আর্কসমেডোমাই

লেখক - চন্দ্রানী ভট্টাচার্য

সিসিলি দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আইওনিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এক উপকূল নগরী বা পলিস সিরাকিউজ। গ্রিসের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ বা নগর-রাষ্ট্র গুলিকে পলিস বলা হয়। সিরাকিউজ এমনই এক ধনী, সমৃদ্ধ, ক্ষমতাশালী পলিস। এখানকার অর্থনীতি কৃষি এবং বাণিজ্য নির্ভর। শাসন ব্যবস্থার কাঠামোটি অভিজাততান্ত্রিক। করদাতা নাগরিকগণ শাসনকার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। যদিও পলিসের সংখ্যা গরিষ্ঠ নারী, ক্রীতদাস এবং বিদেশিদের কোনো নাগরিক অধিকার নেই।


খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে চতুর্থ শতক গ্রিসের ইতিহাসে 'ধ্রুপদি যুগ' বা 'ক্ল্যাসিক্যাল এজ' নামে পরিচিত। এই যুগে পলিসগুলি চূড়ান্ত ও পরিণত রূপ লাভ করে। গ্রিস, এশিয়া মাইনর, ইজিয়ান সাগরের দ্বীপ সমূহ প্রভৃতি অঞ্চলে এরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্রের সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। এদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল এথেন্স, স্পার্টা, করিন্থ, থিবস, ইরিথ্রিয়া, আরগস, সিরাকিউজ।  প্রাচীন গ্রিসের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা এই পলিস প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণ ছিল। সাগর ও পাহাড়পর্বত দ্বারা বিচ্ছিন্ন থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। এই পরিস্থিতিতে বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে এক একটি স্বাধীন ও স্বশাসিত পলিস গড়ে ওঠে।


সিরাকিউজ অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক-সাংস্কৃতিক সবদিক থেকেই প্রায় এথেন্সের সমগোত্রীয়। আজ রবিবার অভিজাত শাসক বা সেনেটরগণ একত্রিত হয়েছেন ডোরিকের আ্যপেলোর মন্দিরে সূর্য বন্দনার উদ্দেশ্যে। এই বন্দনার উদ্দেশ্য বিশেষ। কারণ সকলের প্রিয় ফিডিয়াস পিতা হতে চলেছেন। গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এই কাজপাগল মানুষটি  ভুলেই বসেছিলেন প্রায়  আটমাস অতিক্রান্ত হতে চললেও এখনও অনাগত সন্তানের সুস্থভাবে ভূমিষ্ঠ হবার জন্য কোনো প্রাথর্না করেননি। তাই বন্ধুরাই আজ একপ্রকার জোর করেই তাকে মন্দিরে নিয়ে এসেছেন।


ফিডিয়াসের অবশ্য প্রাথর্নায় মন নেই। তার চোখ অনুসন্ধান করে চলেছে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠশতকে ডোরিয়ান শৈলীতে কাঠ ও পাথরের দ্বারা নির্মিত অপূর্ব সুন্দর, সুবিশাল মন্দিরটির প্রযুক্তিরহস্য। ছ'টি স্তম্ভের উপর সরলরেখাকৃত বিম, তার উপর বৃত্তাকার ছাদ অবস্থিত। এইসবই তার মাথায় একের পর এক জ্যামিতিক-গাণিতিক ছক ও হিসাব এঁকে চলেছে।


-" কিরিওস (প্রভু)" ----


প্রাথর্নায় রত উপস্থিত সকলেই সম্বোধন শুনে পিছনে ঘুরে তাকান। দেখেন  ফিডিয়াসের গৃহে কর্মরত এক ক্রীতদাস মাথানত করে দাঁড়িয়ে আছে।


যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচারে দক্ষ কিন্তু সামাজিক ও সাংসারিক বিষয়ে চূড়ান্ত অদক্ষ ফিডিয়াসের মুখে পলকে নেমে আসে অন্ধকার। তার মনে এখন চলছে দোলাচল। বুকের ভিতর যেন হাতুড়ি পেটার শব্দ।


- "এমন অসময়ে মন্দিরে কেন হেলট? তাহলে কি কোন দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে? নিশ্চয়ই তাই। যদি তাই না হবে, তাহলে গৃহে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত অপেক্ষা করা গেল না কেন?" নিজের মনেই এই প্রশ্নগুলো তার তোলপাড় করতে থাকে।


-"কি সংবাদ নিয়ে এসেছ হেলট?" প্রশ্ন করেন ফিডিয়াসের পরমসুহৃদ সেনেটর ডাইরণ।


-" কিরিওস (প্রভু), কিরিয়া ফিডিয়াস (প্রভু পত্নী শ্রীমতী ফিডিয়াস) একটি স্বাস্থ্যবান, চাঁদেরপানা পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন।"


খবরটি পেয়ে উপস্থিত সকলেই উছ্বসিত হয়ে অভিনন্দন জানাতে থাকেন সদ্য পিতা ফিডিয়াসকে। আর ফিডিয়াসের মাথা দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ লেগে পড়ে সন্তানের জন্ম কোন গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানে হলো তার হিসাবনিকাসে।


বন্ধু ডাইরণ কাঁধে হাত রেখে জানতে চান, " তা পুত্রের নাম কি রাখবে ঠিক করলে?"


-"কিরিওস টিস স্কেপসিস (মাস্টার অফ থট/ মাস্টার অফ প্ল্যানার্) । "


ডাইরণ অবাক হয়ে ভাবতে থাকেন, "কেন! এর মানে কি?"


আর ফিডিয়াস মুচকি হেসে মনে মনে বলেন, "ব্যাটার ছেলে জন্মেই আমাকে ঘোল খাইয়েছে। সময়ের হিসাবকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে সুস্থভাবে পৃথিবীর আলো দেখেছে। ওর চিন্তার সাথে পাল্লা দেবে কে! তাই তো ওর নাম রাখব আর্কসমেডোমাই। আর্কিমিডিস।

--------------------


-"আ্যগরিইইই (খোকা / ছেলে) ..... ", "আ্যগরিইইই......" কোথায় তুই? আয় বাবা, এবার তো খেতে আয়। বেলা যে পড়ে এলো। কিরিয়া ফিডিয়াসের অস্থির দৃষ্টি চারিদিকে খুঁজে বেড়ায় পুত্রকে। তারা স্বামীর বন্ধুবান্ধবদের পরিবারের সঙ্গে দল বেঁধে সপ্তাহান্তিক ছুটি কাটাতে এসেছেন আরেথুসায়। ঝর্ণার কলকল শব্দ, পাখিদের কলকাকলি, রঙিন প্রজাপতি ও ঘাস ফড়িংদের ওড়াউড়ি এমন এক নৈসর্গিক পরিবেশ রচনা করে এখানে, যে বারংবার এর টানে ছুটে আসতে হয়।


দলের পাঁচ থেকে দশ বছরের বালক-বালিকারা দলবদ্ধ হয়ে নিজেদের মধ্যে খেলাধুলা, গল্পে মত্ত। একমাত্র উপস্থিত নেই ছ'বছরের আর্কিমিডিস। একে তো আপনভোলা, জগৎসংসার সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন স্বামীকে নিয়ে তার বিপদের শেষ ছিল না। এখন আবার পুত্রকে নিয়েও দুঃশ্চিন্তার অন্ত নেই। পুত্র যেন পিতার প্রতিবিম্ব। ছেলেটা এই বয়সেই গণিতের প্রেমে এমন মজেছে যে খেতে ভুলে যায়। স্নান করতে গিয়ে তেল বা জল, যা হাতের কাছে পায় অঙ্কের জটিল হিসাব মেলাতে বসে যায়। এমনকি বালি, মাটি, ছাই কোনো উপাদানই নিস্তার পায়না তার জ্যামিতিক নক্সা বা গণিতের আকিবুঁকির হাত থেকে। এমন অপনভোলা ছেলেকে সবসময় নজরে রাখতে হয়। মায়ের মন সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে, এই বুঝি মনের খেয়ালে আগুনে হাত দিল বা জলে পড়ল। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে মাতৃ হৃদয় থেকে।


পায়ে পায়ে এসে পৌঁছান ঝর্ণার কাছে। দেখেন অত্যন্ত বিপদজনকভাবে একটি প্রস্তুরখণ্ডের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে জলপ্রপাতের খাদের গভীরে ঝুঁকে পড়েছে আর্কিমিডিস। ভয়ে বুকটা ধড়াস করে ওঠে তার। চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে যান পুত্রের দিকে। কিছু বুঝতে না দিয়ে পিছিনদিক থেকে জাপটে ধরে নামিয়ে আনেন। ভয়ে-ক্রোধে আত্মহারা হয়ে ছেলেকে বকুনি দিতে যেতেই, মা-কে জড়িয়ে ধরে বুদ্ধিদীপ্ত, জিজ্ঞাসু চোখদুটো তুলে আর্কিমিডিস প্রশ্ন করে, "মা, জলে ঝরা পাতা, গাছের ডাল ভেসে থাকতে পারছে, কিন্তু প্রস্তর খণ্ডগুলো ডুবে যাচ্ছে কেন?"


-"বাঃ! খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছ বাবা। সত্যি বিষয়টা একটু ভেবে দেখতে হচ্ছে।" বলতে বলতে তাদের পিছনদিক থেকে এগিয়ে আসেন ফিডিয়াস। স্ত্রী, পুত্রকে দেখতে না পেয়ে তাদের সন্ধানে এখানে এসে পড়েছেন। শ্রীমতী দেখেন পুত্র গর্বে গর্বিত এক পিতা, আদর করে কোলে তুলে নিচ্ছেন প্রিয় পুত্রকে। তারপর দুজনে গণিতের জটিল সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। আলোচনা শুনে কে বলবে দুজন অসমবয়সি! এছাড়া তিনি যে সেখানে উপস্থিত আছেন, সেই কথাটাও তাদের কারোরই মনে নেই। শ্রীমতী জানেন বেশিদিন পুত্রকে নিজের কাছে ধরে রাখতে পারবেন না। কারণ স্বামীর ইচ্ছা মহান শিক্ষাকেন্দ্র আলেকজন্দ্রিয়া থেকে পুত্র তার শিক্ষা সম্পূর্ণ করে ফিরে আসুক। স্বামীকে কয়েকবার বলার চেষ্টা করেছেন, "আর্কিমিডিস এখন খুব ছোটো। আর একটু বড় হতে দিন। তারপর না হয়..."


না শেষ করতে পারেননি কথা। তার আগেই স্বামী বলে উঠেছেন, "গিন্নী ওর শরীরের বয়স দেখোনা, মস্তিষ্কের বয়েস দেখ। ওকে এখন থেকেই প্রস্তুত করতে হবে।"


সন্তানের মঙ্গলের কথা ভেবে, তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আর বাঁধা দিতে পারেননি। আলেকজান্দ্রিয়ায়, যে কেউ ইচ্ছে করলেই শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়না। মেধার সাথে সাথে আর্থিক সঙ্গতিরও প্রয়োজন হয়। আ্যপোলো দেব যখন তার পুত্রের প্রতি সদয় তখন  তিনি আর কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবেন না।

-------------------------

-"ক্রীতদাস, মহিলা আর বিদেশিদের যেমন নাগরিক অধিকার নেই তেমনি উপস্ত্রীজাত সন্তান কখনোই শাসন ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হতে পারে না।"


-"পারে না। পারে না।" সম্মিলিত কণ্ঠের প্রতিবাদ আছড়ে পড়ে।


-"এরপর থেকে তো পলিসের সকল অভিজাতদের বিজনিত সন্তান আমাদের শাসক হয়ে মাথার উপর বসতে চাইবে।"


          এইরকম অজস্র কটূক্তি, ব্যঙ্গোক্তি, হাসির বিষাক্ত প্রতিধ্বনি ভেসে আসতে থাকে কত কালের ব্যবধান পেরিয়ে সিরাকিউজের বৃদ্ধ শাসক দ্বিতীয় হাইরণের  কানে, বিলাসবহুল প্রাসাদের নির্জন কক্ষে। না একদম নির্জন নয়। প্রহরীদের কড়া নজরদারি আছে। তবুও আজ যেন একাকীত্ব তাকে প্রবলভাবে গ্রাস করছে।


-"এবারে শীতটা একটু বেশি মনে হচ্ছে। নাকি আমারই বয়সের ভারে জীর্ণ শরীরের ক্লান্তি! যা জানান দিচ্ছে পাতা ঝরার সময় হয়ে এলো। আকাশে মেঘ ঘনীভূত। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হবে। একে শীতকাল, তারউপর বৃষ্টি! অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই ভূমধ্য সাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যই এই।" নিজের মনেই হেসে ওঠেন হাইরণ। আজ যেন মনের অতল অন্ধকারে জমাট বাঁধা শ্যাওলা ধরা থক থকে, ক্লেদাক্ত স্মৃতিগুলো বড় বিড়ম্বিত করছে।


৩০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, এই দীর্ঘ সময়ের ব্যাবধানেও এতটুকু নিরাময় হয়নি সেইসব পুরোনো ক্ষত। শুধু ক্ষতমুখটা সাফল্যের ঝকমকে লাল কার্পেটের তলায় চাপা পড়ে ছিল। আজকে  বিরানব্বই বছরে পদার্পণ করেও সেইসব ব্যাথায় নীল স্মৃতির বাষ্প, তার ছানি পড়া চোখে বড় জ্বালার সৃষ্টি করছে। জীবনারম্ভের প্রথম তিন বছর বাদ দিলে জ্ঞান হওয়া ইস্তক তাকে শুনে আসতে হয়েছে, 'তিস আ্যগরি,' 'বেজন্মার বাচ্চা।'


সম্ভ্রান্ত, ক্ষমতাবান অত্যাচারী হিরোক্লিসের ব্যভিচারিতার হাজার একটা নিদর্শনের মধ্যে তিনি একটি। না এরজন্য আজ আর কোনো আক্ষেপ করেন না। যে পুরুষ ক্ষমতাবান তার পৌরুষ প্রমাণের সহজতম উপায় নারী। আর যেখানে সুন্দরী ক্রীতদাসীর অভাব নেই, সেখানে লাম্পট্য অতি সাধারণ বিষয়। নিজের মা-কে তার ঠিকমতো মনে পড়ে না। তবে না পড়াই ভালো। কারণ তিনি ভুলে যেতে চান নিজের জন্মবৃত্তান্ত। শুধুমাত্র মনে রাখতে চান ক্ষমতার দুর্দমনীয় প্রকাশ। এই পঞ্চাশ বছরে তার রাজত্বকালে সিরাকিউজের চরম বিকাশ। মানব ইতিহাস তাকে শ্রেষ্ঠ শাসক বলে মনে রাখতে বাধ্য হবে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এসেছেন প্রাচীন গ্রিক প্রবাদ, 'ও আ্যনথ্রোপোস ক্যানেইতি দিকি তু পেরিউসিয়া,' অর্থাৎ পুরুষ নিজের ভাগ্য স্বহস্তে নির্মাণ করে। তাইতো  অসংখ্য বৈধ এবং  নাম না জানা অবৈধ সন্তানদের মধ্যে থেকে একমাত্র তিনিই সিরাকিউজের শাসক রূপে নির্বাচিত হয়েছিলেন। অনেক বঞ্চনা, অপমানের গ্লানি পেরিয়ে তবে সিরাকিউজের সর্বময় কর্তা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।


সেই কবে থেকে পলিসগুলি নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে শক্তি ব্যয় করত। তবে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে রোমের উত্থান এই পলিস গুলির নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছিল। তখন পলিসগুলি জোটবদ্ধভাবে রোমের আক্রমণ প্রতিহত করতে সচেষ্টা হয়।


হাইরণ এমনসব একাধিক যুদ্ধে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে ২৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একজন সাধারণ সৈনিক থেকে এপিরাসের প্রাক্তন সেনাপতি নির্বাচিত হন। তারপর ২৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম পিউনিকের যুদ্ধে জয়লাভ করে জনগণ দ্বারা তাদের রাজা হিসাবে মনোনীত হন।


এরপর ধীরে ধীরে বুদ্ধি ও দূরদৃষ্টির জাল বিস্তার করে প্রভাবশালী অভিজাত এবং সেনাপতি লেপটাইন্সের কন্যা ফিলিস্টিসকে বিবাহ করে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। সকল অভিজাত সম্প্রদায়কে নিজের পক্ষে আনেন। তবে সময় অপ্রতিরোধ্য। কালের নিয়মে তাকে ক্ষমতা ছাড়তেই হত। সিংহাসন যোগ্য ব্যক্তির হাতে অর্পণ করতে হত। কিন্তু অপুত্রক হাইরণ দুই কন্যার পিতা। সোপিয়াস এবং আন্দ্রানোডোরাস তার দুই জামাতা। দুজনেই উচ্চাকাঙ্খী, ক্ষমতালোভী হিংস্র শার্দূলের মত। তাদের কোনো একজনকে সিংহাসনে বসালে অন্যজন ক্ষুণ্ণ হবে। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দেখা দেবে। হয়ত রোমের হাতে সিরাকিউজকে তুলে দিতেও তাদের বাঁধবে না। তাই তো সবদিক বিবেচনা করে পনেরো বছরের একমাত্র পৌত্র হাইরোনিমাসকে সিংহাসনে বসালেন। নাতির দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত হয়েই পনেরজন সদস্যের অভিভাবক দল বা কাউন্সিলর নিযুক্ত করলেন। এমনকি দুই জামাতাকেও এই দলে নিযুক্ত করে সিংহসনকে নিষ্কণ্ট, নিরাপদ করতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, "এবার নিশ্চিন্তে চোখ বুঝব।"  কিন্তু এখন বারবার মনে হচ্ছে সিরাকিউজকে নিরাপদ রাখতে তিনি  ব্যর্থ।


গুপ্তচর সংবাদ নিয়ে এসেছে রোম, এথেন্স আক্রমণের পূর্বে সিরাকিউজ দখল করে রসদ সংগ্রহ করার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলেছে। একেই কি বলে নিয়তি! এতদিন রোমের সঙ্গে শক্তির যে ভারসাম্য তিনি রক্ষা করে চলছিলেন তা নষ্ট হয়ে গেল হাইরোনিমাসের অবিবেচকের মত রোমের বিরুদ্ধে কার্থেজের পক্ষ অবলম্বন করায়। যদিও একথা তিনি জানেন, এক্ষেত্রে হাইরোনিমাস, জামাতা আন্দ্রানোডোরাসের হাতের পুতুল মাত্র। আন্দ্রানোডোরাসের পরামর্শেই পুরো বিষয়টা তার কাছ থেকে গোপন করা হয়েছিল।


তিনি পরে জ্ঞাত হয়েছেন, জেনারেল হ্যানিবলের নেতৃত্বে কার্থাজিনিয়ানরা এবং তাদের সহযোগীরা সুবৃহৎ রোমান ও ইতালীয় বাহিনীকে ঘিরে ফেলে কার্যত ধ্বংস করে দেয়। রোম এই ন্যক্কারজনক পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই নিজের সমস্ত শক্তি নিয়ে এবার সিরাকিউজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছে।  আজ তিনি বৃদ্ধ। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তবুও শেষ চেষ্টা করবেন।


রক্ষিকে নির্দেশ দেন, "এক্ষুণি আর্কিমিডিসকে জরুরী তলব দাও।"


হাইরণ স্মৃতির অবগাহনে ব্যাপৃত হন।

------------------

প্রবল বর্ষণে বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজ গুলোর খোলে জল থৈ থৈ অবস্থা। অসংখ্য ক্রীতদাস দিনরাত জল সেচেও জাহাজের খোল জলশূন্য করতে ব্যর্থ। রাজা হাইরণের মাথায় হাত। সমগ্র সিরাকিউজ জুড়ে  চাপা দুশ্চিন্তা। জাহাজগুলো শুকনো করতে না পারলে সমূহ বিপদ। সমুদ্রপথে নির্দিষ্ট দিনে বাণিজ্যের জন্য যাত্রা করা যাবে না। বণিক-ব্যবসায়ীদের প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। রাজার কোষাগারে রাজস্ব জমা পড়বে না। প্রতিরক্ষাখাতে বরাদ্দ অর্থ মঞ্জুর করা যাবে না। অর্থাৎ এই জল নিষ্কাশন করা না গেলে সিরাকিউজের ভবিষ্যত অন্ধকার।


ঠিক সেই সময় বিপদতাড়ণ হয়ে বন্ধু এবং সভাসদ ফিডিয়াস সামনে এসে উপস্থিত হন।


-"রাজামশাই, আমার পুত্র আর্কিমিডিস। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে এই সবে পড়াশুনা শেষ করে ফিরেছে। ও আপনাকে কিছু বলতে চায়।" সম্মান প্রদর্শন, অভিবাদন জ্ঞাপন করে বলেছিলেন ফিডিয়াস।


হাইরণ দেখেছিলেন একটি একুশ-বাইশ বছরের লম্বা, ফর্সা, রোগা লাজুক ছেলে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি কথা বলতে কি ফিডিয়াসের উপর রাগই হয়েছিল। এমন বিপদের সময় ফিডিয়াস পাগলামো করতে এসেছে ভেবে। কারণ তিনি এই গণিতজ্ঞের উদ্ভট সব কান্ডকারখানা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তাই বিরক্ত হয়ে ব্যাঙ্গ করেই বলেছিলেন, "এখনো নাক টিপলে যার দুধ বেরোবে,  সে কিনা করবে এতবড় সমস্যার সমাধান! তোমার মাথাটা দেখছি একেবারে গেছে। সন্তান স্নেহ তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে।"


-"রাজামশাই আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন।"


যুবকটির চোখের দীপ্তি, কণ্ঠের দৃঢ়তা চমকে দিয়েছিল  বহুদর্শী, অভিজ্ঞ শাসককে। হ্যাঁ তিনি দিয়েছিলেন অনুমতি। বাকিটা ইতিহাস। এখোনো এই ঘরে বসে তিনি স্পষ্ট দেখতে পান সেদিনের কর্মকান্ড।


আর্কিমিডিস একটি ফাঁপা নল নিয়ে তার এক প্রান্তে একটি হাতল লাগলো। নলের অন্যপ্রান্তে ভিতরের দিকে নির্দিষ্ট বিন্দুতে একটি সর্পিল কিলক বা স্ক্রু আকৃতির পৃষ্ঠ বাঁক লাগিয়ে তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বা পেঁচিয়ে জল নিষ্কাশন করার ব্যবস্থা করে। প্রথমে রাজা সাইরণ তার এইসব উদ্ভট কার্যকলাপে ক্ষেপে উঠেছিলেন। আর্কিমিডিস তাকে অঙ্ক কোষে, নির্দিষ্ট সূত্র ধরে বোঝাতে চেয়েছিল বিষয়টা। তা সেই অঙ্ক বোঝার ধৈর্য্য বা মানসিকতা তখন তার ছিল না। উপরন্তু তার পাত্র-মিত্ররা আর্কিমিডিসের কান্ডকারখানা নিয়ে রীতিমতো হাসাহাসি শুরু করেছিল। হাইরণ ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "এইভাবে ফাঁপা নলের সাহায্যে তুমি জাহাজের খোল থেকে জল বের করবে?"


আর্কিমিডিস চোখে চোখ রেখে বলেছিল, "অধিকাংশ ব্যক্তি প্রকৃত সত্য আবিষ্কারের কষ্ট স্বীকার করতে বা ধৈর্য ধারণ করতে চাননা। লোকে যা বলে তাকেই সত্য ভেবে নিয়ে শান্তি পেতে চায়। আপনিও কি সেই দলে নাম লেখাতে চান?  না কী একটু সময় নিয়ে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত দেখতে চান?" সেদিন ছেলেটির আত্মবিশ্বাসকে ঔদ্ধত্য ভেবে ভুল করতেই পারতেন, কিন্তু করেননি। কারণ আর্কিমিডিসের আত্মবিশ্বাসে কোনো খাদ ছিলনা। আর তাই শেষ দেখার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন।


হ্যাঁ, সেদিন সেই অতিসাধারণ দেখতে ছেলেটা চমৎকার ঘটিয়েছিল। আশু বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল সিরাকিউজবাসিদের।


রাজা সাইরণ আর্কিমিডিসকে জড়িয়ে ধরে সেই জল নিষ্কাশন যন্ত্রের নামকরণ করেছিলেন 'আর্কিমিডিস স্ক্রু পাম্প।' এরপর থেকে সিরাকিউজ সহ অন্যান্য পলিসেও ব্যাপকভাবে বর্জ্য জল শোধনাগারে এবং নিচু অঞ্চলে জল নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে এই যন্ত্র। রাজা সাইরণ বিশ্বাস করেন পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন এই 'আর্কিমিডিস স্ক্রু পাম্প'-ও থাকবে।

-----------------

সাইরণ বাতায়ন পথে তাকিয়ে দেখলেন বৃষ্টি নেমেছে। কনকনে শীতল বাতাস তার বৃদ্ধহাড়ে প্রবল কাঁপন ধরিয়েছে। বেশ বুঝতে পারছেন এই শীতলতা আসলে চিরকালীন শীতঘুমের ইঙ্গিত। আর বেশি সময় নেই। দু'বছর পূর্বেই আর্কিমিডিসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, নগরের সুরক্ষা নিশ্ছিদ্র করার। সেদিনের নব্য যুবক আর্কিমিডিস আজ সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ। তবে তার আবিষ্কারের নেশা, অঙ্ক, ভৌতবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে উন্মাদনায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। সমগ্র সিরাকিউজ এই আত্মভোলা গণিতবিদকে নিয়ে গর্বিত। তারা নিশ্চিত আর্কিমিডিস থাকতে কেউ কোনোদিন সিরাকিউজ দখল করতে পারবে না। এই বিশ্বাস রাজা সাইরণেরও। কাঁপা কাঁপা শিরাবহুল শীর্ণ হস্তে গায়ের চাদরটা টেনে নিতে নিতে নিজের মনেই বলেন, "আজ আমি সকলের কাছে অপ্রয়োজনীয় হলেও, আমার জন্মভূমির নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। আমার অবর্তমানে যদি কেউ নিঃস্বার্থভাবে সিরাকিউজের কথা ভাবে, সে আর্কিমিডিস। তাকে আমি নিজে সেই দায়িত্ব অর্পণ করে যাব।"


রাজার ঠোঁটের কোণে এমন সময় মৃদু একটু হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যায়। ফিরে যান প্রথম পিউনিকের যুদ্ধের বেশ কয়েকবছর পরবর্তী সময়।

----------------------

'তিস'--এই গালি শুনতে শুনতে যে বাচ্চাটা যৌবনে পদার্পণ করেছিল সে সর্বান্তকরণে চেয়েছিল নিজেকে সিরাকিউজবাসিদের নিকট সর্বোচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে। ঈশ্বর বা বিধিলিপি কোনটাতেই তেমনভাবে বিশ্বাস করেননি কখনো । তবে শাসনক্ষমতায় এসে প্রজাদের সম্মুখে নিজের ভাবমূর্তি পরিষ্কার রাখতে এবং তাদের প্রভাবিত করতে নিজের ভক্তি প্রদর্শন জরুরী হয়ে উঠেছিল। তাই দেবতা আ্যপোলোকে উৎসর্গ করার জন্য পবিত্র লরেল গাছের পাতার আকৃতির একটি স্বর্ণমুকুট নির্মাণ করতে দেন স্বর্ণকারকে।


ইতিমধ্যে রাজা সাইরণের মন খুব খারাপ। মেজাজ সপ্তমে। শাসনকার্য, সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধান কোনোদিকেই তার নজর নেই। সভাসদ, পাত্র-মিত্র, মন্ত্রী-সান্ত্রী সকলেই তটস্থ। কারণ তার ইচ্ছায় আজ একবছরেরও বেশি সময় ধরে শতাধিক শ্রমিক কঠোর পরিশ্রম করে নির্মাণ করেছে এক প্রমোদতরী। নাম রেখেছেন 'সাইরেকুইসিয়া।'


সাইরেকুইসিয়ার জন্য মাউন্ট এটেনা থেকে ফার, পাইন গাছের কাঠ, স্পেন থেকে দড়ি, ফ্রান্স থেকে পিচ এসেছে। অন্দরসজ্জায় রাজকোষের মনিমুক্তর ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছেন। সাধারণ যুদ্ধজাহাজের থেকে পঞ্চাশগুণ বড় এই তরীতে আছে আটটি নজর ঘাঁটি (ওয়াচ টাওয়ার )। যাত্রীদের সুখসুবিধার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা এতে করা হয়েছে। এমনকি দীর্ঘদিন জলপথে যাত্রার উপযোগী রসদ সঞ্চয়ের জন্য ভাঁড়ার বিশাল। এছাড়াও জলদস্যুদের হাত থেকে সুরক্ষার জন্য ছয়শত সৈনিক পোতে উপস্থিত থাকবে। হাইরণের আন্তরিক বাসনা পৃথিবীতে এই প্রথম এমন প্রমোদতরী জলে ভাসুক। তিনি ইতিমধ্যে বন্ধু, মিশরের সম্রাট টলেমি আই সোটাকে এই অত্যাশ্চর্য উপহার প্রেরণের বার্তাও পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এখন সমস্যা অন্য। এই নির্মাণে যুক্ত সমস্ত প্রযুক্তিবিদ, কারীগরবিদরা বুঝতে পারছেনা না কিভাবে এই পর্বত প্রমাণ জাহাজকে জলে ভাসাবেন! এমন স্পর্ধার মুখে যে তাদের পড়তে হবে, কেউ ভাবেননি।


এইরকম বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে রাজসভার দৈনন্দিন কার্যচলাকালীন স্বর্ণকার অপূর্ব সুন্দর মুকুটটি নিয়ে এসে হাজির হয়েছিল। উপস্থিত সকলে উছ্বসিত প্রশংসা করলেও রাজা হাইরণ মুকুটটি হাতে নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, যে পরিমাণ সোনা রাজভান্ডার থেকে প্রদান করা হয়েছে, সেই পরিমাণ সোনা এতে নেই। ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। যাই করতে যাচ্ছেন, তাতেই বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। এক সামান্য স্বর্ণকারও তাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে! এইভাবে নিজের ভাবমূর্তি তিনি ক্ষুণ্ন হতে দিতে পারেন না।


নানান পদ্ধতি অবলম্বন করেও মুকুটে প্রকৃত সোনার পরিমাণ জানা গেল না। তখন আবার ডাক পড়েছিল আর্কিমিডিসের। হাইরণ নির্দেশ দিয়েছিলেন মুকুটটিকে না ভেঙ্গে তাতে প্রকৃত সোনার পরিমাণ নির্ধারণ করার।


নিজের শয্যায় শুয়ে এবার বেশ জোরেই হেসে উঠলেন বৃদ্ধ রাজা। যেন চোখের সামনে তিনি দেখতে পাচ্ছেন সম্পূর্ণ নগ্ন আর্কিমিডিসকে।


হ্যাঁ সেদিন, "ইউরেকা, ইউরেকা" --বলে চিৎকার করতে করতে প্রবেশ করেছিল সম্পূর্ণ উলঙ্গ আর্কিমিডিস। বোঝাই যাচ্ছিল স্নানাগার থেকে আর্দ্র অবস্থায় সে দৌড় দিয়েছে। কোনদিকে হুঁশ ছিল না তার। মুখমণ্ডল যেন হাজার আলোর ঝাড়বাতিতে উজ্জ্বল। হাইরণ সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। উপস্থিত অন্যসকলের মতোই নির্বাক ছিলেন তিনিও। কি বলবেন? কি করবেন এই উন্মাদকে নিয়ে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। না তাকে কিছু বলতে হয়নি। বলেছিল আর্কিমিডিস।

-"মান্যবর, কোনো বস্তুকে স্থির তরল বা বায়বীয় পদার্থে নিমজ্জিত করলে বস্তুটি যে ওজন হারায়, তা বস্তু কর্তৃক অপসারিত তরল বা বায়বীয় ওজনের সমান। অর্থাৎ মুকুটটিকে না ভেঙ্গেই ওর মধ্যে প্রকৃত সোনা এবং খাদের পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে।"


স্বগৃহ থেকে এতখানি দৌড়ের কায়িক পরিশ্রম এবং আবিষ্কারের উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছিল হাইরণের স্নেহধন্য আর্কিমিডিস। একজন দাস ততক্ষণে একটি বস্ত্র দ্বারা তাকে আবৃত করেছিল। সিংহাসন থেকে উত্তেজিত রাজাও নেমে এসেছিলেন। আর্কিমিডিসের দু'কাঁধ আঁকড়ে ধরে জানতে চেয়েছিলেন, "কি বলছ তুমি? সত্যি এমনটা সম্ভব!"


-"সম্ভব। শুধু তাই নয় এই প্লবতার সূত্রে আপনার সাইরেকুইসিয়াও জলে এবার ভাসবে।"


না সেদিন আর কেউ আর্কিমিডিসের কথায় অবিশ্বাস করেনি। কারণ ততদিনে রাজার সাথে সাথে বাকি সবাই বুঝে গেছিল, আর্কিমিডিসের দ্বারা সবই সম্ভব।


আর্কিমিডিসের প্লবতার সূত্রে ধরা পড়েছিল স্বর্ণকারের কারচুপি। আর সাইরেকুইসিয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তীকালে জলে ভেসেছিল সুবিশাল সব রণতরী।

------------

-"বলুন মহারাজা আমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন?" বৃদ্ধ রাজার শয্যা পার্শ্বে দাঁড়িয়ে জানতে চায় আর্কিমিডিস।

হাতের ইশারায় নিজের কাছে বসতে বলেন। তারপর খুব ক্ষীণকণ্ঠে বলেন, "আর্কিমিডিস, আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে, বেশ বুঝতে পারছি। তবে সিরাকিউজ থাকবে। খবর এসেছে রোম সিরাকিউজ আক্রমণ করবে। হাইরোনিমাস ছেলেমানুষ। ওকে পরিচালনা করছে আন্দ্রানোডোরাস। আমার কোনো ভরসা নেই সোপিয়াস এবং আন্দ্রানোডোরাসের উপর। তবে সেনেটের বিরুদ্ধে ওরা যেতে পারবে না। সিরাকিউজের প্রজারা তোমাকে বিশ্বাস করে। সমরাস্ত্রের প্রযুক্তিবিভাগের দায়িত্ব যৌথ সিদ্ধান্তে আমি এবং সেনেট তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। তুমি কতদূর অগ্রসর হতে পেরেছ? নিজের শরীরই আজ আমার শত্রু। স্বশরীরে গিয়ে যে সবকিছু দেখব , তা সম্ভব নয়। তাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বে তোমার কাছ থেকেই শুনে নিশ্চিন্ত হতে চাইছি। আমি জানি মিথ্যা তুমি বলো না।"

অসুস্থ, নবনিতপর বৃদ্ধের ম্লান হয়ে আসা চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে আর্কিমিডিসের। পিতাকে হারিয়েছে অনেকদিন আগেই। মহারাজ তাকে পিতার মতোই আগলে রেখেছেন, প্রশ্রয় দিয়েছেন। সেই প্রথম দর্শনের পর যে বুকে টেনে নিয়েছিলেন, আর কখনো সেই স্থান থেকে সরাননি। যখন যে গবেষণা করতে চেয়েছে, মহারাজা তাতেই দরাজ হস্তে অর্থ সাহায্য করেছেন। তাকে বিশ্বাস করেছেন। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আর্কিমিডিসের বুক থেকে।


রাজা সাইরণের ডানহাতটা নিজের দুই হাতের মুঠোতে ধরে বলে, "মহারাজ আজ থেকে দু'বছর পূর্বে সিরাকিউজের প্রাচীরকে শক্তিশালী করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা সম্পূর্ণ।  ইউরিলোসের দুর্গ এখন অনেকবেশি শক্তিশালী। তাছাড়া সিরাকিউজকে রক্ষা করার জন্য বেশকিছু নতুন যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ করেছি। তার মধ্যে দুটোর বর্ণনা আপনাকে দি। তাহলে তাদের কার্যপ্রণালী ও শক্তি সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।


আপনি তো জানেন আতস কাঁচের সহায়তায় সূর্য রশ্মিকে আবদ্ধ করে কাগজ বা ঘাসের উপর দীর্ঘ সময় পতিত করলে নির্দিষ্ট পতন বিন্দুটিতে আগুন জ্বলে ওঠে।"


মহারাজ চোখের ইশারায় সমর্থন করলেন।


-"আমি এই বিষয়টাকেই কাজে লাগিয়ে 'মৃত্যু রশ্মি' (আর্কিমিডিস ডেথ রে) নামক একটি আয়ুধ নির্মাণ করেছি। পালিশ করা ব্রোঞ্জ বা তামার দ্বারা নির্মিত বৃহৎ দর্পণে সূর্যের রশ্মিকে ধরে শত্রু জাহাজের দিকে একভাবে ধরে রাখলে দূর থেকেই সৌরকিরণের তীব্র উত্তাপে রণতরীগুলোতে আগুন লেগে যাবে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে এইভাবে আগুন লাগানো সম্ভব।"


আর্কিমিডিসের উদ্ভাবনের বর্ণনা শুনে রাজা সাইরণের চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শ্লেষ্মাজড়ানো কণ্ঠে আনন্দ উপচে পড়ে। তিনি বলেন, "এ কি কাণ্ড করেছ তুমি! বাঃ! বাঃ! আর্কিমিডিস তোমার তুলনা একমাত্র তুমিই। আর একটা অস্ত্র সম্পর্কে আমাকে বলো।"


-"প্রভু, আর একটি অস্ত্রের নাম দিয়েছি 'লৌহ নখর' (আয়রন ক্লস - অনেকটা আধুনিক ক্রেনের মতোই)। শত্রুরা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সিরাকিউজের উচ্চপ্রাচীরের অন্তরালে থাকা 'লৌহ নখর' শূন্য থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জাহাজের এক প্রান্ত তুলে ধরে প্রায় সরলরেখায় নিয়ে এসে ঝপাং করে ছেড়ে দেবে। জাহাজের ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং মধ্যিখান বরাবর ফাটল দেখা দেবে। অচিরেই জাহাজটির সলিল সামাধি ঘটবে।"


-"করেছ কি তুমি আর্কিমিডিস! মানবসভ্যতা যতদিন থাকবে, ততদিন তুমিও থাকবে। আর এখন আমার মনে হচ্ছে তোমার জন্যই আমিও ইতিহাসের পাতায় থেকে যাব।"


রাজা সাইরণের প্রশস্তিবাক্যে লজ্জায় নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায় আর্কিমিডিস। কথা ঘোরাতে জিজ্ঞেস করে, "আপনি এবার নিশ্চিন্ত তো?"


-"হ্যাঁ। আমি এবার শান্তিতে চোখ বুজতে পারব। স্থলে, জলে, উভয় ক্ষেত্রেই তুমি সিরাকিউজকে সুরক্ষিত করতে পেরেছ।"

------------

খ্যাতিমান রোমান সেনাপতি মার্সেলস নতজানু হয়ে ভূমিতে বসে আছেন মহান গণিতজ্ঞ, উদ্ভাবক, প্রযুক্তিবিদ আর্কিমিডিসের রক্তাক্ত, নিহত মৃতদেহের সামনে। শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমন্ডলে শ্বেত ভ্রুযুগলে কিঞ্চিত কুঞ্চন এখোন চোখে পড়ে। শ্বেতবর্ণের  সুতি নির্মিত গোড়ালি পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের 'ডোরিক চিটন'-  ( প্রাচীন গ্রিসের ইউনিসেক্স পোষাক ) লাল রক্তে এখন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। রক্তের ধারা গড়িয়ে গেছে ভূমিতে অঙ্কিত একটি বৃত্তের দিকে। আর্কিমিডিসের হাত এখনো সেখানে।


নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না মার্সেলস। তার মনে হচ্ছে বড় ভুল করে ফেলেছেন। এই মহান মানবের মৃত্যুর জন্য পক্ষান্তরে দায়ী তিনিই। মানবসভ্যতা এর জন্য কোনোদিন তাকে ক্ষমা করবে না। সিরাকিউজ বিজয়ের সমস্ত আনন্দ ব্যর্থ। সিরাকিউজের অমূল্য রত্ন নিজের ভুলে তিনি হারালেন। যে মানুষটার গল্প শুনে বড় হয়েছেন, শ্রদ্ধা করেছেন, আজ তারই মৃত্যুর কারণ হলেন। বিধাতার একি নিষ্ঠুর পরিহাস!


চারবছর পূর্বেই রাজা সাইরণের মৃত্যু হয়েছিল। তার নাবালক অযোগ্য পৌত্র সিংহাসনে বসলেও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মাত্র তেরোমাস রাজত্ব করেই নিহত হন। তারপর থেকে সিরাকিউজে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা লেগেই ছিল। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রোমানরা আক্রমণ করে সিরাকিউজ। দীর্ঘ দু'বছর একমাত্র আর্কিমিডিসের জন্যেই সিরাকিউজ অবরোধ করে রেখেও দখল করা সম্ভব হয়নি।

অবশেষে দেবী আর্টিমিসের উৎসব উপলক্ষে সিরাকিউজবাসী একটু অসচেতন হয়ে পড়লে সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কিছু দেশোদ্রোহি বিশ্বাসঘাতকের  সহায়তায় মার্সেলাস সিরাকিউজের অবরোধ ভাঙতে সফল হন। যে মানুষটা একার প্রচেষ্টায় এই বিশাল রোমান বাহিনীকে বাধা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাকে সামনে থেকে দেখার তীব্র বাসনায় সৈনিকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর্কিমিডিসকে নিজের শিবিরে নিয়ে আসার।


জ্ঞানসাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, জগৎসংসার সম্পর্কে উদাসীন সুমহান গণিতজ্ঞ জানতেও পারেননি সিরাকিউজ রোম দখল করে নিয়েছে। তিনি উদ্ভাবক, জ্ঞানপিপাসু, সত্যের সন্ধানী। সত্যের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন। ঠিক সেই সময় এক অর্বাচীন, নির্বোধ সৈন্য তাকে মার্সেলসের শিবিরে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে এলে তিনি মুখ না তুলেই গণিতের একটি বিশেষ সমস্যা সমাধান করতে করতে নিজের দাস এসেছে ভেবে বিরক্তভাবেই বলেছিলেন, "এখান থেকে দূর হয়ে যাও এখন। আমার বৃত্তকে বিরক্ত করোনা।" আর পরক্ষণেই  কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার উপরে নেমে এসেছিল মুক অসির কোপ।

সেনাপতি মার্সেলস যথোপযুক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে মহান গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ, প্রযুক্তিবিদ আর্কিমিডিসকে সমাধিস্থ করেন।

স্বদেশ প্রেমিক, অঙ্কপাগল মানুষটি জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন স্বাধীন। তিনি ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য রেখে গেলেন তার অভূতপূর্ব একাধিক গাণিতিক আবিষ্কার এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন। প্রকৃত অর্থেই তিনি 'আর্কসমেডোমাই', 'আর্কিমিডিস।'

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb