মড়াকাটা ডাক্তার ও কবরখানার কুকুর

লেখক - সুপ্রিয় লাহিড়ী

 

1535 সালের অক্টোবর মাস, মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে বহুক্ষণ। কৃষ্ণপক্ষের রাতে নিকষ কালো অন্ধকার। প্যারিসের কুখ্যাত লেটেম্পল জেলের পেছনে কয়েদীদের কবরখানায় কোন প্রহরী নেই। কে যাবে ওখানে পাহারা দিতে?  অতৃপ্ত আত্মা, পিশাচ আর ডাইনদের জায়গা ওটা। প্রাণের ভয় নেই?

তিনটে টিমটিমে লণ্ঠনের আলো এগিয়ে আসছে। আলোগুলো নিচু পাঁচিল টপকে কবরখানায় ঢুকে পড়ল। তিনমূর্তি, আজই কবর দেওয়া হতভাগ্য কোন ফাঁসির আসামীর কবর খুঁজছে। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা তাজা কবর পেয়েও গেল। প্রাণ পনে হাতের কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে মৃতদেহটাকে বার করার কাজে লেগে পড়ল।।

ঘন্টা খানেকের চেষ্টায় মৃতদেহটাকে মাটি থেকে বার করে ধ্বস্তাধস্তি করে একটা বস্তায় ঢুকিয়ে ফেলল। এই ঠাণ্ডাতেও ঘামে ভিজে গেছে ওদের শরীর, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস পড়ছে। কয়েক মুহূর্ত জিরিয়ে নিয়ে দুজন বস্তা ঘাড়ে তুলে নিল আর তৃতীয় জন কোদাল আর লণ্ঠন নিয়ে পথ দেখিয়ে চলল। 

কবরখানার সীমানা পেরিয়ে গেলে ওদের গন্তব্য আর বেশি দূরে নয়। কিন্তু কারা যেন ওদের অনুসরণ করছে? পেছন ফিরে তাকাতেই, দেখতে পেল আটদশ জোড়া জ্বলন্ত চোখ। বিকট গর্জন করে সেই চোখের মালিকরা মৃতদেহ চোরদের আক্রমণ করল। 

কবরখানার বুভুক্ষু কুকুরের পাল। অগভীর কবরে ফেলে যাওয়া কয়েদীদের শবগুলোর ওপরে ওদেরই অধিকার। হিংস্র কুকুরগুলো কী করে চোখের সামনে দিয়ে ওদের মুখের খাবার চুরি হতে দেয়?

চোরদের দলপতি মাটি থেকে একটা হাড় কুড়িয়ে নিয়ে কুকুরগুলোর দিকে ছুঁড়ে দিয়েই চেঁচিয়ে উঠল, 'ঈশ্যাপে'  অর্থাৎ এস্কেপ। 

কোন রকমে বস্তাটা তুলে নিয়ে দৌড়ল তিনজনে, কুকুরের পাল পেছনে তেড়ে আসছে। পাঁচিল টপকানোর সময়ে একটা কুকুর শেষ চোরটার পায়ের ডিমে কামড় বসিয়ে ঝুলে পড়ল। যন্ত্রনায় চেঁচিয়ে উঠে কোন রকমে পা ছাড়িয়ে কবরখানা ছাড়িয়ে পালাল তিনজনে। 

অমানুষিক পরিশ্রমে চুরি করা মৃতদেহটা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় আরো এক ঘন্টা পরে ওরা ওদের গন্তব্যে পৌঁছল।

বিরাট একটা ব্যারাক বাড়ির মত জায়গা। সার সার ঘর। দলপতির ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা।

ঘর খুলতেই বিকট দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। মোমবাতির আলোয় দেখা যাচ্ছে, ঘরের মধ্যে তিন চারটে অর্ধগলিত শবদেহ,  বেশ কয়েকটা কঙ্কাল আর প্রচুর মানুষের হাড়।

কারা এরা? চোর, বদমাশ না কোন পাগল তান্ত্রিক? 

কোনটাই নয়। ঐ শবচোরদের দলপতির নাম, অন্দ্রেভেসালিয়াস, প্যারিস মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র।  

এই অন্দ্রেভেসালিয়াসের লেখা, 1543 সালে প্রকাশিত, De humanis corporis fabrica, libri septem অর্থাৎ সপ্ত খণ্ডে মানবদেহের গঠনতত্ত্ব, মহাগ্রন্থই প্ৰথম হাজার হাজার বছরের অজ্ঞতা, কুসংস্কার, আর অন্ধ বিশ্বাসের পর্দা সরিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ ও পদ্ধতির আওতায় এনেছিল। আমেরিকান চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক বলে পরিচিত ডক্টর উইলিয়াম অসলারের মতে 'ফেব্রিকা' হল, দ্য গ্রেটেস্ট বুক ইন মেডিসিন।

 

একটু পেছনে যাওয়া যাক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর হল এনাটমি। দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, কোষ, কলা, রক্ত, রস, হাড়, মজ্জা কোথায় কেমন ভাবে থাকে তা না জানলে, কার কী কাজ, বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো কী ভাবে চলে, তা জানার, বোঝার প্রশ্নই নেই।  

কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, ষোড়শ শতাব্দীতে, ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সময়েও হিউম্যান এনাটমির জ্ঞান, দু’হাজার বছর আগে, এরিস্টটল বা হিপোক্রেটিসের সময় থেকে প্রায় কিছুই এগোয়নি।  

এরিস্টটল বা হিপোক্রেটিসের লেখায় এনাটমির ওপরে কিছু তথ্য পাওয়া যায়, তবে সে সবই পশুদেহের গঠনের ওপরে অনুমানভিত্তিক। সাধারণ পূর্বাব্দের তৃতীয় শতকে, আলেক্সান্দ্রিয়াতে হেরোফিলাস কিছু মানব শব ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন কিন্তু বিধ্বংসী এক আগুনে তাঁর লেখা পত্র সব নষ্ট হয়ে যায়। 

বিখ্যাত গ্রীক চিকিৎস কগ্যালেনকে আমরা পাই দ্বিতীয় সাধারণ অব্দে। ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত এই চিকিৎসক এনাটমির ওপরে যা লিখে গিয়েছিলেন তা পরবর্তী পনের শ বছর ধরে বেদবাক্য বলে মান্য ছিল।

গ্যালেন এনাটমির ওপরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করলেও, তিনিও হিউম্যান ডিসেকশন করেন নি এবং এমন কিছু বিরাট ভুল করে গিয়েছিলেন যা ভাঙার সাহস বা ইচ্ছা পরবর্তী দেড় হাজার বছরে কারো হয়নি। সাহস বললাম এই কারণে যে, গ্যালেনের লেখার বিরোধিতা করাকে প্রায় বাইবেলকে অস্বীকার করার মত অপরাধ হিসেবে গণ্য হত। 

তাঁর বইগুলো ইউরোপ এমনকি এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হত, অধ্যাপকরা অন্ধভাবে তা অনুসরণ করতেন। এমনকি যখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন যে, পিত্তথলি বা স্প্লিন পাকস্থলীর সঙ্গে যুক্ত নয়, লিভারে পাঁচটা নয় দুটো লোব, হার্টে তিনটে নয় দুটো ভেন্ট্রিকল, বা জরায়ু বিভিন্ন কোষ্ঠে বিভক্ত নয়, তখনও তা বলতে বা লিখতে সাহস করতেন না। 

এই অচলায়তন ভাঙলেন অন্দ্রে ভেসালিয়াস। সহজ কথা নয়। 

ভেসালিয়াসের প্রায় দু’শ বছর আগে ইউরোপে রেনেসাঁসের আলো জেগে ওঠা শুরু হলেও, চোদ্দশ বছর ধরে এই অন্ধকার দেওয়াল মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবার একটা কারণ অবশ্যই মানব শব ব্যবচ্ছেদের ওপরে চার্চের কঠিন নিষেধাজ্ঞা। 

যখন ভেসালিয়াস প্যারিসে ছাত্র সেই সময়ে ইতালির কিছু শহর যেমন পাদুয়া, বোলোনিয়া আর পাভিয়াতে কিছু কিছু মানবশব ব্যবচ্ছেদ শুরু হয়েছে। লেখার শুরুতে আমরা দেখেছি, কী ঝুঁকি নিয়ে সে কাজ করতে হত। অন্দ্রেভেসালিয়াসের মত চরিত্রের মানুষ ছাড়া তা সম্ভব হত না।  

কেমন মানুষ  ছিলেন এই ফ্লেমিশ ডাক্তার? 1514 সালে ব্রাসেলসের এক অভিজাত পরিবারে ভেসালিয়াসের জন্ম, যদিও ইনি, এঁর বাবার অবৈধ সন্তান ছিলেন। তীক্ষ্মধী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভেসালিয়াস অল্প বয়সেই স্থির করেন, হোলি রোমান এম্পায়ারের সম্রাট, পঞ্চম চার্লসের ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে যোগ দেবেন এবং চিকিৎসা বিদ্যাকে নিজের কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন।

 1533 সালে প্যারিসে পড়তে যাবার সময় মাত্র উনিশ বছর বয়সেই ইউরোপের বিভিন্ন শহরে দক্ষ ব্যবচ্ছেদকারী এবং এনাটমিস্ট হিসেবে ভেসালিয়াসের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। 

প্যারিসে গিয়ে দুজন বিখ্যাত এনাটমিস্ট জ্যাকব সিলভিয়াস এবং জন গাইন্টারের ছাত্র হিসেবে কাজ করার সুযোগকে ভেসালিয়াস পুরোপুরি কাজে লাগালেন। এই সময়েই আমরা দেখেছি, নিজের কাজে শ্রেষ্ঠ হবার চেষ্টায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষটা,  রাত বিরেতে কবরখানায় হানা দিয়ে কয়েদীদের কবরস্থ মৃতদেহ চুরি করা থেকে অর্ধগলিত শবদেহ নিজের ঘরে লুকিয়ে রাখা পর্যন্ত, অমানুষিক সব কাজ করেছেন। ভেসালিয়াস তখন নরদেহ ব্যবচ্ছেদে  পারদর্শিতা অর্জন করছেন।

মাঝে অল্প কিছুদিন ব্রাসেলসে কাটিয়ে 1539 সালে ভেসালিয়াস, ইতালির পাদুয়া ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন এবং মেডিসিনের ডিগ্রী অর্জন করেন। সেই সময়েই তিনি এমন পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন যে ডিগ্রী পাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভেসালিয়াসকে পাদুয়া ইউনিভার্সিটির সার্জারি ও এনাটমি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এখানে ব্যবচ্ছেদের জন্য মৃতদেহ পাওয়া অপেক্ষাকৃত ভাবে সহজ ছিল। শুধু মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত কয়েদী নয়, উদগ্র আগ্রহে ভেসালিয়াস ছাত্রদের বলতেন মরণাপন্ন রোগীদের চোখে চোখে রাখতে- যাতে মৃত্যুর পরে তাদের দেহগুলোকে অধিকার করে নেওয়া যায়। একই সঙ্গে চলতে লাগল ব্যবচ্ছেদ, পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ আর শিক্ষা।

সেই যুগান্তকারী বই, ফেব্রিকার প্রসঙ্গে আমরা আসব, এই গল্পের একদম শেষে। 1543 সালে ফেব্রিকা প্রকাশ হওয়ার এক বছর পরেই ভেসালিয়াস ইউনিভার্সিটির পদ ত্যাগ করে, রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লসের একজন ব্যক্তিগত চিকিৎসক হয়ে যোগ দিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় হেনরি, স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ এবং আরো ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের চিকিৎসক হিসেবে কুড়ি বছরেরও বেশি কাজ করেন। 

ফেব্রিকা প্রকাশ হবার পরে এনাটমিস্ট, শিক্ষক ও লেখক হিসেবে যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে, ঠিক সেই সময়ে চিরকালের মত গবেষণা ও অধ্যাপনা কেন ছেড়ে দিলেন, সে রহস্য পরে উন্মোচিত হবে।

তাঁর চিকিৎসক জীবনও কম রোমাঞ্চকর নয়। ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় হেনরি ল্যান্স (ঘোড়সওয়ারদের দশ ফুট লম্বা লোহার মাথা বসানো কাঠের বর্শা) নিয়ে যুদ্ধ অনুশীলন করছিলেন। প্রতিপক্ষের ল্যান্স তাঁর হেলমেট ভেঙে ঢুকে যায়। মাথার মধ্যে ল্যান্সের ডগার খানিকটা অংশ থেকে যায়। রাজার চিকিৎসকের দল বুঝতে পারছিল না, বর্শার ডগাটা মাথার কতটা ভেতর পর্যন্ত ঢুকেছে। তারা অদ্ভুত এক পরীক্ষা করল। শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত চারজন কয়েদীর কাটা মাথায় ল্যান্স দিয়ে সজোরে ঘা মেরে বোঝার চেষ্টা করল, রাজার আঘাত কত গুরুতর হতে পারে। বলাই বাহুল্য এই উদ্ভট পরীক্ষায় কিছুই বোঝা গেল না।                                                                             

ডাক পড়ল ভেসালিয়াসের।

হুট করে  রাজা গজাদের খারাপ খবর দেওয়া বিপদের কাজ। কিন্তু ভেসালিয়াস এসেই ঘোষণা করলেন যে কাঠের টুকরো ব্রেনের মধ্যে ঢুকে গেছে- মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

হলও তাই। এক সপ্তাহের মধ্যে হেনরি মারা গেলেন। ভেসালিয়াস অটোপ্সি নিজের হাতেই করেছিলেন।  

বিজ্ঞানের ইতিহাসেও সমকালীন সমাজের একটা ছবি উঠে আসে। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ পুত্রস্নেহে অন্ধ। আর সেই পুত্র ডন কার্লোস মানুষের রূপে একটি দানব বিশেষ। 

দাঁত নিয়েই জন্মেছিল সে আর সেই অবোধ বয়সেই স্তন্যদায়ী ধাত্রীদের স্তনবৃন্ত কামড়ে ছিঁড়ে দিত। চোদ্দ পনের বছর বয়েস থেকে তার অন্যতম প্রধান বিনোদন হয়ে দাঁড়াল, অল্পবয়সী মেয়েদের কুমারীত্ব হরণ করা। 

একদিন উন্মাদের মত রাজপ্রাসাদের এক মালীর মেয়ের পেছনে দৌড়তে দৌড়তে হোঁচট খেয়ে পড়ে এবং একটা দরজার নবে মাথা ঠুকে অজ্ঞান হয়ে যায়। 

ছ’জন রাজবৈদ্য মলম পুলটিস করে, তখনকার দিনের এক মহাচিকিৎসা, ব্লাড লেটিং অর্থাৎ রোগীর রক্তপাত করানো এইসব চালাচ্ছিলেন। ওদিকে রাজধানীতে হাজার হাজার রাজভক্ত প্রজা ভগবানকে খুশি করবার উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে নিজেদের দেহে চাবুক মেরে মেরে রক্তাক্ত শোভাযাত্রা চালাতে থাকে। এই সময় আবার ভেসালিয়াসের ডাক পড়ে। 

তিনি কী চিকিৎসা করেছিলেন তার খবর আমাদের কাছে নেই। তবে প্রায় তিন মাস তাঁর চিকিৎসাধীন থাকবার পরে, ধীরে ধীরে সেই অত্যাচারী রাজপুত্র ডন কার্লোস রোগমুক্ত হয়। ইতিহাসবিদদের ধারণা মধ্যযুগীয় উদ্ভট চিকিৎসাতেই ডন কার্লোসের আঘাত জটিল আকার ধারণ করেছিল। ভেসালিয়াসের দেহ ও শারীরতত্ত্বের জ্ঞান সাধারণ চিকিৎসকদের থেকে অনেক গভীর ছিল। খুব সম্ভবত তিনি ভার নেওয়ার পরে পারজিং, ব্লাডলেটিং এইসব ক্ষতিকর চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়ায়,  স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ডন কার্লোস সেরে ওঠে। 

ভেসালিয়াস নিজেই লিখে গেছেন যে তাঁর স্বপ্নছিল, যে চিকিৎসা বিদ্যার ওপরে একটা বই লিখে সম্রাটকে উৎসর্গ করবেন। সে বইয়ের, বিষয়বস্তু এবং তার মধ্যে সমাহৃত জ্ঞান এমন হবে যে তা সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলবে। আর প্রেজেন্টেশন বা উপস্থাপনাতেও বিশ্বসেরা হবে সে বই। 

নিজের এই স্বপ্ন ভেসালিয়াস সফল করেছিলেন। ফেব্রিকা নিঃসন্দেহে, শুধু সেই সময় পর্যন্ত নয়, আজ পর্যন্ত প্রকাশিত সব চেয়ে সুন্দর, জাঁকজমকপূর্ণ আর চোখধাঁধানো মেডিক্যাল বই। 

সাড়ে ষোল ইঞ্চি উঁচু, এগার ইঞ্চি চওড়া, উজ্জ্বল পার্পল রঙের সিল্ক ভেলভেটে বাঁধান, সব চেয়ে উৎকৃষ্ট পাতলা ভেড়ার চামড়া (vellum) দিয়ে তৈরি প্ৰথম আর শেষ পাতা সম্বলিত, সাতশ পাতার এই বইটি ভেসালিয়াস যখন সম্রাটের হাতে তুলে দেন, কোন সন্দেহ নেই যে বইতে কী লেখা আছে তার বিন্দু বিসর্গ না বুঝলেও সম্রাটেরও মাথা ঘুরে গিয়েছিল। 

ফেব্রিকার টাইপোগ্রাফিও ছিল অপূর্ব সুন্দর।

শুধু তাই নয়, এনাটমিক্যালি সঠিক এবং উচ্চ শিল্পগুণ সমন্বিত দুশোর ওপরে ইলাস্ট্রেশনে অলঙ্কৃত ফেব্রিকা সেদিক থেকেও মেডিক্যাল বইয়ের দুনিয়ায় ট্রেন্ডসেটার ছিল। সেই ইলাস্ট্রেশন দেখলে আজও আশ্চর্য হতে হয়।

এর জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল ভেসালিয়াসকে। বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে আল্পস পেরিয়ে সুইজারল্যান্ডের বেসল শহরে, সেই সময়কার ইউরোপের শ্রেষ্ঠ মুদ্রক জন ওপর্নিয়াসের ছাপাখানায় হাজির হয়েছিলেন। যতদিন ছাপার কাজ চলেছে নিজে দাঁড়িয়ে দেখেছেন যাতে প্রতিটি ছবির উডকাট সঠিকভাবে বইয়ের পাতায় উঠে আসে।

এ বইয়ের ছবি এঁকেছেন বেশ কয়েকজন শিল্পী। তবে এ সম্বন্ধে সন্দেহ নেই যে ফেব্রিকার শ্রেষ্ঠ ছবিগুলো তখনকার বিখ্যাত শিল্পী জন স্টেফানসের হাতের কাজ। ফেব্রিকার ছবিগুলো যে শুধু এনাটমিক্যালি সঠিক তা নয়, শিল্পীদের হাতের গুণে প্রাণহীন রক্ত মাংস হাড়ের ছবিতেও এক আশ্চর্য মানবিক ভাব ফুটে উঠেছে। 

ইলাস্ট্রেটরদের হাত থেকে এই মানের কাজ বার করতে ভেসালিয়াসকে কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি। নিজেই লিখে গেছেন যে, শিল্পী আর ভাস্করদের সঙ্গে রোজ রোজ ঝগড়ার চেয়ে কবরখানার কুকুরদের সঙ্গে মারামারিও বোধহয় ভাল ছিল। 

ফেব্রিকার প্ৰথম খণ্ডে আমাদের দেহের স্কেলিট্যাল সিস্টেম বর্ণিত হয়েছে। সঙ্গের ছবিটা দেখলেই বোঝা যাবে যে কী অদ্ভুত দক্ষতায় কঙ্কালের ছবিকেও জীবন্ত করে তুলেছিলেন শিল্পীরা।

দ্বিতীয় খণ্ডে আছে দেহের পেশীসমূহ, তৃতীয়তে শিরা ও ধমনী, চতুর্থে স্নায়ুতন্ত্র, পঞ্চম খণ্ডে ভিসেরাল অর্থাৎ পেটের মধ্যেকার সব যন্ত্রপাতি এবং ষষ্ঠ খণ্ডে আছে হার্ট ও ফুসফুস। শুধু ব্রেনের স্ট্রাকচার বোঝানোর জন্যে পূরো সপ্তম খন্ডটি ব্যবহার করেছেন ভেসালিয়াস। এর আগে কেউ মস্তিষ্কের আকার ও গঠনকে এমন ভাবে পর্যবেক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করেনি।

ভেসালিয়াস যে ভুল করেননি তা নয়। প্যাঙ্ক্রিয়াস, ওভ্যারি এবং এড্রিন্যাল গ্ল্যান্ডের উপস্থিতি তিনি টের পাননি। যোনিপথের শেষে ফ্যালোপিয়ান টিউব দুটিও তাঁর নজর এড়িয়ে যায়। সে আবিষ্কার করবেন তাঁরই সাক্ষাৎশিষ্য, গ্যাব্রিয়েল ফ্যালোপিয়াস। তাঁর নামেই এই অঙ্গের নাম। 

দেহের প্রধান শিরা ও ধমনীদের ভাল ভাবে চিহ্নিত করেছিলেন ভেসালিয়াস। সেই তুলনায়, হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের বর্ণনা ও ছবি অনেক কম আকর্ষক। 

 

ফেব্রিকা প্রকাশের পর ইউরোপের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা শুধু আশ্চর্য নয়, যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সেই বিস্ময় শুধু ফেব্রিকার মান, নির্মাণের ব্যাপ্তি, বিষয়ের গভীরতা, উপস্থাপনা এবং শৈল্পিক সৌন্দর্যের জন্য নয়। 

দেড় হাজার বছরের গ্যালেনিক অচলায়তনের ওপর ভেসালিয়াস সমূলে যে আঘাত করলেন, তার জন্য পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায়, এনাটমিক্যালি সঠিক ছবির সাহায্যে চোখে আঙুল দিয়ে গ্যালেনের ভুল গুলো দেখিয়ে দিলেন।

এতে চিকিৎসক মহলের সবাই যে খুশি হল তা নয়। বরং তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়তে হল তাঁকে। তাঁর নিজের এক সময়ের শিক্ষক, জ্যাকব সিলভিয়াস তো সম্রাটকে চিঠি লিখে বসলেন।  

"আমি মহামান্য সম্রাটের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন এমন ব্যবস্থা নেন, যে এই অজ্ঞ, অকৃতজ্ঞ, অবিশ্বাসী দানব ভেসালিয়াস যেন তার বিষ নিঃশ্বাসে ইউরোপের বায়ুমণ্ডলকে আর দূষিত করতে না পারে।"

অর্থাৎ মৃত্যুদন্ড বা নির্বাসন। তা অবশ্য হয়নি। উল্টে ফেব্রিকা প্রকাশের দুবছরের মধ্যেই সম্রাট ভেসালিয়াসকে নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হবার আমন্ত্রণ জানান। 

কিন্তু ক্রমাগত সমালোচনার মুখে তাঁকে পড়তে হয়েছিল এবং তিনি নিজেই লিখে গেছেন, যে সমকালীন এনাটমিস্ট এবং চিকিৎসকদের এই নিরন্তর আক্রমণের কারণেই তিনি চিরকালের মত গবেষণা ছেড়ে, রাজা মহারাজাদের চিকিৎসায় মনোনিবেশ করে শান্তির জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। 

আবার অন্য দিকে দেখা যায়, ফেব্রিকা প্রকাশ হবার আগে কয়েকশ বছরের প্রথা ছিল এনাটমির ক্লাসে চিকিৎসক বা প্রফেসর একটা উঁচু চেয়ারে বসে বসে গ্যালেনের বই থেকে পড়ে যেতেন আর নীচে অশিক্ষিত নাপিতরা লাশ কাটা ছেঁড়া করত। অধ্যাপক মহাশয় ওই উচ্চাসনে বসে না কিছু দেখতে পেতেন, না বুঝতে  পারতেন। 

ফেব্রিকাতে, নিজে হাতে লাশ কাটার পদ্ধতির ওপরে একটা পূরো পরিচ্ছদ ছিল। ঐ বই প্রকাশের কয়েক বছরের মধ্যেই সেই হাস্যকর উচ্চাসনে বসে পুচ্ছ আন্দোলনের প্রথার বিলুপ্তি ঘটল। 

                                                                                                                                                                                          

অন্দ্রে ভেসালিয়াসেরএই মহাগ্রন্থ ফেব্রিকার কাছে কার্যত আমরা দুভাবে ঋণী। 

প্রথমত, চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কোন সমস্যাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে কিভাবে দেখতে হয় ভেসালিয়াসই তা প্ৰথম দেখালেন। আজকে যে সব বুনিয়াদী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ বলে মানি, তার মধ্যে বেশ কিছু এই বিজ্ঞানীর উদ্ভাবন। 

যেমন বিজ্ঞানকে ধর্মীয় আদেশ নির্দেশের বাইরে এনে, কাব্যিক অলঙ্কার ও ভাষাকে বর্জন করে সহজ সরল গদ্যে বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে সব কিছুকে পরীক্ষা করে নেওয়া, সঠিক ইলাস্ট্রেশন ব্যবহার করে চোখের সামনে দেখিয়ে দেওয়া, প্রয়োজনে জীবন্ত পশুকে ব্যবচ্ছেদ করার অপরিহার্যতা এবং যুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণকে এক সূত্রে সাজিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ আমরা প্ৰথম পেলাম ভেসালিয়াসের ফেব্রিকাতেই।

দ্বিতীয়ত, ভেসালিয়াসের এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে তাঁর তিন মহাশিষ্য, রিয়ালদো কলম্বো, গ্যাব্রিয়েল ফ্যালোপিয়াস ও বার্তলোমিউইউস্টশিয়াস এনাটমি ও চিকিৎসাবিদ্যাকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেলেন। 

কলম্বো মানুষের সার্কুলেটরি সিস্টেমের ওপরে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। 

১। হার্টের সঙ্গে যুক্ত শিরা ও ধমনীদের মধ্যে দিয়ে রক্তের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভালভ থাকে।

২। হার্টের সিস্টোল অর্থাৎ সঙ্কোচন ও ডায়াস্টোল অর্থাৎ প্রসারণ কলম্বোই প্ৰথম সঠিক ভাবে বর্ণনা করেন। এবং,

৩। বহুদিনের ভুল ধারণা ভেঙে তিনি দেখান যে পালমোনারি ভেইন লাংস থেকে লেফট ভেন্ট্রিকলে হাওয়া নয়, রক্ত বহন করে আনে।

ফ্যালোপিয়াস শুধু ফ্যালোপিয়ান টিউব নয়, ওভ্যারিও প্ৰথম দেখালেন। ভ্যাজাইনা এবং প্ল্যাসেন্টা এই নাম দুটো তাঁরই দেওয়া। 

তবে এই তিন শিষ্যের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা ছিলেন বোধহয় বার্তলোমিউ ইউস্টশিয়াস। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অপূর্ব কপার এনগ্রেভিং ছবি সম্বলিত তাঁর অমূল্য পাণ্ডুলিপি প্রায় দুশ বছর ভ্যাটিকানের লাইব্রেরিতে ধুলো সংগ্রহ করছিল। 1552 সালে লেখা পাণ্ডুলিপি 1714  সালে প্রকাশিত হয়।

কানের ভেতরকার ইউস্টশিয়ান টিউব ও এড্রিন্যাল গ্ল্যান্ডের আবিষ্কার, অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম ও থোরাসিক ডাক্টের প্ৰথম সঠিক চিত্রণ ও কিডনির গঠন তন্ত্রের সঠিক বর্ণনা সবই বার্তলোমিউ ইউস্টশিয়াসের কৃতিত্ব। বলাই বাহুল্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের ধারাবাহিক উন্নতিতে সেই ট্র্যাডিশনই সমানে চলেছে ও চলছে। 

আজকের দিনে বসে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভেসালিয়াসের অবদান কিছুটা হয়তো তাঁর নিজের কথাতেই বোঝা যাবে। 

"আমার জীবনে মানবদেহের গঠনতন্ত্রকে আবিষ্কার ও উন্মোচন করবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কিছুই ছিল না।"

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb