ভাবতে চিত্রা বলতে লাগল, সামান্য নিরীহ আলো যে কিনা শুধুই পথ দেখায় সে বিদ্যুৎ তৈরি করবে? ঝট করে ঝটকা মারবে?

-হ্যাঁ গো ডিয়ার হ্যাঁ। আর আলো যদি বাধা পায় তো কী হবে জান?

-বিদ্যুৎ হবে না আর কী।

-ঠিক। কিন্তু আমাদের মস্ত কিছু কাজ হবে।

চিত্রা কিছু ভাবতে ভাবতে বলল, তোমরা এই বিজ্ঞানের লোকেরা কিছুই ছাড় না। না জিনিসের মধ্যেও ‘হ্যাঁ’’-এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে ফেল দিব্বি। অন্ধকারে আলো এনে দাও। যুক্তির খোঁচায় ভূতের কংকাল দিয়ে ভবিষ্যতের খাঁচা বানিয়ে ফেল।

হা হা করে তৃপ্তির হাসি হেসে অক্ষয় বলল, একেবারে তাই ডার্লিং। আলো নেই তাই কারেন্ট নেই। কিন্তু আছে এক উজ্জ্বল আর সফল ভবিষ্যৎ।

-কী রকমটা শুনি?

-এই যেমন ধর তুমি দরজার সামনে এসে হাজির। দরজায় একটা ফোটোইলেক্ট্রিক কানেকশন করা আছে। তুমি যেই এলে-

-অমনি আলো আসায় বাধা এল এই তো? আর অমনি কারেন্ট তৈরি বন্ধ হয়ে গেল।

-এতক্ষণ তো ইলেক্ট্রোম্যাগনেট দিয়ে দরজা বন্ধ করা ছিল। ইলেক্ট্রোম্যাগনেট কিন্তু তড়িৎ যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ কাজ করে। তাই তুমি যেই এলে অমনি ম্যাগনেট ফাঁকি মারল।

-মানে দরজা খুলে গেল? ওয়ান্ডার ফুল! মানে একেবারে ফুল ওয়ান্ডার! আবার যেই আমি ঢুকে গেলুম অমনি তড়িৎ প্রবাহ পূর্ববৎ মানে ম্যাগনেট আবার সক্রিয় মানে দরজা আবার বন্ধ। সত্যি ভূতের এই কান্ড অন্ধকার অতীত থেকে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল আলোয় আমাদের এনে দিয়েছে। অবিশ্বাস্য। নিরীহ আলো আমাদের কেমন ভাবে  মজার আলোয় এনে ফেলল।

-শুধু তাই নয়।

-বুঝেছি কাউন্টিং মেশিন এই বলতে চাইছ তো?

পাক্কা দুমিনিট একটাও কথা বলতে পারল না অক্ষয়। তার ইতিহাসের বৌ কিনা বিজ্ঞানের এই বিষয় এত চট করে মাথায় গলিয়ে ফেলল? এ যে এক ইতিহাস হয়ে থাকবে।

বলল, মিরাকুলাস। আমি ভাবতে পারি নি চিত্রা।

-থাক আর তোল্লাই দিতে হবে না। যে বোঝে তার ক্রেডিট বেশি না যে বোঝায় তার শুনি? তুমি কেমন জাঁদরেল মাস্টার সেটা তো দেখতে হবে নাকি? এবার বুঝেছি ভিড়ের ভেতর লোক কেমন করে গোনা হয় আর ওই যে কনভেয়ার বেল্টে কোনও বস্তা চট করে গুণে নেওয়াও যায় কি বল?

-বটেই তো। শুধু একটা আলো রাখতে হবে এই পথে। বস্তা যাবার সময় আলোয় বাধা পড়বে আর কারেন্ট বন্ধ। এমন করে কতবার কারেন্ট বন্ধ সেটা-

-গুণে নিলেই-

-আরে না না গোনার কাজটা যন্ত্রেই করে। শুধু তাই নয়-

-আরে এ তো খুব সহজ। চোর আসার কী আগুন লাগার ঘন্টি এই সব সবও ডিয়ার আমি আর থাকতে পারছি না। সামান্য নিরীহ সাদা আলোর পেটে পেটে এত কিছু!

অক্ষয় এবার অস্থির হয়ে বলল, পেটে পেটে আরও অনেক কিছু ডার্লিং। কিন্তু আমার পেটে এখন যে কিছুই নেই। একটা অন্তত ডিমটোস্ট বানিয়ে দিয়ে তুমি লাঞ্চ রান্নাতে মন দাও। আবার পরে্র দিন নাহয় আমার পেট থেকে কথা বার কর। তবে হ্যাঁ একটু বলি শোন। এই যে গল্প শুনলে এটা কিন্তু ফোটোইলেক্ট্রিক সেলের কাহিনী। যার পেটে অনেক কিছু থাকলেও দরকার শুধু কয়েক গোছা আলোর রেখার। আর কয়েকটা প্লেট যার মধ্যে ফোটোসেনসিটিভ পদার্থ। আর তেমন কিছু নয়। তার মানে খায় কম কিন্তু কাজ করে বেশি। আমারই মত।

-তাই নাকি? তুমি কম খাও বুঝি? তবে আজ ডিমটোস্ট বন্ধ থাক। মুড়ি চানাচুরই বরং-

-মরে যাব চিত্রা। আমার মা বলত মুড়ি শুধু বুড়িরাই খায়। ও তুমি বরং খেয়ে নিয়ো। আর শোন এটা একটা জবাকুসুম প্রোডাক্টের গল্প শুনলে। তেমনি অনেক গল্প বাকি আছে। সে নাহয় আর একদিন-

-হ্যাঁ বলতে তো হবেই। আজ চিকেন বিরিয়ানি আর মাটন রোস্ট করব ভেবেছিলুম। বলার প্রমিস না করলে শেষে তো ভাত আর শুক্তোতেই আটকে থাকতে হবে। শেষপাতে বড়জোর দুটো বেগুন ভাজা থাকবে।

-প্রমিস প্রমিস প্রমিস। তিন প্রমিস চিত্রা। লাফিয়ে বলে ফেলল অক্ষয়।

আবার বাগানে এসেছে দুজন। বাগান সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। অক্ষয় আবার তার সেই মন্ত্র ‘জবাকুসুম শঙ্কাশং—’ উচ্চারণ করল। চিত্রার এসব মন্ত্রতন্ত্রে বিশ্বাস নেই। তবু সে ভাবে বিশ্বাস থেকেই তো উপলব্ধির জন্ম হয় আর উপলব্ধি জন্ম দেয় বিজ্ঞানের। বিজ্ঞান আকাশ থেকে পড়ে না। সে জন্মায় মানুষের মনে আর মগজে। মনের কল্পনা মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত করে। চিন্তা পরিণত হয় গভীর চিন্তায় আর গভীর চিন্তা পরিণত হয় স্থির চিন্তায়। চিন্তা থেকেই বাস্তবায়নের প্রস্তুতি আর তা থেকে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ আর সিদ্ধান্ত। একটি বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা তখনই হবে যখন নানা পরীক্ষা কিন্তু পর্যবেক্ষণ হবে অভিন্ন।

সেদিনে অক্ষয়ের দেখানো আর শোনানো ঘটনাগুলো চিত্রাকে অনেক বিশ্বাস দিয়েছে। আমাদের এই পৃথিবীর মাটি থেকে ছোট্ট হয়ে দেখতে পাওয়া সূর্যটার যে এত বিশাল শক্তি তা আগে বোঝা তো দূরের কথা হয়ত খেয়ালই করে নি।

--আগের দিনে তুমি-

-আলোকতড়িতের কথা বলেছি। সামান্য আলো থেকে কীভাবে শক্তিশালী বিদ্যুৎ তৈরি হয় তার কথা আর আজ বলব-

বাধা দিয়ে চিত্রা বলল, আচ্ছা খুব জোরাল আলো তবে বেশি বিদ্যুৎ তৈরি করবে কি বল?

----একটা বেশি শক্তি তো আরো বেশি শক্তিই তৈরি করবে। কথায় বলে না যত চিনি দেবে তত মিষ্টি হবে?

খিল খিল করে হেসে চিত্রা বলল, শুধু তাই নয় গো। গোরুর দুধের থেকেও ভাল পায়েস হবে যদি কনডেন্সড মিল্ক নাও। আর যদি তাতে থাকে কাজু, কিসমিস আর পেস্তা।

-রাইট রাইট। অ্যাবসলিউটলি রাইট। ঠিক ধরেছ। অর্থাৎ উপাদান একটা মস্ত বড় জিনিস। যেমন ধর সাধারণ আলোর বদলে যদি নাও সূর্যের আলো তো আরও শক্ত পোক্ত বিদ্যুৎ তৈরি হবে কারণ সূর্যের আলোতে রয়েছে ফোটন আর অতিবেগুনী রশ্মি। তুমি তো জানো চিত্রা এ জগতে শক্তির রূপবদল হয়।

-বহুরূপী বলছ? হ্যাঁ নিচু ক্লাসে পড়েছিলুম বটে।

-প্রকৃতি তার বিভিন্ন শক্তির রূপবদল ঘটায় তার নিজের স্বার্থে। অর্থাৎ যখন যেমনটি দরকার তেমনটি। যেকোনও কোষ বা ব্যাটারির ক্ষেত্রে রাসায়নিক শক্তি বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তারপর সেই বিদ্যুৎ শক্তিকে আমরা যখন যেমন দরকার তেমন ব্যবহার করি। যেমন ধর-

বাধা দিয়ে চিত্রা বলল, এই যেমন রেডিও বা টেপ রেকর্ডারে বিদ্যুৎ তৈরি হয় শব্দতে আর টিভিতে শব্দ আর আলো দুইই একসঙ্গে এই তো?

-থ্যাংকস। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনেও সৌরশক্তিকে একটি কোষে আবদ্ধ করা হয় আর সেখানে তাকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। এক্ষেত্রে তাই ফোটোইলেক্ট্রিক কোষের সঙ্গে সৌরশক্তি কোষের একটা পার্থক্য রয়েছে। ফোটোইলেক্ট্রিক কোষে উৎপন্ন বিদ্যুৎ কোনও  ব্যাটারিতে সংরক্ষিত রাখা হয় না। সরাসরি ব্যবহার করা হয়। সেটা বলার আগে সূর্যরশ্মি থেকে কীভাবে তড়িৎ উৎপন্ন করা হয় সেটা বলতে হবে। আর সেটা বলার আগে বলতে হবে সৌরকোষ আসলে কী।

চিত্রা বলল, বুঝে গেছি মহাশয়।

-কী বুঝেছ?

-সৌরকোষ আর আলোক-তড়িত কোষের ফারাকটা। আলোকতড়িৎ কোষের ব্যবস্থাটা তাৎক্ষণিক। তাই তাতে উৎপন্ন বিদ্যুৎ সংরক্ষিত থাকে না বা তার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সৌরকোষে উৎপন্ন বিদ্যুৎ সংরক্ষিত করা দরকার হয়ে পড়ে প্রয়োজনের স্বার্থে আর তাই-

-ও গ্রেট। একেবারে ঠিক ঠিক।

-তবে আর একবার লং ড্রাইভ?

-হয়ে যাবে। আগে তো সৌর কোষের লং ড্রাইভটা শেষ হোক ডিয়ার।

-বেশ বেশ। শুনতে বেশ ভাল লাগছে।

-সৌরকোষের কথা বলতে গেলে আগে বলতে হয় অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টরের কথা।

-কন্ডাক্টর! ওমা সে তো ট্রান্সপোর্ট বাসে থাকে।

অক্ষয় হাসল, হ্যাঁ ঠিক বলেছ। বাসের মধ্যে দিয়ে যাত্রী পরিবহন হয় আর সে সেই কাজ পরিচালনা করে তাই তার এমন নাম। তবে আমি যে পরিবহনের কথা বলছি-

চিত্রা বাধা দিল, তড়িৎ পরিবহন এই তো?

-গুড গার্ল। তা শোন পরিবাহক তিন রকমের হয়। এক, যে পুরোপরি তড়িৎ পরিবহন করবে। দুই, যে একেবারেই করবে না যাকে বলে অপরিবাহী বা নন কন্ডাক্টর বা ইনসুলেটর। আর-

চিত্রা আবার বাধা দিল, সেই মাঝের জন হলেন সেমি কনডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী এই তো?

অক্ষয় বলল, হ্যাঁ ঠিক তাই। যেকোনো ধাতু হল পরিবাহী। আর গ্রাফাইট ছাড়া অন্য সব অধাতু আর অন্য বস্তু সব হল অপরিবাহী। গ্রাফাইটের বিশেষ একটা আকারের জন্যে সে কিন্তু অধাতু হয়েও তড়িৎ পরিবহন করতে পারে। কিন্তু কিছু পদার্থ আছে যাদের মধ্যে দিয়ে কিছু কিছু তড়িৎ পরিবাহিত হয় যেমন সিলিকন, জার্মেনিয়াম, ক্যাডমিয়াম সালফাইড এইসব।

-আচ্ছা তোমরা মানে বিজ্ঞানীরা এটা কী করে বোঝ গো?

-ভাল প্রশ্ন করেছ। এটা করা হয় একটা অংকের হিসেব করে। ধরতে পার একটা অংকের তুলনা যাকে বলে আপেক্ষিক রোধ বা রোধাংক। এই সংখ্যাটি বলে দেবে এর মধ্যে দিয়ে তড়িৎ যাবে কিনা। যেটি অপরিবাহী বা অন্তরক অর্থাৎ যেটা ঢাকা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে কোনও পরিবাহীর যাতে মানুষের শরীরে বিদ্যুৎ আসতে পারে না, যেমন কাঠ, কাঁচ, রবার, প্লাস্টিক ফাইবার, পিভিসি এইসব জিনিসের পরিবাহিতাংক হল প্রতি মিটারে 1016  ওহম বা একের পিঠে ষোলটা শূন্য বসিয়ে যত হয়। তড়িতের সুপরিবাহী তামার পরিবাহিতাংক হল 10-8 ওহম বা একের দশ কোটি ভাগের এক ভাগ ওহম। তাহলে -

-সেমিকন্ডাক্টরের রোধাংক নিশ্চয় এর মধ্যে থাকবে?

-ঠিক ধরেছ। তবে এটা এটা একটা সীমার মধ্যে থাকবে আর এই সীমা হল 10-5 থেকে 108 এর মধ্যে। এটা কিন্তু সব স্বাভাবিক তাপমাত্রার হিসেব। তাপমাত্রা বাড়ালে কিন্তু সুপরিবাহীর পরিবাহিতা কমে কিন্তু অর্ধপরিবাহির ক্ষেত্রে পরিবাহিতা বেড়ে যায়।

-একটা কথা মাথায় ঢুকল না ডার্লিং-

-কোন কথাটা চিত্রা?

-এই যে ধর তামা। লোহা এলুমিনিয়াম আর সব ধাতুর মধ্যে দিয়ে দিব্বি সুড় সুড় করে কারেন্ট চলে যায় এটা কেন হয়?

অক্ষয় হেসে বলল, ধাতুগুলোর গঠনের জন্যে। ইলেক্ট্রোপজিটিভ ধাতুগুলো পিরিয়ডিক টেবিলের প্রথম দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে থাকে। তার মানে এদের শেষ কক্ষে একটি, দুটি বা তিনটি ইলেক্ট্রন থাকে। আলো, উত্তাপ বা অন্য কোনও উত্তেজনা জনিত শক্তি এদের ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে। এই বেরিয়ে আসাটা আরও সুগম হয় ভারি ধাতুগুলোর মানে যারা এই টেবিলের নিচের দিকে থাকে। তাদের পরমাণুতে ইলেক্ট্রনের সংখ্যা বেশি হওয়ার ফলে কক্ষের সংখ্যা বেশি হয় আর শেষ কক্ষের ইলেক্ট্রনগুলির প্রতি নিউক্লিয়াসের অত বেশি ভালবাসা বা টান থাকে না। অধাতুদের ক্ষেত্রে এই মুক্ত ইলেক্ট্রন পাওয়া যায় না তাই তড়িৎ তাদের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় না। এখন অর্ধপরিবাহীগুলির আভ্যন্তরীণ গঠন কিন্তু এমন যাতে সহজে ইলেক্ট্রন ছুটে বেরিয়ে যাবে এমন না হলেও একেবারে বেরোবে না তাও কিন্তু নয়। এই ছবিটা দেখ তাহলে সহজে বুঝতে পারবে।

-আচ্ছা অক্ষয়, আমি তোমার একটা কথা ঠিক বুঝতে পারছি না গো। অর্ধপরিবাহীর দোষ কোথায়? সে কেন এমন বিদকুটে হল।

-দোষ তার গঠনে। এদের কোনও মুক্ত ইলেক্ট্রন থাকে না যে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে তারা তড়িৎ আধান তৈরি করবে।

-কিন্তু এই অর্ধপরিবাহী চরিত্রটি কেন এল সৌরকোষে তা বলতে পার? একে স্টেজে নামালে কেন হঠাৎ?তড়িৎ পরিবহনে পরিবাহীই তো লাগে আমি জানি।

-ভাল প্রশ্ন। একে নামান হল কারণ সৌরকোষেসিলিকনের ভূমিকাই নায়কের মত। অর্থাৎ সৌরকোষের আসল কাজ যে তড়িৎ পরিবহন সেটা সে-ই করে থাকে।

-উঁহু। ঘাড় নাড়ল চিত্রা জোরে জোরে, সেলফ কন্ট্রাডিক্টরি স্যার সেলফ কন্ট্রাডিক্টরি। আপনি বলেছেন সিলিকন অর্ধপরিবাহী। তার মানে তার মধ্যে কোনও মুক্ত ইলেকট্রন নেই। তবে আবার সেটা তড়িৎ পরিবহন করবে কী করে বলতে পারেন স্যার?

হাসল অক্ষয়, সত্যিই তুমি গ্রেট ম্যাডাম। আসলে আমি বলেছি বিশুদ্ধ সিলিকন অর্ধপরিবাহী। কিন্তু প্রতি দশ লক্ষ সিলিকনের মধ্যে যদি একটি ফসফরাসের অণু মিশিয়ে দেওয়া হয় তবে যে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে সেটা বলব। সিলিকন পরমাণুর শেষ কক্ষের চারটি ইলেক্ট্রন থাকার ফলে অনেকগুলো সিলিকন একসঙ্গে আটটি করে ইলেক্ট্রন নিয়ে একটি বৃহৎ সংগঠন তৈর করে। এবং সমযোজী গঠনের জন্যে আর মুক্ত ইলেক্ট্রনের অভাবে তড়িৎ পরিবহনে অক্ষম। এবার ধরা যাক একটি ফসফরাস পরমাণু যুক্ত করলে কী হবে। ফসফরাসের পাঁচটি ইলেক্ট্রনের মধ্যে চারটি ইলেকট্রন সিলিকনের চারটি ইলেক্ট্রনের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলেও একটি বাড়তি থেকে যায় আর সূর্যের আলো এই টাইপের সিলিকনের ওপর পড়লে সেটি উত্তেজিত হয়ে লাফিয়ে পড়তে চায়। এই বাড়তি ইলেক্ট্রনটির জন্যেই তড়িৎ প্রবাহিত হয়। এটাকে N-type সিলিকন বলে। অর্থাৎ এন টাইপ সিলিকিন প্রকৃতপক্ষে কোষের নেগেটিভ প্রান্ত।

আবার ফসফোরাসের বদলে যদি বোরন মেশান হয় তো কী ঘটবে? বোরনের যোজ্যতা কক্ষে থাকে তিনটি ইলেক্ট্রিন। আর একটি ইলেকট্রন থাকলে ইলেক্ট্রন গতিপ্রাপ্ত হত না। তাই এক্ষেত্রে একটি ইলেকট্রন হোল তৈরি হবে। যেহেতু ইলেকট্রন কম তাই এটি পজিটিভ অঞ্চল হবে আর এটিকে বলা হয় P-Type সিলিকন। এইভাবে ফসফোরাস বা বোরন মিশ্রিত করণকে ডোপিং বলে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ডোপিং না করলে কী হবে? ডোপিং করলে পরিষ্কার দুটো প্রান্ত পাওয়া যাচ্ছে একদিকে ইলেকট্রন বেশি আর একদিকে কম। কমের অর্থ সেখানে ইলেকট্রন ধরার জায়গা আছে। যে জায়গাটিকে হোল (hole) বলা হচ্ছে। তাই ডোপিং না করে বিশুদ্ধ সিলিকন নিলে এই ঘটনাগুলি ঘটবে না অর্থাৎ সৌরকোষ তৈরি হবে না।

সূর্যের আলো একটা শক্তি আর তার ফলে সূর্যের আলো (শক্তি) যদি N-Type-এ পড়ে তবে ইলেকট্রন লাফিয়ে পড়ার একটা জায়গা খুঁজবে আর এই জায়গা হল P-Type-এর সেই ইলেকট্রন হোল। কিন্তু এই দুই টাইপের সিলিকনের পাশাপাশি অবস্থান না হলে একই টাইপের সিলিকন হলে সূর্যের আলোয় ইলেকট্রন হয়ত লাফাবে কিন্তু সেই ইলেকট্রন ধরার মত হোল থাকবে না। এই ছবিটা দেখ তাহলে বুঝতে পারবে। 

এখন এই দুই টাইপের সিলিকন যদি পাশাপাশি রেখে সংযুক্ত করা হয় তবেN-Type-এর দিক থেকে P-Type=এর দিকে ইলেকট্রন প্রবাহিত হবে মানেP-Type থেকে N-Type-এর দিকে তড়িৎ প্রবাহিত হবে। কারণ ইলেকট্রন প্রবাহের বিপরীত দিক হল তড়িৎ প্রবাহের দিক।

এবার আরও একটা কথা বলি। কেন সোলারে অর্ধপরিবাহী ব্যবহার করা হয়। একটু বুঝিয়ে বলি। ধর তুমি একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবে। তোমার ক্লাবে কিছু বাচ্চা আছে। তিন রকমের বাচ্চা। এক সাংস্কৃতিক সৃজনে দক্ষ কিন্তু ভয়ানক দুষ্টু আর চঞ্চল, এরা এত বেশি ছটফট করে যে এদের নিয়ন্ত্রণ করে সুষ্ঠুভাবে কিছু করা যায় না। দ্বিতীয় আর একধরণের বাচ্চা আছে যারা বেশ শান্ত আর ধীর-স্থির আর সংস্কৃতি সৃজন ভাল পারে। তৃতীয় আর একদল আছে যারা শান্ত আরা একেবারেই শান্ত। এরা সংস্কৃতি সৃজনের কিছুই বোঝে না। তবে হয়ত ভালবাসে বা চাপে পড়লে চুপ করে বসে দেখতে পারে। তুমি কাকে কোন ভার দেবে।

চিত্রা বলল, এ তো খুব সোজা। যারা খুব ছটফটে কিন্তু সংস্কৃতি বোঝে তাদের স্টেজে উঠতে না দিয়ে স্টেজের পেছনে ব্যবস্থাপনায় রাখব। যারা সংস্কৃতি বোঝে আর শান্ত ধীর স্থির তাদের স্টেজে বসাব আর একেবারে ভালাভোলাগুলোকে দিয়ে দর্শকের আসন ভরাব।

-ঠিক একেবারে ঠিক। সোৎসাহে বলে উঠল অক্ষয়, যারা পরিবাহী তাদের মধ্যে প্রচুর ফ্রি ইলেকট্রন থাকার ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা শক্ত। অপরিবাহীর তো এক্ষেত্রে কোনও কাজ নেই কারণ তাদের কোনও ফ্রি ইলেকট্রন নেই। পড়ে রইল এই অর্ধপরিবাহী যার মধ্যেও ফ্রি ইলেক্ট্রন নেই তবে ডোপিং করলে তার মধ্যে দিয়ে নিয়ন্ত্রিত ভাবে সূর্যালোক থেকে তড়িৎ তৈরি করা যাবে। তাই অর্ধপরিবাহী আর সেই হিসেবে আদর্শ সিলিকনকে বাছা হয়।

-বুঝলুম।

-এবার তবে বলি সৌরপ্যানেলের কথা। এই ভাবে একটা N-Type আর একটা P-Type সিলিকন পাশাপাশি সাজিয়ে তৈরি হয় এক একটি সৌরকোষ বা সোলার সেল। কিন্তু একটি সেলের উৎপাদন খুবই কম। কারণ এটি হল এই সজ্জার নিম্নতম রূপ। তাই এমন বেশ কিছু কোষ সারিবদ্ধ করে একটি বড় সজ্জা পাওয়া যায় তাকে বলে মডিউল। আর এই রকম বেশ কিছু মডিউল এক একটি ফ্রেমে যখন সাজিয়ে রাখা হয়। এই এক একটি ফ্রেমকে বলা হয় এক একটি সৌরপ্যানেল। বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী বৃহৎ থেকে বৃহত্তর প্যানেল সাজানো যেতে পারে। তবে প্যানেল হল নিম্নতম।

-সৌরকোষ তবে সবচেয়ে ছোট?

-হ্যাঁ এখন এই সোলার প্যানেল থেকে যে বিদ্যুৎ তৈরি হয় তা একটি ব্যাটারিতে সংরক্ষিত করা হয়। কিন্তু এটি অবশ্যই ডি-সি বিদ্যুৎ। যেমন সাধারণ ব্যাটারিগুলোতে হয়। কিন্তু আমরা আমাদের লাইনে যে বিদ্যুৎ পাই তা হল এ-সি। তাই এই ডি-সি বিদ্যুৎকে এ-সি তে পরিবর্তন করা দরকার হয়ে পড়ে। এই কাজ করার জন্যে ব্যবহার করা হয় ডি-সি এ-সি ইনভার্টার। এই যন্ত্রটি আবার ডি-সি বিদ্যুৎকে এ-সি বিদ্যুতে পরিণত করে।

বাড়ির কাজ অনুযায়ী তিন রকমের সৌরপদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। এক, অন-গ্রিড। দুই, অফ-গ্রিড আর তিন, হাইব্রিড সোলার সিস্টেম।

অনগ্রিড সোলার সিস্টেমে প্যানেল থেকে আসা বিদ্যুৎ আর ব্যাটারিতে সংরক্ষিত করা হয় না। সরাসরি ইনভার্টারের মাধ্যমে লাইনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এটি বাড়ির বিদ্যুৎ বিল কিছু কমাতে সাহায্য করে।

অফ গ্রিড সিস্টেমে প্যানেলের বিদ্যুৎ একটি ব্যাটারিতে সংরক্ষিত করা হয় আর পরে বাড়ির বিদ্যুৎ বন্ধ হলে এটিকে ইনভার্টারের মধ্যে দিয়ে লাইনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর সুবিধে হল লোড শেডিং হলে এই বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।

হাইব্রিড সোলার সিস্টেম (Hybrid Solar System)এটি সবচেয়ে কার্যকরি এই জন্যে যে এটিতে অব-গ্রিড আর অফ-গ্রিড দুই ব্যবস্থাই থাকে। হাইব্রিড সোলার সিস্টেম অন গ্রিড সোলারসিস্টেম এবং অফ গ্রিড সোলার সিস্টেম উভয় হিসাবে কাজ করতে সক্ষম। যেটিতেতুমি সোলার প্যানেল থেকে আসা ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার করে তোমার হোমঅ্যাপ্লায়েন্স চালাতে পারবেন এবং ব্যাটারি চার্জ করতে পারবে এবং যদি বেশিবিদ্যুৎ আসে তাহলে তা ফেরত পাঠিয়েও তোমার বিদ্যুৎ বিল কমাতে পারবে।এই সোলার সিস্টেমে, যখন তোমার ব্যাটারিসম্পূর্ণ চার্জ হয়ে যায়, তখন সোলার সিস্টেম থেকে আসা বিদ্যুৎ ঘরে থাকাউপকরণগুলিকে চালানো শুরু করে, যার ফলে তোমার মেইন বিদ্যুতের ব্যবহার অনেককমে যায়।

-দেখ ইতিহাসের ছাত্রী আমি। ইতিহাস না জানলে পেট ভরে না।

অক্ষয় হাসল। বলল, নিজেকে অত উপেক্ষিত ভেব না ডিয়ার। জেনে রেখ ইতিহাসই কিন্তু আমাদের জীবনের সব। কারণ ইতিহাস আমাদের বিগত কার্যধারার একটা নথি। এই নথি বলে দেয় আমরা এ পর্যন্ত কী করেছি আর এখন কী করতে হবে। ইতিহাসের শিক্ষা নিয়েই তবে ভবিষ্যতে এগোতে হয়। আমাদের জ্ঞানের সব শাখাগুলোতেই কিন্তু তাই ইতিহাস থাকে।

প্রশংসায় খুব খুশি চিত্রা। অক্ষয় আবার বলল, দেখ বিজ্ঞানের কোনও আবিষ্কারই একদিনে হয় নি। এক্ষেত্রেও লেগে গেছে প্রায় ষাট সত্তর বছর। সোলার কোষের জনক হিসেবে নাম করতে হয় এডমন্ড বেকারেলের। তাঁর বাবাও বিজ্ঞানী ছিলেন। মাত্র ঊনিশ বছর বয়েসে বাবার গবেষণাগারে সর্বপ্রথম ফোটোভোল্টেইক কোষ নির্মাণ করে সবাইকে চমকে দেন। এই চমক আর কিছুর জন্যে নয়। এই চমক এই জন্যে যে সামান্য রোদের তাপ থেকে তৈরি হচ্ছে তড়িৎ। অথচ রোদে মানুষের শরীর গরম হওয়া ছাড়া বিদ্যুতের কোনও অনুভবই হয় না। ১৮৭৩ সালে উইলোফবি স্মিথ আবিষ্কার করেন অর্ধপরিবাহী হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে সেলেনিয়ামের ওপর সূর্যালোক পড়ে তা বিদ্যুতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর দশ বছর পরে সেলেনিয়ামের ওপর পাতলা সোনার পাত ঢেলে আলোকতড়িত কোষ উৎপাদন করতে চেষ্টা করেন চার্লিস ফ্রিটিস। যদিও খুবই সামান্য সাফল্য এসেছিল এই ব্যাপারে। এইভাবে চলতে চলতে ১৯০৫ সালে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের মঞ্চে আবির্ভূত হলেন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। আলোকের কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। এই তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্যে ১৯২১ সালে তিনি নোবেল প্রাইজ লাভ করেন।

অবশেষে ১৯৫৪ সালে প্রথম সফল ভাবে বেল ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে প্রদর্শিত হল ক্যালভিন সাউদার ফুলার, ড্যারিল চ্যাপিন আর জেরাল্ড পিয়ারসনের মাধ্যমে। এরপর আর দাঁড়াতে হয় নি ধীরে ধীরে উন্নতি হয়েই চলেছে আর বর্তমানে তুমি চাইলেই হাতের নাগালে এমনি অবস্থা।

চিত্রা বলল, অনেক কিছু জানতে পারলুম। আর জানলুম আজকের দিনে এই সৌরশক্তিই আমাদের পরম পরিবেশ বান্ধব শক্তি। তুমি তবে ঠিক করেছিলে এই জবাকুসুম আমাদের সকলের কাছেই প্রণম্য।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb