সিংহের গুহায়

লেখক - শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

13 অক্টোবর, 2022

আজ সকালে প্রোফেসর নাড়ুগোপাল মিত্তিরের ল‍্যাবে বসে চা খাচ্ছিলাম। ল‍্যাবে চায়ের কাপ নেই, আড়াইশো এম‌এল-এর রাউন্ডবটম ফ্লাস্কে চুমুক দিতে দিতে চায়ের ফ্লেভারটার তারিফ করলাম। তাই শুনে প্রোফেসর মুচকি হেসে বললেন, "ওটা চা নয়। চায়ের পাতার বদলে কুমড়োপাতা দেওয়া ছিল, তবে এই কুমড়ো গাছটা চা গাছের জিন মিশিয়ে তৈরী।"

শুনে আমি ভারি বিরসবদনে বললাম, "এঃ! সবে একটু পজিটিভ এনার্জি এয়েছিল মনের মধ‍্যে, আপনি কুমড়ো বলে ঘেঁটে দিলেন তো?"

প্রোফেসর বললেন, "এনার্জির আবার পজিটিভ নেগেটিভ কি হে? তাছাড়া কুমড়ো, মানে কিউকারবিটা ম্যাক্সিমায়..."

আমি তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিয়ে বললাম, "আলবাত্ হয়! তা সে আপনার বিজ্ঞান এ বিষয়ে যাই বলে থাকুক না কেন, পজিটিভ এনার্জি জীবনটাকে পজিটিভ করে তোলে, আর নেগেটিভ জীবনের জন‍্য দায়ী নেগেটিভ এনার্জি! ডিপ্রেশন, নিম্নচাপ, বুঝলেন?"

প্রোফেসর বললেন, "না হে বংশীবদন, ও সব গুলগল্প! পজিটিভ জীবন, নেগেটিভ জীবন বলে আলাদা কিছু হয় না। জীবন হলো একটা সেলের মত, তড়িৎকোষ যাকে বলে! তাতে পজিটিভ আর নেগেটিভ দুটো দরজা একসাথে না থাকলে চলে না, বুঝলে?"

মেঘ না চাইতেই জলের মত আকস্মিক গল্পবিজ্ঞানের গন্ধ পেয়ে আমি আরো টানটান হয়ে বসলাম টুলের উপর। বললাম, "কি বললেন বুঝলাম না, কি সব কোষমোষ, দরজাটরজা, এর সাথে জীবনের কি সম্পর্ক?"

প্রোফেসর বললেন, "তুমি যেহেতু আকাট মুখ‍্যু, তাই তোমাকে কিছু বলা মানে গোড়ার‌ও আগে থেকে, মানে গোড়ালি থেকে শুরু করা।"

আমি ভেবে দেখলাম এতে অনেক সময় নষ্ট হতে পারে, তাই তাড়াতাড়ি বললাম, "আজ্ঞে না, তড়িৎকোষ বানানে আজকাল তালব‍্য শ দেয়া হয়, সেটা জানি, তারপর এই ধরুন, এই তড়িৎকোষ জুড়ে জুড়ে বড়ো ব‍্যাটারি তৈরি হয়, তা জানি। ছোটো ব‍্যাটারিগুলো একটাই তড়িৎকোষ দিয়ে তৈরি হতে পারে। আর ব‍্যাটারির দুইমুখ থাকে, পজিটিভ আর নেগেটিভ, আঁকা থাকে, লাগিয়ে বসিয়ে দিলে টর্চ জ্বলে, মোবাইল চলে, রেডিও ডাকে, এইসব আর কি! কিন্তু কেন এসব হয়, তা জানতে চাই না, আর জেনেই বা কি হবে?"

প্রোফেসরকে চটিয়ে দেবার এটা একটা কৌশল মাত্র। অমনোযোগী ছাত্র পেলে প্রোফেসরের গল্পবিজ্ঞান ফাঁদার খুবই সুবিধা হয়। তিনি একটুও রাগেন না, কারণ জ্ঞান তাঁর মগজে সবসময় কিলবিল করে বেরোবার জন‍্যে। এইসব জ্ঞানকে আমাদের মাথায় ঠুসে না দেয়া অব্দি তাঁর স্বস্তি নেই। তিনি বললেন, "আহা, ব‍্যাটারির ভেতরের কান্ডকারখানা জানলে জীবনের সাথে ব‍্যালান্স করে চলার মন্ত্র পাবে, তা বুঝছ না? বিশেষ করে সিংহ ব‍্যাটারি হলে তো আর কথাই নেই।"

আমি অনেক ব‍্যাটারির নাম শুনেছি ও দেখেছি। টর্চের ব‍্যাটারি, ঘড়ির ব‍্যাটারি, মোবাইল ব‍্যাটারি, গাড়ির ব‍্যাটারি, টোটোর ব‍্যাটারি, কিন্তু সিংহের ব‍্যাটারি! বললাম, "হেঁয়ালি না করে খোলসা করে বলুন দিকি।"

প্রোফেসর বললেন, "ছোটোবেলায় যদি পর্যায় সারণীটা ভালো করে পড়তে তো একথা বলতে না, মীরমদন কোথাকার! এই যে মেন্ডেলিফের টেবিল, এর একেবারে বাঁয়ে যে লম্বাটে ফালি, তার আগায় এই 'লি' বলে যেটা দেখাচ্ছে সেইটেই সিংহের বাবা, লিথিয়াম ধাতু।"

আমি হাঁ করে দেয়ালের গায়ে ঝোলানো পর্যায় সারণীটার দিকে তাকালাম। সেখানে কতগুলো অক্ষর কতগুলো খোপে বসানো আছে। এর আগে একদিন প্রোফেসরের সাথে টাইম মেশিনে করে রাশিয়ান বিজ্ঞানী মেন্ডেলিফের সাথে দেখা করে এসেছিলাম। তখন জেনেছিলাম এগুলো আসলে বিভিন্ন মৌলের চিহ্ন। "লিথিয়াম ধাতুও নিশ্চয়ই ওরকম কোনো মৌল হবে", আমি বলে ফেললাম।

প্রোফেসর বললেন, "একনম্বরের স্বার্থপর মৌল এই লিথিয়াম, নিজের ইলেকট্রনটাকে পর্যন্ত দুচোখে দেখতে পারে না, ছাড়তে পারলে বাঁচে আর কি! আর তখনই হয় লিথিয়াম আয়ন, মানে Li-ion, কি? হলো তো "লায়ন", মানে সিংহ?"

আমি বেশ বিজ্ঞের মত বলতে যাচ্ছি, "তার মানে আপনি পাতি লিথিয়াম ব‍্যাটারির কথা বলছেন, সে তো মোবাইলে ব‍্যবহার করছিই", ঠিক তক্ষুনি দেখি--- একি! মাথাটা ঘুরছে কেন? চেঁচিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, "আপনাকে বড়ো বড়ো লাগছে, অ্যাঁ! কি খাওয়ালেন বলুন তো চায়ের সাথে?"

ক্রমশঃ নীচু হতে হতে দেখলাম প্রোফেসর বিকটবদনে দাঁত খিঁচিয়ে বলে চলেছেন, "মানে? লিথিয়াম ব‍্যাটারি পাতি? চলো, গিয়ে দেখবে চলো, ভেতরে কি সব ভয়ানক কান্ডকারখানা চলছে! তোমার চায়ে মেশানো "অণিমা" কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে।"

আমি ক্রমশঃ ছোটো হয়ে যাচ্ছি বুঝতে পারছি। জামাপ‍্যান্টগুলোর আড়ালে চাপা পড়তে পড়তে বললাম, "অণিমা কে? আমার গায়ে আগে কাপড় চোপড় দিন, তারপর ওকে ডাকবেন।"

প্রোফেসর‌ও দেখলাম ক্রমাগত ছোটো হয়ে আসছেন, নির্ঘাত তিনিও কুমড়োপাতার চা সেবন করেছেন! ঐভাবেই বলতে লাগলেন, "মূর্খ! 'অণিমা' মানে 'Atomic Neighbouring by Induced Miniature Arrangement', সংক্ষেপে ANIMA, অর্থাৎ কিনা অণুর ভাব! এ আমার সাম্প্রতিকতম আবিষ্কার, হ্যাঁ! আমরা এবার আণবিক স্কেলে পদার্পণ করতে চলেছি। এখানে জামাপ‍্যান্ট দরকার নেই, বুঝলে মর্কট? এনারা কেউ জামাপ‍্যান্ট পরেন না।"

এইসব শুনতে শুনতে দড়াম করে শব্দ করে মৌচাকের মত মেঝেটায় পড়ে গেলাম, আর আমার ঘাড়ের উপর এসে পড়লেন প্রোফেসর মিত্তির। এরপর আর কিছু মনে নেই।

? অক্টোবর, 2022

এটাকে ঠিক ডায়েরি লেখা বলা যায় কি না, জানি না। জানি না আজ কত তারিখ, ছোটো হয়ে গেলে তারিখ বদলায় কি না বুঝতেও পারছি না। আপাতত আমার দেহের অনেকটা অংশ একরকম ঢেউ হয়ে আছে। আর সেই ঢেউকে দিগন্তে বিস্তার করে দিলে তা নাকি মহাশূন্যে মহাকালে কোথাও একটা রেকর্ড হয়ে থাকছে, এটা প্রোফেসর মিত্তিরের থিওরি। পরে আকারে বড়ো হয়ে সেই ঢেউগুলোর একটা ছাপ নিয়ে নিতে হবে ডায়েরিতে। সেইভাবেই বলছি সব কথা।

গতকাল দুপুরের দিকে মনে হয় এই মৌচাকের ভেতরে ঢুকেছি আমরা। প্রোফেসরের নিজের তৈরি কারখানা নাকি এটা। কাল আমাদের আকার ছোটো করে এখানে নিয়ে এসেছেন তিনি। প্রথমে মনে হয়েছিল মৌচাকের মেঝেটা শক্তমত কিছু। কিন্তু দেখছি তা নয়, বরং আমরা সিলিং আর মেঝের মাঝে ভেসে রয়েছি। যেন মৌচাকটা একটা বিশাল বড় মহাকাশযান। আর আমরা ভারশূন‍্য মহাকাশচারী। মৌচাকের উপরে নীচে টানেল বেয়ে যাতায়াত করা যায়। এমনিতে জায়গাটা ভোঁ ভাঁ, জনপ্রাণী নেই বলে মনে হলো, তবে থেকে থেকে অনেক মশার মত কী সব পুনপুন করে ধেয়ে আসছে। হাত দিয়ে তাড়াতে গিয়ে দেখি সে জায়গায় কিছু নেই! আরেকটা ব‍্যাপার, দেয়াল, মেঝে বা সিলিং-এর ষড়ভুজাকার ফ্রেমগুলোতে গা ঠেকলে কেমন ঝাঁ ঝাঁ করে দেহ কাঁপিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম প্রোফেসরকে এর কারণ। উনি বললেন এটা নাকি ইলেকট্রনিক বিকর্ষণ--- আমাদের দেহের ইলেকট্রনের সাথে গ্রাফাইটের কার্বন পরমাণুর ইলেকট্রনের বিকর্ষণ। গ্রাফাইট শুনে আমায় ভুরু কোঁচকাতে দেখে তিনি জানালেন---আমরা নাকি আসলে মৌচাক বলে যেইটে দেখছি, সেইটে পেনসিলের শিসের একটা ছোটো অংশমাত্র, যাকে গ্রাফাইট বলে। জানলায় আটকানোর ষড়ভুজাকার তারজালি দেখেছেন পাঠক? এই জগৎটাও যেন এইরকম কয়েকশো কোটি তারজালের স্তর দিয়ে তৈরী। প্রোফেসর বললেন একেকটা স্তরের নাম মানুষে দিয়েছে, গ্রাফিন। ঐসব ষড়ভুজের এক একটা শীর্ষবিন্দুতে নাকি এক একটা কার্বনের পরমাণু রয়েছে। আমি অতশত বুঝলাম না, তবে আমার দিকে তারা কেমন ড‍্যাবড‍্যাবিয়ে তাকাচ্ছিল। কাছে গিয়ে দেখি, ও বাবা, এ যে তিন হাত বার করে এ ওকে ধরে রেখেছে!

আমি বললাম, "প্রোফেসর, এ বড়ো আজব জন্তু! এই কালাকুচ্ছিৎ তেহাতিগুলো কি জায়গা টায়গা ছেড়ে কোথাও নড়ে না?" প্রোফেসর খেপে গিয়ে বললেন, "তুমি একটা অলম্বুষ! ওরা নড়াচড়া করলে আমরা কোথায় যাবো? আমরা ওদের অতিথি, আর ওরা গৃহকর্তা। আমরা হচ্ছি গেস্ট মলিকিউল, আর এই গ্রাফাইটের দুনিয়াটা হচ্ছে আমাদের হোস্ট। আমাদের দেহ আর ওদের স্তরগুলোর ভেতরে একটা অদৃশ‍্য আকর্ষণ কাজ করছে। ভ‍্যান ডার ওয়ালশ্ নামে এক ইহুদি বিজ্ঞানী এই আকর্ষণ সম্পর্কে অনেক গবেষণা করে গেছেন। এর জন‍্য‌ই ভেসে রয়েছি। বেশি কাছে গেলে ঠেলবে, নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকলে টেনে রাখবে। আর ওহে, পদ্মলোচন, ওগুলো মোটেও তেহাতি নয়, চৌহাতি বলতে পারো। পরমাণুর এক এক হাতে এক এক ইলেকট্রন থাকে। এক পরমাণুর একহাতে ধরা সেই ইলেকট্রন অন‍্য পরমাণুর হাতে ধরা আরেক ইলেকট্রনের সাথে সমঝোতা করে একরকম বাঁধন তৈরি করে। কিন্তু এরা চারনম্বর হাতটায় কাউকে ধরে নেই, শুধু ইলেকট্রন রয়েছে সে হাতে! আর সেই ইলেকট্রনগুলো বড়লোক বাপের বখাটে ছেলের মতো বাঁধনহারা হয়ে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই যে একটা তোমার নাকে বসলো!"

হিঁক! আমি কিছু বোঝার আগেই নাকে একটা দারুণ ঝাপট খেলাম! আউঁফ!

 প্রোফেসর ঐ ইলেকট্রন লক্ষ্য করে এক চড় হাঁকড়েছিলেন, সেটা আমার নাকে এসে লেগেছে। আমি নাক চেপে বসে পড়তে পড়তে শুনলাম তিনি চুকচুক করে আফশোস করছেন, "আহা দেখো দিকিনি, আমার‌ই ভুল! ইলেকট্রনের অবস্থান আর ভরবেগ একসাথে মেপে চড় চালানো অসম্ভব জেনেও সামলাতে পারলাম না! এ হেঃ!"

আমি রেগে গিয়ে বলতে গেলাম, এইগুলো ইলেকট্রন আগে বলেন নি কেন? আমি ভাবছিলাম, মশা! কিন্তু তার আগেই এক ঝটকায় প্রোফেসরের ঘাড়ের উপর গিয়ে পড়েছি! নাকের ব‍্যথায় কাতর হয়ে বসতে গেছিলাম একটা স্তরের উপর, সে ব‍্যাটা এমনি বিকর্ষণ দিয়েছে যে বলার নয়। দুজনে মিলে জড়িয়েমড়িয়ে বেশ কয়টা স্তর পেরিয়ে গেলাম। আর তারপর‌ই দেখলাম সেই আশ্চর্য ঘটনাটা।

উপর থেকে আনুমানিক এগারো আর বারো নম্বর স্তরের মাঝে নেমে এসেছি দুজনে। এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করতে করতেই একটা রাগী গলায় গজরানো শুনতে পেলাম।

কাছে গিয়ে দেখি, একটা গোলগাল বেঁটে মতো লোক একটা মশার মত ইলেকট্রনের সাথে রীতিমতো চোখ পাকিয়ে ঝগড়া করছে। আমার মশা, মানে প্রোফেসরের ইলেকট্রনটা পুনপুন করে লোকটাকে কীসব বলছে। বলার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, কাকুতি মিনতি করছে। কিন্তু লোকটা কোনোমতেই শুনতে যেন রাজি নয়। হঠাৎ দেখি সে কেমন খেপে গিয়ে মশাটাকে ধাক্কা মেরে বলে উঠলো, "তোমার সাথে সংসার করা অসম্ভব! বেরোও, বেরোও, বেরোও!"

এসব দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। প্রোফেসর বললেন, "কি দেখছো? এ সব ওদের নিত‍্যিদিনের ব‍্যাপার। যেমন তোমার আর ফুলির মধ‍্যে হয়! ঐ বেঁটে শয়তানটা লিথিয়াম পরমাণু। পরমাণুদের যেমনি নিয়ম, জন্ম থেকেই ওদের ইলেকট্রনের সাথে বিয়ে। কে কটা ইলেকট্রন নেবে সব জন্ম থেকে ঠিক। হাইড্রোজেন পরমাণু বাদে বাকি সবকটা বহুবিবাহ করে বসে আছে। বুড়ি ইলেকট্রনগুলো থাকে ভিতরের দিকে নিউক্লিয়াসের ওমে। আর কচি ইলেকট্রনগুলো বাইরের দিকে নাচানাচি করে। কাজকর্ম যা দরকার হয় ওরাই করে পরমাণু থেকে বেরিয়ে। এখন সবাই তো আর সমান নয়! কোনো পরমাণু ইলেকট্রন-হ‍্যাংলা, অন‍্যের ইলেকট্রনে অব্দি হাত বাড়ায় রাবণের মতো! বরাদ্দের চাইতে বেশি ইলেকট্রন নিলে তখন আর তাকে পরমাণু বলা যায় না, সে হয়ে যায় নেগেটিভ অ্যানায়ন। আবার এই কেউ কেউ আছে ভয়ানক ক‍্যাটক‍্যাটে, ইলেকট্রনকে দুচোখে দেখতে পারে না! এদের নাম পজিটিভ ক‍্যাটায়ন, এরা বরাদ্দের চাইতে কম ইলেকট্রন পছন্দ করে। তাদের মধ‍্যে সবচাইতে ক‍্যাটক‍্যাটে এই লিথিয়াম পরমাণু। তিন নম্বরের ছোটোব‌উ ইলেকট্রনটাকে ছাড়তে পারলে বাঁচে! প্রতিদিন ওকে বেরিয়ে যেতে বলে। নিজে ব‍্যাটা লিথিয়াম আয়ন হয়ে আরাম করে! আমাদের মতো লিথিয়াম ব‍্যাটাও এই গ্রাফাইটের গেস্ট, এবার ভারি মজা হবে, দ‍্যাখো!"

আমি দেখলাম, লিথিয়ামের ইলেকট্রনটা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লেগেছে আর বলছে, "ওগো, আমায় এই বিদেশ বিভুঁইয়ে ফেলে যেও না, আমি তোমার সাথেই থাকতে চাই, অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ!" এসব দেখে থাকতে না পেরে এগিয়ে সান্ত্বনা দেবো ভাবছি, এমন সময় দেখি আশপাশে ভারি শোরগোল পড়ে গেছে। তার মধ‍্যে কালোমানিক একটা কার্বন পরমাণু ভারিক্কি গলায় বলে উঠলো, "ছোটোখোকা, দেখতো ব‍্যাপারখানা কি?"

আমি জিজ্ঞাসুচোখে প্রোফেসরের দিকে তাকালে তিনি ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে জানালেন ---ছোটোখোকা মানে কার্বনের ঐ চারনম্বর ইলেকট্রন।

নিমেষের মধ‍্যে পনপন করে এক ঝাঁক ইলেকট্রন হাজির। তারা দেখি সদ‍্য হ‌ওয়া লিথিয়ামের আয়নটাকে ঘিরে ফেলে রীতিমতো শাসাচ্ছে---"কি ব‍্যাপার দাদা! আপনি নাকি এই ইলেকট্রন-বোনটাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন? এসব ঝামেলা হুজ্জোতি এখানে চলবে না। মনে রাখবেন, ইলেকট্রনের মামার বাড়ি এই গ্রাফাইটের দুনিয়া। এ বোন, তুই আমাদের সাথে থাক, কেউ কিছু করতে পারবে না! এই ক‍্যাটক‍্যাটে ক‍্যাটায়নটাকে কেটে পড়তে বল্! এ এ এ ক‍্যাটায়ন, চ‍্যাল্, ভাগ্!"

রাগে গজগজ করতে করতে লিথিয়ামের ক‍্যাটায়নটা বললো, "জানতাম! জানতাম এই-ই হবে! তোমাকে বিয়ে করাটা আমার এ জন্মের ভুল! প্রতিবার চার্জিং-এর সময় আমায় ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসা এইখানে, আর প্রতিবার আমায় তাড়িয়ে দেয়া! রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে বলে, আর কোনোদিন‌ও এ বাড়িতে ফিরবো না আমি! কোনোদিন‌ও না!"

আওয়াজ ক্রমশই জোরালো হচ্ছিলো শুনে যা দেখলাম তাতে আক্কেল গুড়ুম! প্রায় সকল স্তরে কয়েককোটি লিথিয়ামের এক‌ই অবস্থা! সবার‌ই শেষের ইলেকট্রনিক ব‌উটা নিয়ে সমস‍্যা, আর সবাইকেই গ্রাফাইটের দেশ ছেড়ে চলে যেতে শাসাচ্ছে বাকি ইলেকট্রনগুলো। এর ভিড়ে লিথিয়ামের নিজস্ব ইলেকট্রনটা নীরব অভিমানে আর লজ্জায় কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে!

আমাদের মতো তো নয় যে মুখ দেখে চেনা যাবে আগের ইলেকট্রনটা! "নিজস্ব প্রেয়সী ইলেকট্রন হারালে অন‍্য ইলেকট্রন পাওয়া যায় রে, কিন্তু সেই আগেরটাকেই ফিরে পাওয়া যায় না রে পাগলা!"--- প্রোফেসর নিজের মনে যেন বিড়বিড় করে বলতে বলতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন!

লিথিয়ামের ক‍্যাটায়নরা মন ভার করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো গ্রাফাইটের দুনিয়া থেকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। ভাবছিলো, এতো রাগারাগি না করলেই ভালো হত। আর ওদিকে ওদের ইলেকট্রনগুলো মিশে গেছিলো গ্রাফাইটের ইলেকট্রনগুলোর স্রোতে। ফুলির কথা ভেবে মনে হলো, ইস্, বিচ্ছেদের ব‍্যথা বিরহের চাইতে বেশি!

ছবি: গ্রাফাইটের ষড়ভুজাকার স্তরের মাঝে রূপোলি চকচকে লিথিয়াম পরমাণুর সারি।

মনখারাপ করে, মাথা নীচু করে, গ্রাফাইটের দেশ থেকে পালে পালে Li-ion সিংহরা বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে ভাবছিলাম: মানবিকতা, ইয়ে মানে, পারমাণবিকতা আজ বিপন্ন! ছলোছলো চোখে এইসব ভাবছি, আর পেছন থেকে খুকখুক করে কাশিমেশানো হাসির শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি, প্রোফেসর মিত্তির তাঁর ফোকলা মাড়ি বের করে হাসছেন! দেখে আমার পিত্তি জ্বলে গেলো! বললাম, "অন‍্যের দুঃখে সমব‍্যাথী না হতে পারেন, ব‍্যঙ্গ করবেন না প্লিজ্! এই একই কাণ্ড আজ বাড়িতে ঘটিয়ে এসেছি, ফুলির সাথে আমার আর পোষাচ্ছে না! ও আপনি বুঝবেন না!"

প্রোফেসর বললেন, "আহা চটো কেন? মজাটা দেখোই না, লিথিয়ামটা আবার ফিরে আসবে, আসতেই হবে। না আসার কোনো জো নেই যে! আমি তোমার কাছেই ফিরে আসবো….সেই গানটার মতো।"

এসব উৎকট বেসুরো গানে পাত্তা না দিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম একটা সিংহের কাছে। তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, "রাগটাগ করে তো চলে যাচ্ছো, তা যাবে কোন্ চুলোয়?"

সে বললো, "আমাদের টিমলিডার আছে, সে যা বলবে, তাই-ই হবে। আমরা এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না মশাই!"

আমি বললাম, "বেশ বেশ! তা তোমাদের লিডারটি ক‌ই দেখি?"

সে আঙুল তুলে যেদিকে দেখালো সেদিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমাদের যেমনি সভা মিটিং হয়, তেমনি একটা লিথিয়াম আয়ন সভা ডেকে বাকিদের কী সব জানি বলছে! ব‍্যাকগ্রাউন্ডে আবার গান বাজছে: আজ জীবন খুঁজে পাবি, ছুটে ছুটে আয়, চার্জ নিয়ে আয় রে, ভর নিয়ে আয়, ট‍্যাঁ ট‍্যাঁ ট‍্যাঁ ট‍্যাঁ, ট‍্যাঁ ট‍্যাঁ ট‍্যাঁ ট‍্যাঁ! আর তার মধ‍্যেই হোমড়া গলায় নেতা লিথিয়াম ক‍্যাটায়নটা ভাষণ দিচ্ছে---

"আমার স্নেহের সিংহের দল, এই গ্রাফাইটের ওঁচা দুনিয়া পেরোলে পাবে এক তামার সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গের পাশ দিয়ে পেরোলে শোনা যায় এক আঠালো রাস্তা আছে, তবে ভয় নেই সাথিয়োঁ, সে আঠা কাঁঠালের নয়, তাই তেল মাখতে হবে না। তবে এর পরে যা আছে তা আমাদের শাস্ত্রে লেখা নাই! অত‌এব এর পরে আর কিছু নেই বলে মেনে নিতে হবে!"

আমি বললাম, "কি সাংঘাতিক! শাস্ত্রে লেখা নাই, তো কিছু নাই? এ আবার হয় নাকি?"

পেছনে একটা রামচিমটি খেলাম। প্রোফেসর ফিসফিসিয়ে বললেন, "আরে মর্কট, ওদেরকে ওদের মতো এগোতে দাও না! রাস্তা তো আমার মাথায়!"

আমি আর কিছু বললাম না। এদিকে সামনে কিছু নেই জেনে বেশ কয়েকটা লিথিয়াম আয়নের দেখলাম ভারি ভয় করেছে। তারা এগোতে রাজি নয়। গ্রাফাইটের দেশেই থেকে যাবে সেই ধনঞ্জয় জামাইয়ের মতো, প্রহারেণ ধনঞ্জয়, আর কি! অনেক বলে বোঝানোতেও এদের কিছুতেই পালে সামিল করতে না পেরে শেষমেষ সামনের দিকে র‌ওনা হল সিংহের দলটা।

আমি কি করবো বুঝতে না পেরে পেছন ফিরে প্রোফেসরের দিকে তাকালাম। উনি দেখি আমাকে দুই লাফ দিয়ে টপকিয়ে চলে এলেন সামনে, আর আমার দিকে তাকিয়ে পুলিশের মতো বললেন, "ফলো মি!"

অত‌এব লিথিয়াম আয়নদের অভিযানে সামিল হলাম আমরাও।

তামার সুড়ঙ্গ শুনে মনে হয়েছিল হামাগুড়ি দিয়ে পেরোতে হবে। কিন্তু সে দেখি এলাহি অভ‍্যর্থনা সিংহের জন‍্যে। সুড়ঙ্গে আমাদের ঢুকতে হবে না, পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যেতে হবে। তার বিরাট ফটকের উপরে লেখা, কালেক্টর আপিস, স্বাগতম, আপনার যাত্রা শুভ হোক। আর চারপাশে তামার আয়নগুলোর প্রণামের সে কি ঘটা! লিথিয়াম আয়নদের চার্জ দেখে তাদের ভক্তিতে একেবারে গদগদ অবস্থা! হবেই তো, লিথিয়াম প্রথম দিকের মৌল বলে কথা, এদের কাছে দেবতার মত! প্রোফেসর জানালেন, চার্জ থাকলে মাথার পেছনে নাকি ভগবানের মত জ‍্যোতি দেখা যায়। কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের চার্জ নেই! সেয়ানা একটা তামার ক‍্যাটায়ন ক‍্যাটক‍্যাট করে বকে আমাদের আটকে দিল--- "হেই ইউ! তুমহে দেখ্ কর্ বব্বর শের নহি লগতা! তুমলোগোকা চার্জ কিধর গ্যয়া?"

এই শুনে আশপাশেও বেশ গোলমাল শুরু হল। আমরা কারা, কোন গোষ্ঠীর আয়ন, আদৌ আয়ন কি না, লিথিয়াম আয়নদের সাথে আমাদের ঢুকে পড়ার উদ্দেশ্য কি, এসব নিয়ে ভীষণ তর্ক হতে লাগল। সীমান্তে ইলেকট্রনিক পাহারা বসানো সত্ত্বেও কিকরে তামার সুড়ঙ্গের এপাশে এলাম এ নিয়ে পদযাত্রার প্ল‍্যান আঁটতে থাকল একদল তামার আয়ন! এমনকি কেউ কেউ চ‍্যাঁচাতে লাগল 'আয়নতামামি' চাই বলে! সঠিকভাবে আয়নের সংখ‍্যাগুণে আমাদের মত নিস্তড়িৎ সুপ্রা-অণুদের বার করে দেবার দাবি উঠছিল, কিন্তু হেড কালেক্টর এসে আসন্ন তেইশে অক্টোবরের মোল দিবসের কথা মনে করিয়ে দিতে সবাই একটু ঠাণ্ডা হল। হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ, মোল দিবসের আগে এইসব গুণে গুণে আয়নের সংখ্যা গুণলে নাকি মোলত্বের অপমান হবে!

কিন্তু, এ তো ভারি বিপদ হল! এইবারে কি হবে? প্রোফেসর দমবার পাত্র নন। তক্ষুণি আমার মুন্ডুটা ধরে নিজের মুন্ডুর সাথে খানিক ঘষে নিলেন। তারপর বললেন, "এই তো! এবার খুশি?"

ক‍্যাটায়নটা বলল, "হামকো পাগল পায়া হ‍্যায় ক‍্যায়া? উল্লু হ‍্যায় হাম, হামে পাগল বনানা ইৎনা আহসান নহি! ইয়ে তো স্ট‍্যাটিক চার্জ হ‍্যায়, পার্মানেন্ট চার্জ কিধর হ‍্যায়? হাঁয়?"

হিন্দি বলার স্টাইলটা কোথায় যেন শুনেছি বলে মনে হচ্ছিল। প্রোফেসর বললেন, "পার্মানেন্ট চার্জকা লিয়ে অ্যাপ্লাই কিয়া হ‍্যায় না! আ যায়েগা, কুছ হি দিনো মে আ যায়েগা। ফিলহাল হামে যানে দো, নেহি তো উয়ো লিথিয়াম ক‍্যাটায়ন সারে রাস্তে পেহচান নেহি পায়েঙ্গে!"

এসব শুনে যাইহোক তামার ক‍্যাটায়নটা রাজি হল আমাদের যেতে দিতে। আমি দেখলাম, আমাকেও একটু হিন্দি বলতে হয়, ন‌ইলে ভেতো বাঙালি ভাববে! তাই বেশ রোয়াব নিয়ে যেই বলেছি, "হাঁ হাঁ, যানে দো হামে, তাং মাত কারো, তাং মাত কারো", অমনি প্রোফেসর এক ধমকে আমায় চুপ করিয়ে দিলেন। তারপর মিহিসুরে মিঠে করে তামার ক‍্যাটায়নটাকে বললেন, "ছোড় দিজিয়ে, ইসে হিন্দি আতা নেহি, বাং গালি হ‍্যায়! মেহেরবানি হ‍্যায় আপকা, হামে যানে দিজিয়ে!"

বাকি তামার ক‍্যাটায়নরা একসাথে বলে উঠলো, "যেতে দাও, যেতে দাও, ন‌ইলে লিথিয়ামের আয়নগুলোকে সারা রাস্তা গার্ড দেবে কে?"

প্রোফেসর আর আমি বীরদর্পে বেরিয়ে এলাম তাম্রকালেক্টর আপিস থেকে। প্রোফেসর পেছন ফিরে কায়দা মেরে বললেন, "বাই, সি ইউ প্লাস টু!"

আমি বললাম, "কি যে বলেন, ওটা শুধু সি ইউ হবে!"

প্রোফেসর মিত্তির দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, "হনুমান কোথাকার! যা জানো না তা নিয়ে জ্ঞান দিতে এসো না বাপু! ওটা সি ইউ প্লাস টু-ই হবে, তামার ক‍্যাটায়নের চিহ্ন ওটা Cu, মাথার ডানপাশে +2, ক্লাস সিক্সের ছাত্র‌ও জানে, আর তুমি জানো না!"

সামনের আঠালো রাস্তায় তখন হাজার হাজার লিথিয়াম আয়নের ভিড়, পা রাখামাত্র সুড়ুৎ করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ইপোক্সি রেসিন আর পলিপ্রোপিলিনের প‍্যাঁচালো লাইন, অনেকটা আমাদের সেই রৌপ‌ওয়ের মত, আর কি! বিশেষভাবে চার্জ করা আয়নরা যাতে যেতে পারে সে জন‍্য এরকম কঠিন পলিমার বানানো হয়েছে, জানালেন প্রোফেসর। পলি মানে অনেক, মার মানে টুকরো, অনেকগুলো টুকরো টাকরা জুড়ে এইরকম সব অণু বানানো। সবাই যে আয়ন ব‌ইতে পারে, তা নয় কিন্তু। আদপে বেশিরভাগই পারে না। মানুষে ভেবেচিন্তে কিছু বানিয়েছে যারা আয়ন ব‌ইতে পারে।

স্ট‍্যাটিক চার্জ দিয়ে আমরাও এ রাস্তাটা পেরিয়ে এলাম। এখন দেখি লিথিয়ামের ভিড়ের বিভিন্ন আওয়াজ গুণগুণ, হাহাহিহি, চ‍্যাঁচামেচি, ক্রমশঃ যেন মিলিয়ে আসছে। সব চুপচাপ হয়ে আসছে যেন। ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ‍্যায় ভাই? খেয়ে ফেললে নাকি কোনো রাক্ষসে? একটা বাড়তি শোঁ শোঁ আওয়াজ যেন ভেসে আসছে, সমুদ্র? কিসের সমুদ্র? দৌড়ে গেলাম আমরা দুজনে।

? অক্টোবর, ২০২২

কাল দৌড়ে আসার পরে আর ডায়েরি লেখার সুযোগ পাই নি। একেবারে সেই 'সমুদ্র'(?) পেরিয়ে এসে অ্যালুমিনিয়ামের গেটের বাইরে বসে একটু লিখে নিচ্ছি। যা সব কাণ্ড ঘটছে, আদৌ বেঁচে ফিরতে পারবো কিনা তার কোনো গ‍্যারিন্টি নেই মশাই! এই কথাটা এই কারণে বললাম, যে আমার সাথে প্রোফেসর নাড়ুগোপাল মিত্তিরের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে আচমকা। আর তাঁর দেখা না পেলে আমি আর বড়ো আকারে ফিরতে পারবো কিনা জানি না! তাই এইবেলা সব মনে থাকতে থাকতে চিন্তার ঢেউটা চাড়িয়ে ডায়েরিটা লিখে নি, বাইরের মানুষ একটু জানুক, ব‍্যাটারির পেটে পেটে কিরকম শয়তানি!

হ‍্যাঁ, তারপর তো দুজনে মিলে সমুদ্র দেখতে ছুটে গেলাম। এমন সমুদ্র কখনো দেখিনি আমি। পৃথিবীর কোনো সমুদ্রের সাথে তার তুলনা হয় না। আদিগন্ত, অসীম, গগনচুম্বী, ও হ‍্যাঁ, বাস্তবে গগন তো নেই-ই। পুরোটাই সমুদ্র, নিরবচ্ছিন্ন, নিবিড় প্রাচীরের মত অথচ ছলোছলো সে সাগর। লিথিয়াম আয়নদের সাথে আমিও হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর সেই শব্দটা আবার শুনতে পেলাম, শোঁ শোঁ। এ আওয়াজ সাগরের নয়। লিথিয়াম আয়নদের নাকটানার সম্মিলিত আওয়াজ। ওরা কাঁদছে। লক্ষ লক্ষ লিথিয়াম ক‍্যাটায়ন কাঁদছে, হাপুস নয়নে কাঁদছে।

প্রোফেসর আর আমি এগিয়ে একটা কাঁদোকাঁদো আয়নকে আদর করে জিজ্ঞেস করলাম, "কি হয়েছে? কান্দো কেনে?"

সে হাউমাউ করে কেঁদে বললে, "আমার মেজদা! আগেরবার চার্জিং দেয়ার সময় এই সমুদ্রের পারে আটকে মরে যায়। সমুদ্র পেরিয়ে এলেও সমুদ্র ছাড়তে চায় না আমাদের, অনেকেই মরে যায় এই পারে। ঐ দেখুন, সমাধিও আছে।"

আমি দেখলাম---সমাধির উপরে ইংরেজি অক্ষরে লেখা আছে, 'এস. ই. আই'। জিজ্ঞাসা করলাম প্রোফেসরকে, এর মানে কি? তিনি মুরুব্বি চালে ধীরে ধীরে বললেন, "ওটা হল সলিড ইলেকট্রোলাইট ইন্টারফেজ়। চার্জিঙের সময় ব‍্যাপারটা ভালো করে বুঝতে পারবে।"

আমি বললাম, "হুঁ, এস.ই.আই, অর্থাৎ কিনা 'সেই', সেই, এখন না বোঝাই ভালো!"

প্রোফেসর বললেন, "এই সেই, সেই সেই নয়, এ হল গ্রাফাইটের দেশের বাঁধের মত। এতে লিথিয়াম আয়ন মরে পড়ে থাকে বটে, কিন্তু তাতে লাভ হয় এই যে, সমুদ্রটা সুনামির মত গ্রাফাইটের উপর এসে ঝাঁপাতেও পারে না। স‍্যাক্রিফাইস, বুঝলে চন্দ্রকান্ত, একে বলে ত‍্যাগ। দেশের জন‍্য দশের ত‍্যাগ!"

আমি আবার বললাম, "S.E.I. ইন্টারফেজ়ই বলুন, আর ইন্টারফেস‌ই বলুন, বুঝলাম এই সমুদ্রসৈকত। কিন্তু সলিড আর ইলেকট্রোলাইট, মানে…"

প্রোফেসর আমায় মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, "জানি তো, তুমি বুঝবে না! তুমি একটি আশ্চর্য প্রাণী। সলিড হচ্ছে ঐ গ্রাফাইটের দুনিয়া। আর এই ইলেকট্রোলাইট হচ্ছে লবণের সমুদ্র, এইটে, যেমন সেবার তোমার পেটখারাপ হয়ে ডিহাইড্রেশন হলে পরে খাইয়েছিলাম। সেটা ছিল নুনজল। জলে সোডিয়াম ক্লোরাইডের দ্রবণ, যাতে থাকে সোডিয়াম ক‍্যাটায়ন‌। তা বলে এটা খেতে যেও না, এটা ব‍্যাটারির ইলেকট্রোলাইট। এতে সোডিয়ামের বদলে আছে লিথিয়াম ক‍্যাটায়ন। আর জলের বদলে আছে জৈব দ্রাবক। এই ইলেকট্রোলাইট না থাকলে এপার ওপার করা যেত না। এখন ব‍্যাপার হল…"

প্রোফেসর আরো অনেকটা বলতেন হয়তো, কিন্তু একটা ন‍্যাকা ন‍্যাকা লিথিয়াম ক‍্যাটায়ন এসে তাঁকে হাত কচলে কচলে জিগ‍্যেস করলো, "ইয়ে মানে স‍্যার, ওইপারে কি যেতেই হবে? না গেলে হত না? এত বড়ো সমুদ্র, পেরোনোর কি দরকার?"

প্রোফেসর খেপে গিয়ে বললেন, "যাবে না মানে? যেতেই হবে! কেমিক্যাল পোটেনশিয়ালের ঠ‍্যালা তো জানো না, ঠ‍্যাঙাতে ঠ‍্যাঙাতে সমুদ্র পার করাবে! হুঁ! পার হবে না! কেমিস্ট্রি পাল্টে দেবে ভেবেছো?"

আমি সবে জিগ‍্যেস করতে যাব যে পোটেনশিয়ালটা কেমন শিয়াল, ঠিক সেইসময় সেই ন‍্যাকা ন‍্যাকা লিথিয়াম আয়নটাকে ঘিরে বাকি অনেক লিথিয়াম আয়ন খুব একটা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শুরু করে দিল। সবাই একসাথে বলে, "স্যার, ওকে সার্চ করে দেখুন, নিজের বাইরের ইলেকট্রনটাকে লুকিয়ে নিয়ে যাবার তালে আছে! ব‌উটার মায়া ছাড়তে পারছে না!"

তা তার আগাপাশতলা হাতড়ে দেখা গেল যে ওদের অভিযোগটাই সঠিক। তখন লিথিয়াম আয়নটা, যদিও ওটাকে পুরো আয়ন বলা ভুল, সে যাই হোক, কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, "আমার কোনো দোষ নাই স‍্যার, ইলু আমায় ছাড়তে চাইছিলো না! অনেক বকাবকি করেছি, তাও এই অব্দি চলে এলো।"

প্রোফেসর গম্ভীর হয়ে ঘাড় নাড়লেন আর বললেন, "এ হয়না, সে যতই আদর করে তাকে ইলু বলোনা কেন! আজ দুজনের দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে! এ রাস্তায় ইলেকট্রন পরিত‍্যাজ‍্য। ইলেকট্রোলাইটের এই সমুদ্র পেরোতে গেলে ইলেকট্রনকে রেখে আসতে হয় তামার কালেক্টর আপিসে। একা লিথিয়াম ক‍্যাটায়ন‌ই কেবল এ সমুদ্র পেরোবে, এই নিয়ম। আর সমুদ্র তোমাকে পেরোতেই হবে, এটাও নিয়ম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তোমার ইলেকট্রন কি নিজে নিজে পারবে ঐ তামার আপিসে পৌঁছোতে?"

পুনপুন আওয়াজে সেই লুকোনো ইলেকট্রনটা জানালো, এ রাস্তায় তার প্রিয়তম লিথিয়াম ক‍্যাটায়নকে ছেড়ে, একা পিছনে ফেরা তার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। আর এই শুনে কেবল একজন‌ই শিভ‍্যালরি করতে এগিয়ে আসতে পারে, তিনি হলেন একমেবদ্বিতীয়ম, প্রোফেসর শ্রী নাড়ুগোপাল মিত্তির মহাশয়!

অত‌এব তাঁকে বিদায় দিলাম এই শর্তে যে সাগর আমরা সবাই একসাথেই পেরোবো। ইলেকট্রনটাকে তামার আপিসে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি ফিরে এলে পরে। হায়! তখনো জানতাম না, এ বিদায় কি দায় হতে চলেছে!

এরপর যা হলো মশাই বললে পেত‍্যয় যাবে না! কিছুক্ষণ পরেই দেখি ক‍্যাটায়নগুলো মহা উশখুশ করতে শুরু করেছে। কেউ কেউ পেট ধরে সমুদ্রের পার বরাবর ছুটছে, কেউ উঃ আঃ বলে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই করতে করতে কোটি কোটি ক‍্যাটায়ন চ‍্যাঁচাতে শুরু করলো, বাপরে, কি টান, কি টান বলে! তারপর এগিয়ে গিয়ে আর থাকতে পারে না! পালে পালে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লো। গিজগিজ করতে লাগলো সামনের জল, থুড়ি, জৈব দ্রাবকের অংশটা! আর এইসব দেখে আমারো কেমন জানি পেট গুড়গুড় করে উঠলো! কি একটা শক্তি যেন টান মারতে থাকলো সামনের দিকে! উঃ! সে কি টান মাইরি!

প্রোফেসরের জন‍্য আর অপেক্ষা করলে পেট নির্ঘাত ফেটে চৌচির হয়ে যাবে! কৃষ্ণ শুনেছি দামোদর হয়ে ছিলেন উদরে দাম মানে দড়ি বেঁধে! এ তো দেখি সেই এক অবস্থা! আর থাকতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে সমুদ্রের মধ‍্যে দিলাম পা ডুবিয়ে। যা থাকে কপালে!

পা ডুবিয়েই বুঝতে পারলাম ভেতরটা ঢালু, যেমন পুকুরের ঘাট হয় আর কি! কিন্তু, কিন্তু, এটা কিরকম সমুদ্র! আমি পিছলে যেতে শুরু করলাম তার ভেতরে! প্রোফেসর একবার বলেছিলেন মনে পড়লো, খুদেদুনিয়া নাকি ভারি অদ্ভুত! যা দেখা যায় তার সবটা নাকি সত‍্যি নয়! এটা মোটেই সমুদ্র নয়! এটা আসলে একটা জলপ্রপাতের মতো এবং তাতে যথেষ্ট স্রোত আছে, আর তার একটা আশ্চর্য টান আছে। আর আমাকে কষ্ট করে সমুদ্র পার হতে হবে না, সড়াৎ করে গড়িয়ে পড়ছি কোন্ অজানা জায়গায় কে জানে? তবে একটা আশ্চর্য ব‍্যাপার, বেশ রিল‍্যাক্সড্ ফিল্ করছি! যেন এক লহমায় অনেক উদ্বেগ কমে যাচ্ছে।

"আপনার কেমিক্যাল পোটেনশিয়াল আসলে কমে আসছে, তাই এরকম লাগছে। ডিসচার্জিং-এর কেস তো, এক্ষেত্রে এটা সম্পূর্ণ ন‍্যাচারাল ব‍্যাপার স‍্যার"---মিহি গলাটা শুনে তাকিয়ে দেখি আওয়াজ আসছে পতনোন্মুখ আমার পায়ের নীচ থেকে! এটা কে?

একটা পাঁচমুখো অণু দেখি আমার পায়ের নীচে! আমি তো ভয়ে 'আঁক্' বলে মেরেছি এক লাফ! কিন্তু সে ব‍্যাটা আমার ঠ‍্যাংদুটো কিছুতেই ছাড়ে না! অনেক সাধ‍্যসাধনা করেও ছাড়াতে পারলাম না। তারপরে সে বলে, "অধমের নাম ই সি, পুরো নাম ইথিলিন কার্বোনেট। আমার মতো আরো বেশ কয়রকম অক্সিজেন পরমাণুওয়ালা অণু আছে আপনাদের সেবায় নিযুক্ত।"

আমি বললাম, "বাঃ, দিব‍্যি উপর থেকে নীচে আছড়ে পড়ছি, তার উপর আবার সেবা! ইয়ার্কি পেয়েছো!"

শুনে সে ভারি দুঃখু দুঃখু মুখ করে বললো, "যা বলবেন স‍্যার বলুন! আমরা তো জৈব দ্রাবক মাত্র। ফেরি সার্ভিস করি এপার ওপার। আপনাদের‌ই মতো লিথিয়াম ক‍্যাটায়নদের ফেরি করি! ঐ নীচে যেদিকে যাচ্ছেন, সেদিকে আপনাদের মতো ক‍্যাটায়নদের আকাল বলেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নীচে গেলে আরো ভালো থাকার জায়গাও পাবেন স‍্যার।"

আমি বললাম, "হ‍্যাঁ, ঐ অক্সিজেন পরমাণুটাকে রেখেছো কেনো? পায়ে চ‍্যাটচ‍্যাট করছে, ইস্! এতক্ষণ খেয়াল করিনি, ছ‍্যাঃ!"

দ্রাবকের অণু বললো, আসলে স‍্যার, "অক্সিজেন থাকলে আপনাদের পাকড়িয়ে রাখতে হেভি সুবিধে, স‍্যার, হেঁ হেঁ!"

আমি আর কথা বাড়ালাম না। যদি কিছু জিগ‍্যেস করে আর না বলতে পারি, সে ভারি লজ্জার ব‍্যাপার হবে। চারপাশে তাকিয়ে দেখি লিথিয়াম ক‍্যাটায়নগুলো ভারি খুশি হয়ে নীচে নামছে। ওরাও মনে হয় আমার মতো রিল‍্যাক্সড্ বোধ করছে! নাকি, সবটাই মনের ভুল?

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই রাস্তা এলো ফুরিয়ে আর সমুদ্র শেষ হয়ে আমরা সবাই একটা প্রকাণ্ড চকচকে মসৃণ দেয়ালে গিয়ে আছড়ে পড়লাম! তারপরে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছি! এপারে প্রোফেসরের দেখা নেই, অপেক্ষা করছি, দেখি সমুদ্র পেরিয়ে কখন পৌঁছান তিনি।

? অক্টোবর, ২০২২

ঘন অরণ্য। পেল্লায় পেল্লায় সব গাছের সারি। কিন্তু জঙ্গুলে পোকা, জন্তু বা পাখপাখালির কোনো আওয়াজ নেই। থাকবে কি করে! এ তো আর সত্যিকারের গাছে ছাওয়া জঙ্গল নয়! অণিমার পাল্লায় পড়ে এ পর্যন্ত যতরকম দৃশ্য দেখে আসছি তার কোনোটাই যে আমাদের মত জ্যান্ত দুনিয়ার নয় তা এতক্ষণে ভালোই বুঝতে পেরে গেছি। এরা জ্যান্ত বটে, তবে এ জ্যান্ত অন্যরকম জ্যান্ত! প্রোফেসর থাকলে ব্যাপারটা আরো ভালো করে বুঝিয়ে বলতেন। তা তাঁর তো দেখি ফেরার‌ই নামগন্ধ নেই। হ্যাঁ, গন্ধের কথায় মনে পড়লো, চারপাশে কেমন একটা টকটক গন্ধ!

গতকাল, যদি আদৌ ওটাকে গত কাল বলা যায়, তবে সেই কালে আমরা, অর্থাৎ আমি আর লিথিয়াম আয়নের দলটা যখন ঐ চকচকে মসৃণ দেয়ালে আছড়ে পড়লাম আর জ্ঞান হারালাম, তারপর থেকে যেই চোখ খুলেছি না, তখন থেকে সামনে এই ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা তালগাছের সারির মত কী সব চোখে পড়ছে! এবার এগুলো পেরিয়ে কোনদিকে কোথায় যে যাই মাথায় ঢুকছে না। কোনো ফাঁক‌ও চোখে পড়ছে না যার মধ্য দিয়ে গলে ওপাশে যেতে পারি।

বড় বড় শপিং মলে যদি ঢুকে থাকো, তো দেখতে পাবে এক জায়গায় সারি সারি চাকা-লাগানো বাস্কেট দাঁড় করানো আছে। যার চাই সে ঐ সারি থেকে একখানা বাস্কেট টেনে গড়িয়ে তাতে জিনিস পুরে রাখতে পারে। কিন্তু টানতে হলে একেবারে দুই ধারের বাস্কেট‌ই টানতে হবে। মাঝের থেকে যে কোনো বাস্কেট টানা যাবে না, ওগুলোর একটার ঠ্যাং আরেকটার সঙ্গে এমন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। এই অরণ্যের গাছগুলোর বিন্যাস যেন ঠিক তেমনি। আমি মনের ডায়েরিটা কখন‌ই কাছছাড়া করিনি, তাই ওতে এই অরণ্যের রেকর্ডটা রেখে দেব ভেবে পাতা উল্টাতে উল্টাতে কথাটা কানে এল।

"ধাতব অরণ্য বলতে পারেন"!

কে বললো? পিছনে তাকিয়ে দেখি একখানা লিথিয়ামের আয়ন বেশ ভারিক্কি চালে তার একমাত্র হাতখানা পকেটে পুরে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ব্যাটাই যে কথাটা বলেছে সন্দেহ নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হচ্ছে!"

"হুঁঃ, এই নিয়ে তিন হাজার তিনশো তেপান্ন বার এই রাস্তা পেরুচ্ছি! এই ব্যাটারির মালিক খুব‌‌ই কিপ্টে, একটা ব্যাটারি টিপে টিপে আজ দশ বছর ধরে ব্যবহার করে আসছে। দিনে দুইবার করে চার্জ দেবেই, আর দুইবার করে আমরাও তাই ডিসচার্জিং করে দিই!"

এসবের বিন্দুবিসর্গ যদিও আমার মাথায় ঢুকলো না, তবুও যেন বুঝতে পেরেছি এমন ভাব দেখিয়ে খুব জোরে ঘাড় নাড়লাম। অনেকক্ষণ পরে একখানা কথা বলার লোক, থুড়ি, আয়ন পেয়েছি। কথায় কথায় সায় না দিলে যদি এ ব্যাটাও মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলেই হয়েছে! তাই তাড়াতাড়ি আমি বললাম, "তা তো বটেই, তা তো বটেই! এখন কোনদিকে যেতে হবে সেটাও নিশ্চয়ই জানা আছে?"

প্রশ্নটা শুনে লিথিয়াম আয়নটা এমনি খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসলে যে আমি কিছুক্ষণ ভেবলে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ অমন অসভ্যের মত হাসার পরে লিথিয়াম আয়নটা বললে, "যাব আবার কোথায়? ঝগড়ুটে বৌ-টা কাছে নেই, এমন অবস্থায় আবার কেউ এমনি বিছানা পেলে নড়তে চায় নাকি মশাই! সকালে ওঠার ঝক্কি নেই, বাজারে যাওয়ার জন্য কেউ জ্বালাবে না, শুয়েবসে থাকব আর খিদে পেলে ঐ কোবাল্ট থেকে খানিক, খানিক অক্সিজেন থেকে ইলেকট্রন খুবলে খেলেই হল! বিন্দাস জীবন, যাব আবার কোথায়! এই তো স্বর্গ!"

আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, 'আরে, শুচ্ছ কোথায় এই ভয়ঙ্কর থমথমে বনের মধ্যে, অ্যাঁ?"

লিথিয়ামটা একটা প্রকাণ্ড হাই তুলতে তুলতে বললে, "ঐ যে সামনের কোবাল্ট ধাতুর আয়নের সারি, ওর ফাঁকে ফাঁকে এতক্ষণে সবাই শুয়ে ঘুমিয়ে নাক ডাকতে শুরু করে দিল, আর তুমি বলছো কিনা শুচ্ছে কোথায়! এইদিকে এসো আমার সঙ্গে, এই ভিতর দিয়ে রাস্তা আছে। ঢুকে পড়ে চাদর-মুড়ি দিয়ে টেনে ঘুম দাও দিকি! হাই, বেলা গড়িয়ে গেল গো!" এই বলে হাই তুলতে তুলতে বেশ ন্যাদোশের মত কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিলে।

তাকে অনুসরণ করে যেতে যেতে ভালো করে দেখি, ও হরি! সামনে উঁচু উঁচু তালগাছের মত যে সারিটা দেখে মনে হচ্ছিল দুর্ভেদ্য জঙ্গল, সেটার মাঝে মাঝে একটা দুটো ফাঁক আছে। লিথিয়াম আয়নটা সেই ফাঁক দিয়ে সুড়ুৎ করে সেঁধিয়ে গেল। আমিও ফাঁক দিয়ে গলে দেখি একেবারে এসি থ্রি-টিয়ার ক্লাসের মত শোবার এলাহি ব্যবস্থা। সারি সারি বিছানা নীচ থেকে উপরে থাকে থাকে উঠে গেছে আর সেগুলোয় পা লম্বা করে শুয়ে শুয়ে লিথিয়ামের অজস্র আয়ন ফুড়ফুড়িয়ে নাক ডাকাচ্ছে। চারপাশে কেমন একটা ঝিম-ধরানো ঘুমুড়ে ভাব! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দুই চোখ আপনা থেকেই যেন বুঁজে আসে। আমি বললাম, "বাঃ, এদিকে দিব্যি সবাই ঘুমিয়ে দিন কাবাড় করছে দেখছি! ওদিকে ইলেকট্রনগুলো আর প্রোফেসরের কি অবস্থা কেউ একবার ভেবেও দেখলে না! আশ্চর্য স্বার্থপর তো!"

আমার গলার আওয়াজটা বোধহয় একটু বেশি জোরে হয়ে গেছিল, তাই সঙ্গে সঙ্গে একটু আগের সেই লিথিয়াম আয়নটা আমাকে দাবড়ে দিয়ে বলে উঠল: "এই, চ্যাঁচাও কেন? অ্যাঁ? দেখছো না কোবাল্ট অক্সাইডের কেলাসের মধ্যে সবাই কেমন খাপে খাপ আটকে গেছে। এনট্রপিটা সবে একটু কমানো হয়েছে কি তোমার চ্যাঁচানি শুরু হয়ে গেল! আর কি হয়েছেটা কি! এখন ডিসচার্জিং চলছে, ওসব ইলেকট্রন-ফিলেকট্রনের কথা ভুলে যাও, আর তোমার স্যাঙাৎ ঐ বদমেজাজি বুড়োটাকে ওদের ওখানেই ঘুরে মরতে দাও। চার্জিং শুরু হলে ফের তোমাদের একজায়গায় দিয়ে আসব'খন! এখন এই যে, এই ফাঁকে দ্যাখো দিকিনি, তোমার ভুঁড়িটা আঁটে কিনা! না হলে সারাক্ষণ আবার কোবাল্ট আর অক্সিজেনের মাঝের ফোঁকরে ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে মরতে হবে তোমায়!"

নাঃ, একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা! এই মোটা মোটা গাবদামুখো হুলোর মত মুশকো লোকগুলো সম্ভবতঃ কোবাল্টের আয়ন। বেশ কয়েকটা মিলে দেখি ম্যাচ শুরুর আগে ক্রিকেটাররা যেমনি মুন্ডু ঠেকিয়ে শপথ-টপথ করে আর হাত মেলায়, তেমনি করে দাঁড়িয়ে আছে জায়গায় জায়গায়। উঁকি মেরে দেখি জায়গাটার মাঝখানটা ঠিক ফাঁকা নয়, বরং একটা কে যেন সেখানে দাঁড়িয়ে এদের যোজ্যতা-টোজ্যতা নিয়ে বিস্তর জ্ঞান দিয়ে চলেছে। এইটা মনে হয় অক্সাইডের আয়ন, আর না হয় এর উল্টোটা। ইলেকট্রনগুলো ফিরলে কিভাবে ওদের কোথায় বসাতে হবে সেরকম কিছু বলছে বলে মনে হল‌। তবে এদের সঙ্গে আর তর্ক চালিয়ে লাভ নেই মনে হলো। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে একখানা ফাঁকে নিজের বিছানা পাতার চেষ্টা করতে শুরু করেছি কি করিনি, আচমকা ধাতব অরণ্যের নিস্তব্ধতা চুরমার করে কেমন একটা হৈ হৈ রৈ রৈ শব্দ ক্রমশঃ জোরালো হয়ে কানে আসতে থাকলো।

লিথিয়াম আয়নটা, যেটা একটু আগে আমায় চুপ করার উপদেশ দিয়ে বিছানায় লম্বা হয়েছিলো, সেই শব্দ শুনেই, "ঐ রে, সেরেচে কম্মো" বলে তড়াক্ করে উঠে বসলো একটা কোবাল্ট আয়নের টাকের উপর। ঠিকঠাক জায়গায় না বসায় প্রথমেই একটা জোর ঝটকা খেয়ে সে ছিটকে পড়ল আরেকখানা লিথিয়াম আয়নের কোলে। তারপর দুজনে মিলে এ ওকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না শুরু করলো হাপুসনয়নে আর কি বলবো!

আমি খুব আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "আরে! কাঁদো কেন?" তা সে কে আর কার কথা শোনে! সংক্রামক কান্না দেখি ছড়িয়ে পড়ছে গোটা জঙ্গলের মধ্যে। আবার সেই একটানা হাউহাউ আর শোঁ শোঁ শব্দ অর্থাৎ কান্না এবং তারপরে নালে-ঝোলে এক হয়ে নাক-টানার শব্দ! কিন্তু কেন যে কাঁদছে তার বিন্দুবিসর্গ কিছুই বুঝছি না। খালি মাঝে মাঝে দুই-একটা ভাঙা ভাঙা কথা শুনতে পাচ্ছি, "ঐ, ঐ যে এলো, এলো রে ওরা, ওরে আমাদের সুখ-শান্তি সব গেল রে! ওরে, দুদণ্ড শান্তিতে ঘুমুতে দিলো না রে!"

ব্যাপারটা আরেকটু পরেই খোলসা হল। স্পষ্ট একটা হেঁড়ে গলায় বেসুরো গান শুনতে পেলাম, "ভুলো না তারে ডেকে নিতে, বন্ধু তোমার পথের ইলুকে চিনে নিও, কাঁখের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও, ভুলো না তারে ডেকে নিতে।"

যা ভেবেছি তাই। প্রোফেসর নাড়ুগোপাল মিত্তির উইথ অল হিজ ওবিডিয়েন্ট ইলেকট্রনিক ডিসাইপলস্, মানে ঐ ইলেকট্রনের দলবল ফিল্মি কায়দায় নাচতে নাচতে এগিয়ে আসছে আমাদের সামনে। আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম আর ঐরকম বিশ্রি সুরে গাওয়া গানটাও এত মিষ্টি লাগল আমার কানে যে কি বলব! তবে মুখে বলতে ছাড়লাম না, "গানটার শব্দগুলো পাল্টে দিলেন যে বড়! 'কাঁখেতে', না 'মাঝেতে'? 'সাথী' থেকে 'ইলু' করে দিয়েছেন না হয় বুঝলাম।"

প্রোফেসর সস্নেহে বললেন, "মর্কট! তোমার দেখা যে পেয়েছি, সেই আমার কাছে বিরাট পাওয়া! ব্যাটারির মাঝে তোমায় ফেলে গেলে ফুলিকে কি জবাব দিতাম বল তো! আমার তো একটা দায়িত্ব আছে, না কি? আর হ্যাঁ, কাঁখ হচ্ছে কক্ষের চলিত ভাষা। লিথিয়াম আয়নদের কক্ষের ইলেকট্রনগুলোকে ওদের কক্ষেই ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে না?"

ততক্ষণে ইলেকট্রন-গিন্নিদের ঝাঁক দেখি চেপে ধরেছে তাদের লিথিয়াম কত্তাদের। এতক্ষণ লিথিয়ামের আয়নগুলো ঝাড়া হাত-পা ছিল। শেষ কক্ষের বৌটা এসে আবার ওদের সব আয়নীয় আরাম দিয়েছে ঘুচিয়ে। মনে মনে ভয়ানক বিরক্ত হলেও দেখি ব্যাটারা মুখে এমনভাব করে আছে যেন ঐ ইলুদের জন্য চিন্তা করে করে এরা মরেই যাচ্ছিল! ভালো করে ঠাহর করেও সেই ন্যাকা ন্যাকা লিথিয়াম আয়নটা, যার ইলুকে প্রোফেসর ফেরৎ দিতে অন্য রাস্তায় গিয়ে ফিরে এলেন, তাকে দেখতে পেলাম না। সে নিশ্চিত ফিরে পেয়েছে তার ইলুকে। নাকি পায় নি, কে জানে! আর যদি সলিড ইরেকট্রোলাইট ইন্টারফেজে সমাধিস্থ হয়ে গিয়ে থাকে? ওর সেই আদরের ইলুটা সারাজীবন কিকরে কাটাবে?

প্রোফেসর আমার চিন্তায় বাধা দিয়ে বললেন, "এই দ্যাখো, কেমন ইলেকট্রনের গুঁতোয় নিউট্রালাইজ করে দিয়েছি লিথিয়াম আয়নগুলোকে। ব্যাটারা এখন এইখেনে বসে পরমাণু হয়ে নিশ্চিন্তে ঘর-সংসার করুক, অন্ততঃ যতক্ষণ না ব্যাটারিটা কেউ চার্জিং -এ বসাচ্ছে। আসলে আমার জন্য‌ই ইলেকট্রনগুলোর আসতে দেরি হয়ে গেল, বুঝলে চন্দ্রবদন? নর্মালি, এইসব ক্ষেত্রে লিথিয়াম আয়নগুলো যেই কোবাল্টের ল্যাটিসে ঢোকে, সঙ্গে সঙ্গে বাইরের তামার সুড়ঙ্গ দিয়ে এইভাবে ইলেকট্রনগুলোও চলে আসে।"

আমি বললাম, "অত ল্যাটিস-প্যাটিস কিছু বুঝি না, কিন্তু এই লিথিয়াম আয়নটা যে বলছিল,‌ ডিসচার্জিং শেষ হয়ে চার্জিং শুরু হবে, তারপরে আপনারা আসবেন?"

প্রোফেসর হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, "তুমিও যেমন! ওর ব্যাটা ব্রেন অথবা মেমরি বলে কিছু আছে কি? ঐ তামার সুড়ঙ্গ দিয়ে আসার সময় আমার ওজনের জন্য কিছুটা টাইম-ল্যাগ হয়ে গেছে। তা সেটা এমন কিছু নয়। একটু দেরি হয়েছে কি, অমনি ব্যাটা ভেবেছে প্রোগ্রাম চেঞ্জ হয়ে গেছে, হোঃ হোঃ! সিঙ্গিগুলোর মুন্ডুতে একটুও বুদ্ধি নেই গো!"

আমি জানতে চাইলাম, "আচ্ছা, তার মানে এখনো ব্যাটারির মালিক, মানে আপনি, এই ব্যাটারিটা চার্জে বসান নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এইটা ডিসচার্জিং যদি হয়, চার্জিং-এর সময় তাহলে কি আবার লিথিয়াম পরমাণু থেকে ইলুগুলো খুলে যাবে আর সিংহের দলগুলোকে ফের উল্টোদিকে সমুদ্র-টমুদ্র পার করে গ্রাফাইটের দেশে ফিরতে হবে?"

প্রোফেসর হাততালি দিয়ে বললেন, "এক্কেবারে! ঠিক‌ই ধরেছ, মীরমদন আমার! ডিসচার্জিং থামে নি, এখনো চলছে। ব্যাটারি ডিসচার্জিং হচ্ছে মানে ব্যাটারিটা সার্কিটের যাবতীয় ঘরকন্না সেরে রাখছে। তবে যে লিথিয়াম ব্যাটারিকে 'পাতি' বলে দাগিয়ে দিচ্ছিলে বড়? অবশ্য, এই পুরনো ব্যাটারিটা আমি ইস্পেশালভাবে তৈরি করেইছি আমাদের ঢোকা-বেরুনোর জন্য, একেবারে রিয়েল-টাইম লাইভ-ব্যাটারি এক্সপিরিয়েন্স নেবার জন্য, হুঁ!"

শুনে আমার প্রবল হাসি পেল। প্রোফেসর যদি জানতেন যে একটা লিথিয়ামের আয়ন তাকে 'কিপ্টে মালিক' বলেছে, তাহলে আরো লাফালাফি করতেন। ব্যাপারটা চেপে গেলাম। আমি বললাম, "তা এবার ফেরার ব্যবস্থাটা করলে ভালো হয় না? আমার আর এদিক দিয়ে গ্রাফাইটের দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছে নেই।"

এই শুনে প্রোফেসরকে কেমন চিন্তিত দেখাল। ধীর গলায় বললেন, "ওহে চন্দ্রকান্ত, তুমি বরং বসে বসে ডায়েরির এন্ট্রিটা কম্প্লিট করে নাও। আরো কিছুক্ষণ বাকি আছে অণিমার ঘোর কাটাতে। আমিও ততক্ষণ সময়টা মেপে দেখি লিথিয়ামের নিউক্লিয়াসের লাফালাফি অবজার্ভ করে। ভুলে যেও না, সেরেফ একটু স্ট্যাটিক চার্জ নিয়ে তুমি আর আমি এখানে ঢুকেছি। বাই চান্স যদি এরা ধরে ফেলে, কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না!"

 

শুনে আমি আর দেরি করলাম না। লিথিয়াম আয়ন আর ইলেকট্রনের স্রোত যেমন দুইদিক থেকে এই অরণ্যে পৌঁছনোর তেমনি এসে পৌঁছচ্ছে। আমার 'লেখা' তাড়াতাড়ি শেষ করলাম, ঐ কোনোরকমে; যেমনটা এতক্ষণ আপনারা সবাই শুনলেন। সমুদ্রটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। প্রোফেসর বোঝালেন, ওটা নাকি সেপারেটর নামে একটা ব্যবস্থা দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছে। আমি চকচকে যে গেটে ধাক্কা খেয়ে এখানে এসে ঢুকেছি, সেটা নাকি অ্যালুমিনিয়ামের কালেক্টরি আপিসের গেট। আজব সব ব্যাপার! এইসব সাতপাঁচ ভাবার পরে প্রোফেসরকে সবে বলতে যাচ্ছি যে আরেকবার মুন্ডুটা ঘষে নিলে ভালো হত কিনা, এমনি সময় ভয়ানক গোলমাল আরম্ভ হল!

 

দশ-বিশটা মুশকো মুশকো কোবাল্ট আয়ন, যারা আমাদের ঘিরে রেখেছিল, তারা হঠাৎ কেমন গাঁকগাঁক করে চ্যাঁচাতে শুরু করেছে। মূল বক্তব্য যা বুঝলাম তা হল এই: দুইখানা নিস্তড়িৎ সুপারম্যাক্রো অণু, তারা এই আয়নিক ল্যাটিসে ইনকর্পোরেটেড হয়ে কী প্ল্যান আঁটছে? আমরা হয় সন্ত্রাসবাদী, নয় গুপ্তচর!

 

প্রোফেসর যত বোঝাতে যান যে আসলে তিনি হচ্ছেন এ ব্যাটারি ব্রহ্মাণ্ডের মালিক, তত বিষয়টা আরো জটিল হয়ে ওঠে!

একদল অক্সাইড আয়ন, যাদের কোবাল্ট আয়নগুলো এতক্ষণ এসকর্ট দিচ্ছিল, তারা বলে ওঠে, "নিজেদের কি মনে করেন? আপনি এ জগতের সৃষ্টিকর্তা? ইয়ার্কি পেয়েছেন? বিগ-ব্যাঙের পরে আমাদের পরমাণু-পিতামহের সৃষ্টি হয়েছিল, আমরা তার বংশধর হিসেবে বংশপরম্পরায় ভগবান শ্রী শ্রী তড়িৎকোষের পুজো করে আসছি, কোনোদিন চোখে দেখলাম না, আর আপনি বলতে চান আপনি ভগবানের অবতার? জালিয়াতি হচ্ছে?"

তর্ক-বিতর্ক বাড়তে থাকে। বোঝাই যাচ্ছে আপাতশান্ত ল্যাটিস-দুনিয়ার আসল বুদ্ধিজীবী এই অক্সাইডের অ্যানায়নগুলোই। কোবাল্টের আয়নগুলো আসলে ক্ষত্রিয় জাতি: শক্তিজীবী, মানে বাহুবলী আর মাথামোটা! লিথিয়াম আয়ন আর ইলেকট্রনগুলো পাতি শ্রমজীবী। ছ্যা, ছ্যা! এ তো পুরো বাইরের দুনিয়ার জেরক্স মনে হচ্ছে, বলি প্রোফেসরকে। সেই সঙ্গে ওনার কোটের কোণা ধরে টান মেরে ইশারায় কেটে পড়তে বলি। কিন্তু লাভ হয় না! নাঃ, এ বুড়ো আজ ডোবাবে! শাস্তি হিসেবে যদি আজীবন ল্যাটিসে আটকে রাখে কিংবা ইলেকট্রোলাইটের সমুদ্রে ঠেলে ফেলে দেয়, তাহলে যে কোনোদিন বাড়ি ফিরতে পারব না! ব্যাটারির মধ্যে চপ, বেগুনি, ফুলুরি, চাউমিন, জিবেগজা, বিরিয়ানি, মোগলাই, রাবড়ি, কিছুই পাওয়া যাবে না। কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফ, তোপচাঁচির লেক, আইপিএল, বিশ্বকাপ ফুটবল, অ্যাঁ! ফুটবল বিশ্বকাপ দেখা আর হবে না এ জন্মে! আমি হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। আর আমার আদরের ফুলি, আমার একখানা মাত্তর বৌ, হোক না ঝগড়ুটে, তাকেও কোনোদিন আর দেখতে পাব না, ভ্যাঁ! এই ব্যাটারি, তার আবার এই ল্যাটিস, এখান থেকে ডাকলে ফুলি কি শুনতে পাবে? আর আগাপিছু না ভেবেই ডাকতে শুরু করি, ফুলি! ফুলি গো!!! তুমি শুনতে পাচ্ছ? আমি এই ব্যাটারির মধ্যে ব্যাটা বুড়ো প্রোফেসরের পাল্লায় পড়ে সিংহের গুহায় কোবাল্টের ল্যাটিসে ল্যাটপ্যাট করছি!!!

প্রোফেসর চুলোয় যান, আমায় তো বাড়ি ফিরতে হবে! তাকিয়ে দেখি বুড়ো কি একটা বলার চেষ্টা করছে। আমি প্রবল রাগে আর উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে হাত পা ছুঁড়ছি? "কতক্ষণ, আর কতক্ষণ লাগবে আপনার 'অণিমা' কাটতে, অ্যাঁ?" চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি তাঁকে।

প্রোফেসরের মুখটা কেমন ঘুরতে ঘুরতে আবছা হয়ে মিলিয়ে যায়। অন্যরকম দেখতে কে একজন আমার মুখের উপর ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, "কী যা তা বলে চলেছ? অণিমা? কে অণিমা! আর ভরদুপুরবেলায় আমার নাম অতজোরে ডাকছ‌ই বা কেন? পাড়ার লোকে শুনলে তো ভাববে আমি তোমাকে ধরে পেটাচ্ছি! কী বেয়াক্কেলে লোক রে বাবা!!"

একি! এ যে ফুলি! ফুলি ল্যাটিসের মধ্যে কি করছে? ল্যাটিসে…তাহলে কি ওকেও...ঘোর ভেঙে যায় যেন আমার! তড়াক্ করে উঠে দেখি, হায় রাম! খাটের উপর শুয়ে এতক্ষণ তাহলে কি খোয়াব দেখছিলাম? দিবাস্বপ্ন? প্রোফেসর কোথায়? কোথায় ব্যাটারি!

ফুলি আমায় জাগিয়ে তুলে ফের রান্নাঘরে ফিরে গেছে টুকিটাকি কী সব কাজ করতে। আমি হতভম্ব হয়ে বিছানায় উঠে বসে ভাবছিলাম, ব্যাপারখানা হল কি! প্রোফেসরের ঘরে বসে কুমড়োপাতার চা পান করতে করতে অণিমা খেয়ে আকার ছোট হয়ে গেছিল। তারপর ব্যাটারিতে ঢুকে কত কাণ্ড হল। তাহলে সেখান থেকে নিজের বাড়িতে ফিরলাম কিভাবে! আরো কিছু ভাবতাম, কিন্তু এই সময় ফোনটা বেজে উঠে ভাবনার জালটা ছিঁড়ে ফেলল।

 

---হে হে! মীরমদন আমার! চা খেয়ে যে চোখ উল্টে মুচ্ছো গেছিলে বড়, এখন শরীর কেমন? তোমায় একটা ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলাম, ঘুম হয়েছিল?

প্রোফেসরের গলা। আমি বলতে গেলে দেখলাম জিভ এখনো আড়ষ্ট আমার। অতিকষ্টে ঐভাবেই বললাম, "আজ্ঞে, এখন তো ভালোই আছি বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু ঐ ব্যাটারি আর অণিমা…"

---অ্যাঁ? কি বললে? আজকাল থটরিডিং করতে পার নাকি? আমি 'অণিমা' নিয়ে গবেষণা করছি, তোমাকে কে বললে?

---তা আপনিই হয়ত কোনো সময় মুখ ফস্কে…

---নেভার! ডক্টর নাড়ু মিত্তিরের স্মৃতিশক্তি অত দুর্বল নয়! যাক গে, তোমার কাছে আমার একটা অ্যাপোলজি চাইবার ছিল।

---সে কি! কী যে বলেন!

---না, না, কী যে বলি নয়। সেদিন খুব বড়াই করে তোমায় কুমড়োপাতার চা বলে যেটা খাইয়েছিলাম, সেটায় গামা-অ্যামিনো বিউটাইরিক অ্যাসিডের মাত্রাটা ঠিক কন্ট্রোলে আনতে পারিনি বলে এই বিপত্তি। আসলে খুব কম অক্সিজেনে কায়দা মেরে কুমড়োগাছটা বড় করতে গিয়ে এই কাণ্ড ঘটেছে। পাতায় স্ট্রেস কেমিক্যাল হিসেবে গাবা সিনথেসিস করেছে কিনা! তারপর তুমি মুচ্ছো গেলে তোমার ভর মেপে কতটা ডোজ নিরাপদে দেয়া যায় হিসেব করে নিয়েছি, চিন্তা নেই। ভজুয়া আর রামু তোমায় ধরে চ্যাংদোলা করে তোমার বাড়ি তোমার ফুলির জিম্মায় পৌঁছে দিয়ে এসেছে। হেঁ হেঁ, ফুলিকে আমার আশীর্বাদ দিও। পারো তো আজ সন্ধ্যায় এসো দুটিতে। চায়ের নেমন্তন্ন র‌ইল, কেমন? হ্যাঁ, রাখি তাহলে।

ফোনটা রেখে থম মেরে র‌ইলাম কিছুক্ষণ। সিংহের গুহা আমি দেখিয়াছি, সেবিতে চাহি না আর কুমড়োর চা! বাপ রে! সকালে ঐ চা খেয়ে একবার ব্যাটারি-ব্রহ্ম দর্শন হয়ে গেছে, ভুলেও আর কেউ বুড়োর বাড়ি গিয়ে কুমড়োর চা খায়, ভুলেও? আমি যাচ্ছি না, ফুলিকেও কিচ্ছু ভাঙব না। সাহস থাকলে আপনারা যেতে পারেন। কিন্তু ফেরার দায়িত্ব আমি নিতে রাজি ন‌‌ই, এই বলে রাখলাম, হ্যাঁ!

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb