এক ছদ্মবেশীর গপ্পো

লেখক - সৌম্যকান্তি জানা

 

আমরা সবাই কাগজ ফুল চিনি সাধারণতঃ গোলাপি রঙের হয়। লাল, সাদা ও হলুদ রঙের কাগজ ফুলও দেখা যায়। আধা-কাষ্ঠল এই গাছটি অনেকের বাড়ির গেটে বা পাঁচিলের ধারে লাগানো থাকে। সারা বছর গাছে ফুল ভরে থাকে। বাংলায় আমরা এই ফুলকে কাগজ ফুল বললেও ইংরেজিতে এই ফুলকে সবাই বলে বোগেনভিলিয়া (Bougainvillea)। আমাদের চেনা এই গাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম বোগেনভিলিয়া স্পেকটাবিলিস (Bougainvillea spectabilis)। কিন্তু এই গাছের সাথে জড়িয়ে আছে এক ছদ্মবেশীর রোমাঞ্চকর কাহিনি।

অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের এক নৌসেনাপতি ছিলেন লুইস অ্যান্টনি দ্য বোগেনভিলি। ফ্রান্সের সম্রাটের আগ্রহে ১৮৬৬ সালে এক সমুদ্রযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। তখন পালতোলা জাহাজ চলত। অচেনা অজানা বিপদসঙ্কুল সমুদ্রপথে দীর্ঘ যাত্রায় থাকত প্রতি মুহূর্তে বিপদের হাতছানি। তবুও ওই সময় ইউরোপের নানা দেশের সম্রাটরা সমুদ্রযাত্রার আয়োজন করতেন মূলতঃ দুটি কারণে – নতুন ও নিরাপদ সমুদ্রপথ আবিষ্কার করার জন্য এবং নতুন নতুন দেশ ও তার প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজ পাওয়ার জন্য। একজন নৌ-সেনাপতির নেতৃত্বে হত অভিযান। বোগেনভিলি ছিলেন ওই নৌঅভিযানের নেতা। দুটো জাহাজে প্রায় একশো নাবিক এবং একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানীকে নিয়ে হচ্ছে এই সমুদ্রযাত্রা। অভিযাত্রীরা সবাই পুরুষ কারণ ওই সময় কেবল পুরুষরাই সমুদ্রযাত্রার অনুমতি পেত।

দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের রকেফোর্ট বন্দর থেকে ছাড়ছে দুটো জাহাজ। সবাই প্রায় এসে গেছে। কিন্তু ফিলিবার্ট কমারসন একটা জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে পথের দিকে চেয়ে রয়েছেন। কারও অপেক্ষায়? কমারসন হলেন সেই সময়ে ফ্রান্সের নামকরা ডাক্তার তথা উদ্ভিদবিজ্ঞানী। সেনাপতি বোগেনভিলি জিজ্ঞাসা করলেন, “কার জন্য অপেক্ষা করছেন?” কমারসন বললেন, “আমার সহকারীর জন্য। একটু দেরি করে ফেলেছে।” আসলে কমারসন এই সমুদ্রযাত্রায় তাঁর একজন ব্যক্তিগত সহকারীকে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে তিনি আগাম অনুমতিও নিয়েছেন। সহকারী নেওয়ার কারণ তাঁর পায়ে একটা ক্ষত রয়েছে যার ফলে তিনি ভালোভাবে হাঁটাহাঁটি করতে পারছেন না। একটু বাদেই দেখা গেল ঢোলা প্যান্ট ও জামা পরা টুপি মাথায় এক যুবক হাতে একটা বাক্স নিয়ে জাহাজের দিকে আসছে। কমারসনের চোখেমুখে স্বস্তির ছাপ দেখা গেল।

জাহাজ ছেড়ে দিল। বোগেনভিলির সাথে কমারসন তাঁর সহকারীর আলাপ করিয়ে দিলেন। নাম বোনেফয়। বললেন, “আমি তো অসুস্থ, তাই বোনেফয়কে আমার সাথে একই ঘরে থাকার অনুমতি দিলে সুবিধা হয়।” বোগেনভিলি অনুমতি দিলেন। জাহাজে আধিকারিকদের জন্য নির্ধারিত ঘরগুলোর ব্যবস্থাপনা অনেকটা ভালো। সেই হিসেবে কমারসনের ঘরটি একটু ছোটো, আর সংযুক্ত শৌচাগারও নেই। কমারসন তাঁর অসুস্থতার জন্য বোনেফয়কে কাছে রাখতে চান। তাই একটু বড়ো মাপের ঘর দেওয়ার জন্য বোগেনভিলিকে অনুরোধ করলেন। অনুরোধ মঞ্জুর হল। দুটি জাহাজেই বোগেনভিলির জন্য জন্য নির্ধারিত ঘর ছিল। তিনি একটি জাহাজে তাঁর ঘরে কমারসনকে সহকারীসহ থাকার অনুমতি দিলেন।

বছরখানেক সমুদ্রযাত্রার পর ব্রাজিলের এক অরণ্যে বোনেফয় একটা নতুন গাছ দেখতে পেল। গোলাপি রঙের ফুলে শোভিত সেই গাছ। কমারসনকে এনে দেখালেন। নৌ-সেনাপতি বোগেনভিলিকে সম্মান জানিয়ে কমারসন এই গাছের নাম দিলেন বোগেনভিলিয়া। এইভাবে নানা দ্বীপে নেমে বোনেফয় অসংখ্য নতুন নতুন উদ্ভিদ ও প্রাণী সংগ্রহ করে আনত আর সেগুলো বিজ্ঞানসম্মতভাবে সংরক্ষণ করত।

এভাবেই বেশ নিরুপদ্রবে সমুদ্রযাত্রা চলছিল। ১৭৬৮ সালে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় তাহিতি দ্বীপে নোঙর করল জাহাজ। সাধারণতঃ কোনও ভূখন্ডে জাহাজ নোঙর করলে সেখানে নাবিকরা কয়েকদিন থেকে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার ধকল কিছুটা কাটিয়ে নিত। তাহিতি দ্বীপে থাকত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। ওই দ্বীপে অবাধ যৌনতার প্রচলন ছিল। হতে পারে সেই কারণেই ফরাসি নাবিকদের আগ্রহ ছিল তাহিতিবাসীদের ঘিরে। হঠাৎ দেখা গেল কয়েকজন তাহিতিবাসী বোনেফয়কে ঘিরে ধরে তার জামাকাপড় ধরে টানাটানি করছে। আর বোনেফয় “বাঁচাও, বাঁচাও” বলে চিৎকার করছে। এমন কান্ড তো কোনওদিন তাহিতিবাসীরা করেনি। জানা গেল, ওরা নাকি গন্ধ শুঁকে বুঝতে পেরেছে যে বোনেফয় পুরুষ নয়, নারী। ছদ্মবেশী এক নারী। দু’বছর ধরে জাহাজে এতজন নাবিক, এমনকি নৌসেনাপতির চোখকেও ফাঁকি দিয়েছে। ধরা পড়ে গেল ছদ্মবেশী বোনেফয়। হাজির করা হল সেনাপতির সামনে। বোনেফয় স্বীকার করল যে সে নারী। কমারসন জানালেন, এসব তাঁর পরিকল্পনাতেই হয়েছে। ওর আসল নাম জান বারে (Jeanne Baret)।

আসলে বিপত্নীক কমারসন তাঁর গবেষণায় সহকর্মী হিসেবে এমন একজনকে চাইছিলেন যার গাছগাছড়ার লৌকিক ভেষজ গুণাবলী সম্পর্কে ধারণা আছে। তিনি এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের নিরক্ষর কন্যা জান বারেকে এই কাজের জন্য নির্বাচিত করেন। কমারসনের কাছে থেকে জান অল্প দিনের মধ্যেই উদ্ভিদবিদ্যার নানা বিষয় বুঝে নিতে সক্ষম হয়। কমারসনও ক্রমশঃ অনুরক্ত ও নির্ভরশীল হয়ে পড়েন জানের উপর। আর তাই দু’জনের পরিকল্পনামাফিক জান পুরুষের ছদ্মবেশে নৌঅভিযানে যাত্রা করে।

জাহাজেই বসল জান বারে ও কমারসনের বিচারসভা। নৌসেনাপতি বোগেনভিলি প্রায় দু’ছরে জানের আচরণে কোনও ত্রুটি পাননি, বরং যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে দেখেছেন। তাই জানকে ও পরিকল্পনার শরিক হিসেবে কমারসনকে লঘু শাস্তি দিলেন বোগেনভিলি। তাঁদের নামিয়ে দেওয়া হল ফরাসি অধিকৃত ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ মরিসাসে। কমারসন ও জান বিয়ে করেছিলেন কিনা জানা যায়নি। তাঁরা মরিসাস থেকে মাদাগাস্কারেও অভিযান করেছিলেন। মরিসাস ও মাদাগাস্কারে কমারসনের তত্ত্বাবধানে জান বহু অজানা উদ্ভিদ সংগ্রহ করে সেগুলোর বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণ করেন। তাঁদের সংগৃহীত উদ্ভিদের সংখ্যা ছ’হাজারেরও বেশি। সমস্ত নমুনা এখনও সংরক্ষিত আছে প্যারিসের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে।

১৭৭৩ সালে মরিসাসে কমারসনের প্রয়াণ হলে জান বারে ওখানের এক প্রাক্তন অফিসার জাঁ দুবারনাট-কে বিয়ে করে এবং পরের বছরই ফ্রান্সে ফিরে আসে। জান বারের কাজের প্রতি নৌসেনাপতি বোগেনভিলির ছিল অসীম শ্রদ্ধা। তাঁর অনুরোধে ফরাসি সম্রাট জান বারের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে আমরণ পেনশনের অনুমতিদান করেন।

জান বারের মৃত্যুর সঠিক তারিখ জানা যায় না। অক্ষরজ্ঞানহীন এক গ্রাম্য তরুণী জান বারে যে অপরিসীম সাহস নিয়ে সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন তার পেছনে ছিল গাছগাছালির প্রতি নিবিড় ভালোবাসা, শেখার ও অজানাকে জানার অদম্য উৎসাহ, কমারসনের প্রতি দায়বদ্ধতা ও ভালোবাসা এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা। কিন্তু তার কথা আধুনিক যুগের মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। ছিল না কোনও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। অবশেষে ২০১২ সালে অন্দিজ পর্বতমালায় আবিষ্কৃত একটি ফুলগাছের নাম জান বারের নামে রাখা হয় সোলানাম বারেসি (Solanum baretiae)। আর পৃথিবীর প্রথম সফল মহিলা সমুদ্র-অভিযাত্রী হিসেবে মিলেছে জান বারের স্বীকৃতি। হোক না তা ছদ্মবেশে!

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb