নোবেলজয়ী এক বিজ্ঞানীর গল্প

লেখক - সৌমিত্র চৌধুরী

 

শুরুতেই বিপদ। থিসিস বাতিল হয়ে যাবে, তেমনই মত বিশেষজ্ঞদের। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন ছাত্র। দিনরাত পরিশ্রম করে গবেষণাপত্র তৈরি করেছেন। গবেষণা করতে গিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন কিছু অদ্ভুত ব্যাপার।  বার বার পরীক্ষা করলেন। অভ্রান্ত পর্যবেক্ষণ। তারপর সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করলেন থিসিসের পাতায়।

বয়স চব্বিশ। মনের মধ্যে অনেক স্বপ্ন। থিসিস জমা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী পাবেন। তারপর অধ্যাপনা, অনেক বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করবেন। কিন্তু থিসিস বাতিল হয়ে গেলে তো সব আশা ধূলিসাৎ! 

চিন্তায় পড়লেন ছাত্র। তবে অল্পতেই ভেঙে পড়া, দুর্বল চিত্তের যুবক নন। বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী, তাঁর চোখে অনেক স্বপ্ন। যুবক আদতে চাষি পরিবারের ছেলে। বাবা-কাকা শিক্ষিত। পরিবারের ছেলেকে উচ্চ শিক্ষা দিয়েছেন। পড়িয়েছেন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

উপাসালা বিশ্ববিদ্যালয়। সুইডেন দেশটির নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা শিখেছেন যুবক। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য গেলেন দেশের রাজধানী শহরে। স্টকহোম। সেখানকার রয়াল সুইডিশ অকাদেমিতে (Royal Swedish Academy) উচ্চতর শিক্ষা, তারপর গবেষণা।

উপাসালাও নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেখানে গবেষণা না করে চলে এলেন রাজধানী শহরের রয়াল সুইডিশ অকাদেমিতে। কারণ কী? উপাসালায় নাকি স্বাধীন ভাবে কাজ করবার সুযোগ এই। অধ্যাপকদের অনমনীয় মনোভাব। গতানুগতিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত। নতুন ভাবনা চিন্তায় উৎসাহ নেই। উপাসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গাইড ছিলেন অধ্যাপক রবার্ট থ্যালেন। তাঁর পছন্দের বিষয় বিভিন্ন যৌগের বর্ণালী বিশ্লেষণ (spectral analysis)। বিষয়টি ভাল লাগতো না  যুবকের। তাঁর ইচ্ছে, অন্য আরেকটি বিষয়ে গবেষণা করা। তাই-ই করলেন তিনি।

রয়াল সুইডিশ অকাদেমিতে গবেষনা করলেন। গবেষণার ফল থিসিসে লিপিবদ্ধ করে ডক্টরেট ডিগ্রীর জন্য জমা দিলেন। এবার বিপদে পরে গেলেন যুবক। শুনলেন, থিসিসের বিষয় বিচারকদের মনঃপুত নয়, অতএব বাতিল হয়ে যাবে!   

শেষ পর্যন্ত কি হল? কী পরিণতি ঘটল যুবকের জীবনে?

পরবর্তীকালে নোবেল পুরষ্কার পেলেন তিনি (১৯০৩)। নাম, স্যান্তে অগাস্ট আরেনিয়াস (Svante August Arrhenius)। জন্ম সুইডেন দেশটির উপাসালা শহরে,  একশ তেষট্টি বছর আগে (১৮৫৯, ফেব্রুয়ারি ১৯)। বাবা স্যান্তে গুস্তাভ আরেনিয়াস। মায়ের নাম ক্যারোলিনা থুনবার্‌গ আরেনিয়াস। বাবা জমির সার্ভেয়র।

স্যান্তে অগাস্ট আরেনিয়াস রয়াল সুইডিশ অকাদেমিতে গবেষণা করলেন অধ্যাপক এরিক এডুল্যান্ড (Erik Edlund)-এর অধীনে। চব্বিশ বছর বয়সে ডক্টরেট ডিগ্রীর জন্য থিসিস জমা দিয়েছেন (১৮৮৩)। নতুন কথা লিখেছেন। থিসিসে নতুন পর্যবেক্ষণ বা তত্ত্ব থাকতেই হবে। স্যান্তে আরেনিয়াস তাঁর পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ লব্ধ জ্ঞান সূত্রাকারে টাইপ করে ছাপিয়েছেন থিসিসে। টাইপ রাইটার আবিষ্কার হয়েছে (১৮৬৭) ততদিনে।  

কী বিষয় থিসিসের? লঘু দ্রবনে বিদ্যুৎ পরিবাহিতা (electrical conductivity of dilute solutions)। লিখছেন, অ্যাসিড, বেস এবং সল্ট (acids, bases and salts) জলীয় দ্রবনে ভেঙে যায়। ভেঙে গিয়ে তৈরি করে ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক আয়ন।

ভুল ভুল! তখনকার ধারনা অনুযায়ী তত্ত্বটি একদমই বেঠিক। ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডের অভিমত তখন প্রচলিত। ফ্যারাডের তত্ত্ব, দ্রবনে বিদ্যুৎ প্রবাহ চললেই তৈরি হয় আয়ন। ‘আয়ন (Ion)’ শব্দটি তাঁরই (মাইকেল ফ্যারাডে) তৈরি।

কিন্তু আরেনিয়াস বলছেন অন্য কথা! মাইকেল ফ্যারাডের তত্ত্ব বিরোধী অভিমত। লিখেছেন, অ্যাসিডের মধ্যে থাকে হাইড্রোজেন আয়ন। জলে দ্রবীভূত হয়ে অ্যাসিড মুক্ত করে দেয় হাইড্রোজেন আয়ন (H+)। আর ক্ষারীয় দ্রবনে থাকে হাইড্রক্সিল আয়ন (hydroxide ions, OH-)।

প্রচলিত ধারনার বিপরীত এই তত্ত্ব। বলছেন কে? চব্বিশ বছরের এক অজানা অচেনা বিজ্ঞানী। তার তত্ত্ব নিয়ে বিদ্রুপ, হাসাহাসি চলল। থিসিস পরীক্ষকরা মানতে রাজী নন আরেনিয়াস-তত্ত্ব। পরিণতি মারাত্মক! বাতিল হয়ে যাবে থিসিস এবং যুবকের যাবতীয় স্বপ্ন।

এমনটা যে ঘটতে পারে, আগেই ভেবেছিলেন যুবক আরেনিয়াস। চব্বিশের উচ্চকাঙ্খি যুবক তাঁর থিসিসের কপি পাঠিয়েছিলে অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের কাছে। জার্মান বিজ্ঞানী অসওয়াল্ড (Wilhelm Ostwald), নেদারল্যান্ডের ভ্যান্ট হফ (Jacobus Henricus van’t Hoff) বিষয়টি পড়ে অভিভূত। ভ্যান্ট হফ তো তাঁর গবেষণাগারে কাজের সুযোগ দিয়ে ডাকলেন আরেনিয়াসকে। কিন্তু সেই সময় বাবা অসুস্থ, তাই যেতে পারেননি আরেনিয়াস।

বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অসওয়াল্ড, ভ্যান্ট হফের সন্তোষজনক মতামতের জন্য শেষমেশ ডক্টরেট ডিগ্রী পেলেন সুইডিশ অকাদেমি থেকে। তবে থিসিসের মান ‘অতি নিম্ন’। তাই অধ্যাপকের চাকরি পেলেন না আরেনিয়াস। তবে সুইডিশ অকাদেমি অবশ্য গবেষণার সুযোগ করে দিয়েছিল। অসওয়াল্ড এবং ভ্যান্ট হফের সঙ্গে গবেষণা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন আরেনিয়াস।

‘অ্যাসিড-বেস থিওরি’ নিয়ে বহু গবেষণা করেছিলেন। ‘ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি’ এই বিভাগটির প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে অসওয়াল্ড, ভ্যান্ট হফের সঙ্গে উচ্চারিত হয় বিজ্ঞানী আরেনিয়াসের নাম। 

আশ্চর্যের কথা, যে থিসিস অনেক পরিক্ষকের বিচারে ছিল ‘নিম্ন মানের’ এবং ‘বাতিল যোগ্য’, পরবর্তী কালে সেই ১৫০ পাতার থিসিসের তত্ত্ব তাঁকে এনে দিল অভাবিত সম্মান। বিজ্ঞানের বিশ্বশ্রেষ্ঠ পুরষ্কার, নোবেল প্রাইজ।

শুধু অ্যাসিড-বেস থিওরি নয়। বহু বিষয়ে গবেষণা করেছেন ভৌতরসায়ন বিজ্ঞানের (Physical chemistry) জনক স্যান্তে অগাস্ট আরেনিয়াস। আবহাওয়া বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, প্রাণরসায়নে (Biochemistry) তাঁর অবদান আজকের দিনেও স্মরণ করতে হয়।

যেমন আবহাওয়া বিজ্ঞানে তাঁর অবদান। বর্তমান পৃথিবীর সবচাইতে বড় সমস্যা, বিশ্ব উষ্ণায়ন। একশ বছর আগে বুঝতে পেরেছিলেন আরেনিয়াস। হাতে বহু প্রমাণ নিয়ে আমাদের সতর্ক করেছিলেন সুইডেনের বিজ্ঞানী।

আমরা মানিনি তাঁর কথা। মানলে ধ্বংসের হাত থেকে পরিত্রাণ পেত পৃথিবী গ্রহ। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে মানুষের মুখে বিশ্ব উষ্ণায়ন আর পরিবেশ দূষণের ফিরিস্তি। সর্বত্র গেল গেল রব। জল, বায়ু, মাটি বিষাক্ত। আর পৃথিবী গ্রহ ক্রমশ গরম হচ্ছে। সব মিলিয়ে মানুষ জীবজন্তু উদ্ভিদ -- তাবৎ প্রাণীকূলের টিকে থাকাই দায়। জল বায়ু মাটির দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পৃথিবী গ্রহের উষ্ণাতা। ভূপৃষ্ঠ এবং সাগর জলের উষ্ণতা বাড়ছে। আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। মানুষ এবং জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন। সব মিলিয়ে পৃথিবী গ্রহের বড় বিপদ।

বিপদের প্রধান কারণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন। আর উষ্ণায়ন সহ যাবতীয় পরিবেশ দূষণের মুলে মানুষ।  ভোগ্য পন্য উৎপাদন করতে গিয়ে গ্রহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটাই। কেমন করে? ব্যাখ্যা দিয়েছেন আরেনিয়াস। ক্রমাগত তাপ শক্তি নিঃসরণ করে। আরাম আয়েশ আর ভোগ্য বস্তু উৎপাদন করতে প্রয়োজন শক্তি। শক্তি তৈরি করতে লাগে জ্বালানি। যেমন কয়লার দহনে উৎপন্ন তাপশক্তি (Thermal power) থেকে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। বিদ্যুৎ বিনা জীবন অচল। ঘরে ঘরে রাস্তায় বিজলি বাতি, বাড়িতে ফ্রিজ, ঘর ঠাণ্ডা রাখবার এয়ার কন্ডিশন মেশিন। আধুনিকতা আর প্রগ্রতির পথে চলতে জ্বালানির দহন অপরিহার্য।

প্রগতির জয়যাত্রা শুরু শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে (1760-1820)। কলকারখানায় শুরু হল লোহা ও অন্য ধাতু গলানো। রেল জাহাজ গাড়ি তৈরি হতে লাগলো। এ সবই অগ্রগতির মানদণ্ড। অগ্রগতির খিদে মেটাতে প্রয়োজন হল অফুরান শক্তি। শক্তি এল কাঠ, জ্বালানি তেল, কয়লা ইত্যাদি প্রাকৃতিক ফুয়েল দহন করে। একুশ শতকের এক হিসেব মতে, পৃথিবীর 40 শতাংশ বিদ্যুৎ তৈরি হয় কয়লা পুড়িয়ে। আর পেট্রল দহন করে সংগ্রহ হয় 38 শতাংশ শক্তি। যত বেশী পুড়েছে প্রাকৃতিক জ্বালানি ততই বৃদ্ধি পেয়েছে বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং চারপাশের উষ্ণতা।

উষ্ণতা বৃদ্ধি রোখা না গেলে পৃথিবীর আয়ু বড় জোর আর একশ বছর। কারণ যে হারে বাড়ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড তাতে বর্তমান শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা 2.5-5 ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। ভয়ঙ্কর কথা! তাপমাত্রা 2 ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লেই তো আবহাওয়ার ব্যাপক বদল। মৃত্যু ঘণ্টা বেজে যাবে পৃথিবীর। উত্তর গোলার্ধের বরফ গলে গিয়ে সমুদ্র তল উঁচু করে দেবে 230 ফুট। এর পরিণাম? জলের নীচে তলিয়ে যাবে বহু দেশ।

ভবিষ্যতের এত বড় বিপদ সৃষ্টিকারি বিশ্ব-উষ্ণায়নের পরিণাম কি মানুষ বুঝতে পারেনি? ব্যাবসায়িক মুনাফা অর্জনে ব্যস্ত মানুষ বুঝতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু বুঝেছিলেন অগ্রগণ্য বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়। বিস্তারিত জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানী স্যান্তে আরেনিয়াস। দীর্ঘ সময় গবেষণা করে সত্য উদ্ঘাটন করেছিলেন। বিভিন্ন দেশে গিয়ে বাতাসের কার্বন ডইঅক্সাইড মেপে বহু প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন। ভয়ংকর এক বিপদ সম্বন্ধে বিশ্ববাসিকে সতর্ক করে লিখেছিলেন, ‘বাতাসে অধিক পরিমান কার্বন ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর এক বড় বিপদ।’

ছোট্ট একটা গ্যাসের কারসাজিতে বুদ্ধিমান মানুষ কেন এত বিপর্যস্ত? উত্তর দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী আরেনিয়াস। তিনটে মাত্র পরমানু -- একটা কার্বন এবং দু’টো অক্সিজেন -- এ দিয়ে তৈরি কার্বন ডাইঅক্সাইড অনু (চিত্র 1)। অশেষ ক্ষমতা গ্যাসটির। শুষে নেয় অবলোহিত (infrared light) আলো।

ব্যাপারটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সূর্যের আলোয় থাকে সাত রং। রঙের বর্ণালীতে দীর্ঘতম তরঙ্গ-দৈর্ঘ লাল আলোর। কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নেয় লাল আলো এবং অধিকতর তরঙ্গ দৈর্ঘ। ফলে বাতাস উত্তপ্ত হয়। উত্তাপ ঊর্ধ্বাকাশে না গিয়ে ফিরে আসে মাটিতে (Greenhouse effect)। কার্বন ডাইঅক্সাইড ছাড়াও গ্রিনহাউস গ্যাস পরিবারে আছে অন্য সদস্য – জলীয় বাস্প, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড এবং ওজোন। তবে তাপ ভূপৃষ্ঠে ফিরিয়ে আনবার সবচাইতে বেশি ক্ষমতা কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং জলীয় বাস্পের।

আশ্চর্য ফেনোমেনন! বিস্ময়কর এই ঘটনার নেপথ্য কাহিনীও আবিষ্কার করেছিলেন  আরেনিয়াস। বাতাস দু’ভাবে তাপ ধরে রাখে। বাতাসের মধ্য দিয়ে তাপ প্রবাহিত হবার সময় (selective diffusion) এবং তাপ শোষণের (absorption) মাধ্যমে। বাতাসের অন্য উপাদান গুলোয়—দ্বিপরমাণুর নাইট্রোজেন, অক্সিজেন—তাপের প্রভাবে কম্পন (vibration) ঘটে। অর্থাৎ দুই পরমানুর মধ্যেকার বন্ধনীর কম্পন। ফলে প্রচুর পরিমান তাপ শোষণ করতে পারে তারা। কিন্তু বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং জলীয় বাস্প তাপ গ্রহণ করে শোষণ প্রক্রিয়ার (absorption) মাধ্যমে। এদের (CO2, H2O) পরমাণু গুলো কাঁপতে থাকে বর্ণালির অবলোহিত (Heat, Infrared) অঞ্চলে। কাঁপতে থাকা একটি অণু তাপমোচন (Emission) করলে আরেকটি অনু সেটি গ্রহণ করে কাঁপতে থাকে (vibrate)।

এই প্রক্রিয়ার ফল কী? তাপ শোষণ, মোচন এবং পুনরায় শোষণ (Absorption-emission-absorption) — এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কার্বন ডাইঅক্সাইড (এবং জলীয় বাস্প) পৃথিবী তলে তাপ ধরে রাখে।

চিত্র 1. কার্বন ডাইঅক্সাইড অনু। [কার্বন ও অক্সিজেন পরমানুর মধ্যে কম্পন। দ্বি-বন্ধনী (Double bond) তাপ শোষণের ফলে বর্ধিত ও সঙ্কুচিত (vibrate) হচ্ছে].  

আরেনিয়াসের বলেছেন, 1896 সালে কার্বন ডাইঅক্সাইডের যা পরিমাণ, ভবিষ্যতে সেটা বেড়ে দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে 6 ডিগ্রী সেলসিয়াস। ভয়ঙ্কর কথা! তাপমাত্রা 2 ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লেই তো মহা প্রলয়! সলিল সমাধি ঘটবে অনেক দেশের। আধুনিক গবেষণা কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমানের সঙ্গে তাপমাত্রার সম্পর্ক (চিত্র 2) গোচরে এনে জানিয়েছে একই তথ্য। জানতে পেরেছি আরও বহু বিপদের কাহিনি। ফলে মারণ ডঙ্কায় কাঁপছে ধরিত্রী। বিজ্ঞানী আরেনিয়াসের কথায় গুরুত্ব দিলে পৃথিবী গ্রহের এত বড় বিপদ ঘটত না।

 


চিত্র 2. কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমানের সাথে তাপমাত্রার সম্পর্ক। 2016 সালে উষ্ণতা বৃদ্ধি 1.2 ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে।

আরেনিয়াসের থিসিসের (1884 সালে লেখা) বেশীর ভাগ তত্ত্বই পরবর্তীকালে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। কিছু অংশের মার্জনা হয়েছে। তাঁর আবিষ্কৃত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, ‘বিশুদ্ধ জল বা বিশুদ্ধ লবন বিদ্যুৎ পরিবহনে অক্ষম।’ কিন্তু লবনের জলীয় দ্রবণে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয়। আরও বললেন, জলীয় দ্রবণে সংঘটিত রাসায়নিক বিক্রিয়া আসলে আয়নিক বিক্রিয়া। 

লঘু জলীয় দ্রবণে এরকমই ঘটে। কিন্তু গাঢ় দ্রবণে এমনটা হয় না। তাই পরিমার্জনের প্রয়োজন ঘটল। ডাচ-আমেরিকান বিজ্ঞানী পিটার ডি বাই, জার্মান বিজ্ঞানী এরিক হুকেল এবং বাঙালি বিজ্ঞানী জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ উন্নততর তথ্য উদ্ভাবন করলেন। 

আরেনিয়াস সংজ্ঞা দিয়েছিলেন অ্যাসিড ও বেসের। অ্যাসিড মানে যে যৌগ জলীয় দ্রবণে হাইড্রোজেন আয়ন উৎপন্ন করে। আর জলীয় দ্রবণে বেস উৎপন্ন করে হাইড্রক্সিল আয়ন।

পরবর্তী কালে (১৮৮৯) রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটনের নেপথ্যে অ্যাক্টিভেশন এনার্জির তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন আরেনিয়াস। উদ্ভাবন করলেন দুই অনুর মধ্যে ঘটে চলা বিক্রিয়া কী ভাবে, কোন গতিতে ঘটবে। 

পৃথিবীর বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু নিজের দেশ সুইডেন ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি। ১৯০৩ সালে নোবেল পুরষ্কার পাবার পর স্টকহোমে গড়ে ওঠা নতুন সংস্থা, নোবেল ইনস্‌টিউট অফ ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির (Noble Institute of Physical Chemistry) ডিরেক্টর হন তিনি। সেখান থেকেই অবসর নেন (১৯১৭)।  

শুধু রসায়ন এবং আবহাওয়া বিজ্ঞান নয়। আরেনিয়াস আরও বহু বিষয়ে গবেষণা করেছেন।  ভূবিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইমিউনোলজি, টক্সিন-অ্যান্টিটক্সিন, এমনকি পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব নিয়েও। সব কথাই অভ্রান্ত, এমন নয়। কিন্তু পরবর্তীকালের গবেষণাকে সমৃদ্ধ করেছিল তাঁর ভাবনাচিন্তা এবং উদ্ঘাটিত তথ্য। 

ইংরাজি নয়, ‘পৃথিবীতে জ্ঞানবিজ্ঞান আদান প্রদানের জন্য সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা (Universal language) চালু করা উচিৎ’, এমন কথাও বলেছেন তিনি।

জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইও লিখেছেন। কয়েকটি বই (Quantitative Laws in Biological Chemistry,1915; Worlds in the Making: The Evolution of the Universe ,1906;  The Destinies of the Stars 1915) মানব জাতীর অমুল্য সম্পদ.

মৃত্যু হয় উপাসালা শহরে (১৯২৭)। সেখানকার ওল্ড সিমেট্রিতে সমাধিস্ত বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্যান্তে অগাস্ট আরেনিয়াস।

 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb