অন্তর্নিহিত

লেখক - সাগ্নিক সিনহা

 

 

(১)

স্থান : অজ্ঞাত

সময় : অসংজ্ঞাত

––––––––––––––––

আমি জেগে উঠলাম।

আমি কে?

আমার চারপাশে গাঢ়, বিস্মৃতির অতল অন্ধকূপ। এক হিমশীতল শূন্যতার সমুদ্রে ডুবে সাঁতার কাটছিলাম আমি। সেই আঁধারের শেষ নেই, শুরু নেই, মাত্রা নেই, সময় নেই। অসীম ব্যাপ্তির এক আশ্চর্য বিন্দু। আর তার সীমাহীন একক বিস্তৃতির মাঝেই আমি বর্তমান।

কিভাবে? কোথায় ? কোনো প্রশ্নেরই উত্তর জানা নেই আমার।

আমার আকার নেই, রূপ নেই, নাম নেই!

কে আমি!

কি আমার পরিচয় !

কোথায় সৃষ্টি আমার?

জানা নেই। জানা নেই।

শুধু কে যেন আমার ভিতর থেকে জানান দিচ্ছে, সময় হয়ে এল।

এইবার তবে…মহাবিস্ফোরণ।

(২)

আমিই প্রথম।

বিন্দু আর অসীম, একইসাথে বর্তমান আমার মাঝে। আমিই আমার স্রষ্টা, আমিই আমার চালক।

আমার আবছা স্মৃতিতে আবার ধরা পড়েছে এর আগের লক্ষ লক্ষ কোটি মহাবিশ্বের গল্প। তাদের সৃষ্টির রূপকথা, তাদের ধ্বংসের উপাখ্যান। সেই অনন্ত চক্রের মধ্যে জড়িয়ে থাকি আমি। কবে থেকে? কেন? কে দিয়েছে আমায় এই দায়ভার? জানা নেই আমার।

মহাবিস্ফোরণ ঘটেছে, নতুন মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে, আলোর সূচনা হয়েছে.. আরও একবার।

জেগে উঠছে কোটি কোটি শিশু মহাবিশ্ব, ছায়াপথ, সদ্যোজাত নীহারিকা। আর আছি আমি। ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে আমি, ছায়াপথ জুড়ে গড়ে উঠছে আমার শরীর।

ক্ষুধার্ত শুঁয়োপোকার মতো আমার নাকের ফুটো দিয়ে, কানের গর্ত বেয়ে, মাথার মধ্যেও ঢুকে আসছিল অদ্ভুত শান্তির অন্ধকার, খালি করে দিচ্ছিল কবেকার জমে থাকা অজস্র জঞ্জাল, আমার অসম্ভব হালকা লাগছিল। খুলির মধ্যের ঝুলমাখা জায়গাটা ফাঁকা হচ্ছিল, তারপর বড়ো হতে লাগল আস্তে আস্তে, বাড়ছিল, বেড়েই যাচ্ছিল… আর ঠান্ডা, অসাড়, নেশাগ্রস্ত জীবের মতো পড়ে ছিলাম আমি, স্রেফ পড়ে ছিলাম।

অনেকক্ষণ পড়ে ছিলাম, ঠিক কতক্ষন ? জানি না, সময়ের কোনো মূল্য নেই আমার আছে। সময় মানে অনেক দায়িত্ত্ব… আমি দায়িত্ত্ব নিতে চাই না।

এভাবেই নির্জীব হয়ে এককোণে পড়ে থাকতে বেশ লাগছে আমার।

কিন্তু তবু কিসের অমোঘ টানে আলোর বেগে ভেসে যাচ্ছি আমি। প্রতিটা পরমাণু, প্রতিটা ধুলো আর গ্যাসের কণার সাথে ছড়িয়ে পড়ছি আমি, দূর থেকে আরো দূরে…এক থেকে দুই, তিন..তারপর অনেক অনেক। অসীম সংখ্যক আমিতে ভেঙে যাচ্ছে আমার অস্তিত্ব, সবার মধ্যেই জেগে উঠছে এক সুতোয় বাঁধা আমার চেতনা।

আর সেই সৃষ্টির নবীন আলোর চারপাশেই ঘিরে রয়েছে তার চেয়েও আদিম অন্ধকার। এই অন্ধকারই আমার রূপ, আমার পরিচয়, আমার নিয়মই এই মহাবিশ্বে শেষ কথা।

আমার থেকেই এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি, আমার সাথেই এর শেষ।

(৩)

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, সূর্যের তৃতীয় গ্রহ

স্থানীয় সময় : জুলাই 23, 2019 খ্রিস্টাব্দ

অনেকক্ষণ থেকে বেজে যাচ্ছে অ্যালার্মটা। সেটাকে বন্ধ করার সময় নেই কারোর হাতে। হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জের

মৌনা কিয়া ইন্টারন্যাশনাল অবজারভেটরির ভিতর এই মুহূর্তে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। বিশাল বড় রেডিও টেলিস্কোপের গম্বুজকে ঘিরেই তিনতলা বাড়িটা। সেখানে, সব ডিপার্টমেন্টের সমস্ত কাজ বন্ধ করে একটাই ফাইল অ্যানালিসিস করা হচ্ছে, প্রচুর কমপিউটিং পাওয়ার দরকার এখন। একটু আগেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিমানে আরও একদল বিশেষজ্ঞকে নিয়ে আসা হয়েছে।

"কি বলছ এডি, ইসরো'ও একই জিনিস পেয়েছে ?"

প্রায় লাফিয়ে উঠলেন প্রৌঢ় মানুষটি। সরু বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন ওঁরা দুজন। দুজনের গলাতেই বিস্ময় আর উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট।

সামনে দাঁড়ানো তরুণ ছেলেটি উত্তর দিল, "ইয়েস, প্রোফেসর। ডক্টর দাশগুপ্ত এক্ষুনি কল করেছিলেন আমাকে, প্রায় একই রেডিও সিগন্যাল ধরা পড়েছে ওদের টেলিস্কোপেও। এই যে স্যার, মেলটা দেখুন। উনি কিছু প্রাথমিক ডেটা পাঠিয়েও দিয়েছেন এখন।"

অ্যাসিস্ট্যান্ট রিসার্চ ম্যানেজার এডওয়ার্ড গ্রীনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে, তিনতলার সরু করিডোর দিয়ে প্রোসেসিং ইউনিটের দিকে দৌড় দিলেন প্রোজেক্ট হেড জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রোফেসর ফিলিপস। তিনি মূলত পদার্থবিদ, কসমোলজি নিয়ে তাঁর কাজ কারবার। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁদের হাতে যা এসে পৌঁছেছে তার কোনো একটি আলাদা বিষয় হয় না। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথস, বায়োলজি, লিঙ্গুইসটিক্স সবকিছুকে ছাড়িয়ে গিয়েছে এর গুরুত্ব।

কাল মধ্যরাতে আচমকা রেডিও টেলিস্কোপে ধরা পড়ে জিনিসটা। পরপর দুটো অপরিচিত সিগন্যাল, মাঝে সামান্য বিরতি। কি আছে সেই সিগন্যালে জানার চেষ্টা চলছে গত বারো ঘন্টা ধরে। তবে কোথা থেকে এসেছে সে ব্যাপারে কিছুটা হলেও একটা ধারণা করা যাচ্ছে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির নিজের একশো কোটি গ্রহ, নক্ষত্র আর জ্যোতিষ্কের উজ্জ্বল বিকিরণের কারনে বেশিরভাগটাই চাপা পড়ে যায় আর বাইরের অসীম মহাকাশের বিস্তার। প্রায় 25 মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের তেমনই অপেক্ষাকৃত অনাবিষ্কৃত একটি ছায়াপথ থেকে এসেছে এই সঙ্কেত । রিসিভিং সেন্টারের কম্পিউটার এ.আই সঙ্গে সঙ্গেই সংকেতটিকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তালিকায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। অর্থাৎ, আর পাঁচটা সাধারণ মহাজাগতিক বিকিরণের তুলনায় অন্যরকম কিছু থাকলেও থাকতে পারে এর মধ্যে। কিন্তু, এখন প্রশ্ন একটাই, যদি সত্যিই কৃত্রিম বলে প্রমাণিত হয় তাহলে যে বা যারাই পাঠিয়ে থাক এই রেডিও ট্রান্সমিশন, আজ থেকে প্রায় চল্লিশ লক্ষ বছর আগে এই নীল গ্রহের উদ্দ্যেশে পাঠানো হয়েছিল বার্তাটা। তাহলে কি বুদ্ধিমান প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণ হয়েই যাবে এবারে?

উত্তেজনায় টগবগ করতে করতে করিডোরের শেষ প্রান্তের ঘরটায় এসে ঢুকলেন। অনেকগুলো মনিটরকে ঘিরে চাপা একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে সেখানে। এই ঘরেই কাল রাত থেকে অ্যানালিসিস চলছিল। স্ক্রিনের সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রোফেসর। সেখানে এই মুহূর্তে ফুটে উঠেছে সিগন্যাল দুটোর পাঠোদ্ধার।

প্রথমে কয়েকটা মৌলিক সংখ্যা। রক্ত গরম হয়ে উঠল তাঁর, এটাই তো বুদ্ধিমান প্রাণের প্রথম লক্ষণ! মহাকাশের বুকে ভিনগ্রহী প্রাণীদের উদ্দেশ্যে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য তাঁরা নিজেরাও তো এমনই মৌলিক সংখ্যা ব্যবহার করেন!

আর দ্বিতীয়টা…একটা গাণিতিক জটিল ফর্মুলা। কয়েক সেকেন্ড দেখতেই চিনতে পারলেন প্রোফেসর। ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির উপবৃত্তের সূত্র, যে সূত্র মেনে আবর্তিত হয় মহাজগতের প্রায় সমস্ত জ্যোতিষ্ক। কিন্তু প্রথমে স্রেফ কিছু মৌলিক সংখ্যার পর এইরকম সূত্র পাঠানোর অর্থ কি?

যে সম্ভাবনাটা মাথায় আসছে সেটা তো সত্যি হতে পারে না।

কারণ এর অর্থ একটাই হতে পারে। প্রাথমিক সঙ্কেতটা পাঠানোর ঠিক পরেই প্রেরকের কাছে কোনোভাবে ধরা পড়ে বুদ্ধিমান প্রাণের অস্তিত্ব, এমন জীব যে গণিতে অত্যন্ত দক্ষ। কিন্তু  আলোকবর্ষ দূরের ওই গ্রহে পৃথিবীর ছবি আলোর বেগে পৌঁছাতে সময় নেয় আড়াই কোটি বছর ! অর্থাৎ, আজ থেকে পঁচিশ মিলিয়ন বছর আগে যখন পাঠানো হয়েছিল এই সিগন্যাল, সেই মুহূর্তে সেই অজানা সভ্যতার টেলিস্কোপে ধরা পড়েছে এই নীলগ্রহের যে ছবি, তা আসলে আজকের থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগের কোনো এক পার্থিব দৃশ্য। যা দেখে এই বার্তা প্রেরকদের ধারণা জন্মেছিল যে ত্রিকোণমিতির সূত্র উদ্ধার করে জবাব দিতে পারবে, এমন কোনো সভ্যতার অস্তিত্ব আছে এই পৃথিবী নামের ছোট্ট গ্রহটির বুকে।

কিন্তু পাঁচ কোটি বছর আগের উন্নত বিজ্ঞানবোদ্ধা প্রাণী… এ যে পাগলের প্রলাপ!

নেশার ঘোরেও বোধহয় এমন অলীক কল্পনা করা অসম্ভব।

চারশো ষাট কোটি বছর বয়সী এই পৃথিবীর বুকে প্রথম মানুষ হেঁটেছে মাত্র চব্বিশ লাখ বছর আগে!

(৪)

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, সূর্যের দ্বিতীয় গ্রহ

আলোর থেকেই আসে অন্ধকার।

আলো মানে উত্তাপ, আলো মানে শক্তি।

সেই শক্তি আমার আদিম চেতনার বেঁচে থাকার জন্য খুব জরুরী। বুক ভরে আলোকে শুষে নিই আমি, তার বদলে আমার নিশ্বাসের সাথে পরিবেশে মিশে যায় বেঁচে থাকা উত্তাপ। এই ছায়াপথ আমার অত্যন্ত প্রিয়।

এই ছায়াপথের সূর্য ফেলে আসা আরো হাজার হাজার ছায়াপথের নক্ষত্রের তুলনায় অনেকটাই ছোটো, তবে ভীষণ অন্যরকম। চোখে পড়ার মত। তাই এখানেই আশ্রয় নিয়েছি আমি।

সূর্যের কক্ষপথে একে কেন্দ্র করে গ্রহগুলো এমন বিশেষভাবে সাজানো খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়, হঠাৎ দেখলে মনে হয় স্রষ্টা নিজের হাতে করে সযত্নে বসিয়ে গিয়েছেন তাদেরকে। সূর্যের সবথেকে কাছের গ্রহটি যেমন প্রচণ্ড উত্তাপে প্রায় তরল, তেমনই দূরতম প্রান্তে অবস্থান করছে এক হিমশীতল নরক। মাঝের অংশের গ্রহগুলোতে প্রাণের বিকাশের বিপুল সুযোগ। একদিন নিশ্চয়ই উর্বর কোনো সভ্যতা গড়ে উঠবে তাদের বুকে।

আমার আলো ভালো লাগে, উত্তাপ ভালো লাগে। তাই আমি বাসা বেঁধেছিলাম সূর্যের কাছের এই ছোট্ট আকারের দ্বিতীয় গ্রহে। এখানে আবহাওয়া চরমপন্থী, বাতাসের চাপ অত্যধিক। পুরু অ্যাসিড বাষ্প সর্বক্ষণ এক ময়লা হলদেটে ঘন মেঘের চাদরে ঢেকে রাখে এখানের আকাশ। এমনকি সূর্যের সবচেয়ে কাছের তরল গ্রহটির চেয়েও বেশি উত্তপ্ত এই গ্রহের বিষাক্ত বাতাস!

আর দিন দিন সেই উত্তাপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এই নোংরা পরিবেশ আমার জন্য নয়।

সূর্যের তৃতীয় গ্রহ আমায় টানছে।

জল আছে ওখানে…বাতাস আছে, অক্সিজেন আছে… আমার বিশ্বাস ওখানেই একদম গড়ে উঠবে এই মহাবিশ্বের শ্রেষ্ঠ সভ্যতা। চোখের সামনে তার শুরু থেকে শেষ দেখতে চাই আমি।

ওই সামনেই যে নীলচে সবুজ মাঝারি আকারের গ্রহটা। ক্রমশ ঠান্ডা হচ্ছে ওর উপরিভাগ, তিনভাগ তরল আর একভাগ কঠিন আস্তরণের অনেক তলায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সৃষ্টির আগুন। গলিত ধাতু মেশানো সেই কেন্দ্রকে ঘিরে গড়ে সাবধানে উঠেছে একের পর এক পুরু পাথরের পাঁচিল। যথেষ্ট উত্তাপ আছে ওখানেও, আর আছে বিশাল খোলা নীল আকাশের ব্যাপ্তি, ঝড়-ঝঞ্ঝা-বজ্রপাত…আছে টগবগে ফুটন্ত হাইড্রোকার্বন সমুদ্র !

আর কি চাই আমার?

(৫)

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, সূর্যের তৃতীয় গ্রহ

স্থানীয় সময় : জুলাই 23, 2019 খ্রিস্টাব্দ

মৌনা কিয়া ইন্টারন্যাশনাল অবজারভেটরি, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ

"একটা জিনিস আমাকে ভাবাচ্ছে স্যার", চিন্তান্বিত দেখায় এডওয়ার্ড গ্রীন'কে।

"আমারও কিছু কিছু ব্যাপার নিয়ে খটকা লাগছে। তুমি কি ভাবছ শুনি!", প্রশ্ন করলেন প্রোফেসর ফিলিপস।

দুপুরে অদ্ভুত রেডিও ট্রান্সমিশনটা ডিকোড করতে পারার পর থেকেই সমস্যা সমাধানের বদলে আরো বেড়েই চলেছে। জনমানসে চাঞ্চল্য সৃষ্টি এড়ানোর জন্য নাসার নির্দেশে আপাতত কোথাও খবরটা প্রকাশ করা হয়নি, এমনকি সরকারি ভাবেও এখনও কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।

এই প্রজেক্টে নাসার সহযোগী ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো অবশ্য তাদের এক সন্দেহের কথা জানিয়েছে।

"স্যার, আমাদের সাধারণ নৃতাত্ত্বিক জ্ঞান অনুযায়ী আমরা জানি বাঁদরজাতীয় প্রাণী থেকে প্রথম দুপেয়ে মানুষ হোমো হ্যাবিলিসের উৎপত্তি মাত্র চব্বিশ লাখ বছর আগে, আর আধুনিক বিজ্ঞান কিংবা উন্নত মানবসভ্যতার বয়স তো আরো কম। সেইদিক দিয়ে হিসেবটা মিলছেনা ঠিকই, কিন্তু গতবছর অ্যানুয়াল মিটিংয়ে প্রোফেসর বসু কি বলেছিলেন মনে আছে?"

"ফসিল নিয়ে কিছু কি?", মনে করার চেষ্টা করেন প্রোফেসর।

"হ্যাঁ। সেই যে কনফারেন্সের একদম শেষে প্রাগৈতিহাসিক যুগের এলিয়েন ইনভ্যাসন নিয়ে যখন কথা উঠেছিল তখনই উনি বলেছিলেন, পৃথিবীর একদম উপরদিকের আলগা পাথরের স্তরের ফসিলগুলো তো স্রেফ কয়েক মিলিয়ন বছরের পুরোনো। কিন্তু আরও গভীরে প্রবেশ করলে অনেক নীচে যেসব পাথরের স্তরের বয়স প্রায় ইয়োসিন যুগের সমসাময়িক, সেখানে বিভিন্ন মৌলের রাসায়নিক পরীক্ষা করলে, তার অনুপাত ঠিক আমাদের মত গ্রহজোড়া উন্নত সভ্যতার সাথে ঠিক মিলে যায়।"

এইবার একটু বিরক্ত হন প্রোফেসর, "এই দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমাদের আগেও পৃথিবীতে কাটিয়ে যাওয়া উন্নত বুদ্ধিমান প্রাণীদের কথা বলছ, তাও সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন বিবর্তন সবে কৈশোরে পা দিচ্ছে? ধুর, ওটা নেহাত কল্পবিজ্ঞানের খোরাক"

"না স্যার। এতদিন পর্যন্ত প্রমাণের অভাবে হয়তো আজগুবি গালগল্পই ছিল সেটা তবে এখন আর নেই। ইয়োসিন ইপকে পৃথিবীতে কি হয়েছিল একবার ভেবে দেখুন…"

(৬)

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, সূর্যের তৃতীয় গ্রহ

আমি কি?

আমিই প্রথম, কিন্তু আমি শেষ না।

আজ থেকে আরও কোটি কোটি বছর আগে যখন এই নীল গ্রহে এসে নেমেছিলাম, এখানে তখন আবহাওয়া ভয়ঙ্কর। আকাশে সর্বক্ষণ ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা, আর তার সাথেই প্রচণ্ড বজ্রবিদ্যুত, মুষলধারে বৃষ্টিপাত। ঘূর্ণিঝড়ে কাঁপতে থাকে স্থলভাগ। অ্যাসিড বৃষ্টি আর বজ্রপাতের মধ্যে প্রবল তড়িৎ প্রবাহের ধাক্কায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল উল্কার বেগে মহাকাশ থেকে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে নেমে আসা আমার বায়বীয় শরীর, সৃষ্টির পর আরও একবার ছোটো থেকে আরো ছোটো খন্ডে বিভক্ত হয়েছিলাম আমি। এক আমি থেকে বহু আমি, শুধু এক সুতোয় বাঁধা আমাদের চেতনা।

তবে আমার মৃত্যু হয়নি।

শুধু আমার দরকার ছিল শক্তি।

বিপুল শক্তির নিরন্তর যোগান ছাড়া কেমন করে পূরণ হবে আমার আদিম মহাজাগতিক খিদে?

আমার জন্ম এই উষ্ণ সৌরজগতের বহু নিযুত কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের মহাশূন্যের কোনো অজ্ঞাত অন্ধকূপে, যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনারও অতীত।

তারপর কত বছর ধরে ভেসে চলেছিলাম আমি জানিনা, অসাড় একতাল মেঘের মত মহাকর্ষের স্রোতে বেঁকে চুরে যাওয়া অলিগলি দিয়ে বয়ে গিয়েছি এক নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে অন্য নক্ষত্রপুঞ্জে, শক্তির সন্ধানে, অফুরন্ত খাদ্যের সন্ধানে…

আমি কি?

জীবিত না মৃত? না দুইয়ের মাঝে এমন কিছু যার সংজ্ঞা নেই বিজ্ঞানে ?

একা লাগে আমার।

সত্যিই কি আমার জন্ম আলোর ধংসের জন্যই? আলো আর অন্ধকারের মাঝে ভারসাম্য রাখাই আমার কাজ?

এই গ্রহের জলভাগেই বৃষ্টির সাথে ঝরে পড়েছিলাম আমি। সমুদ্রের উপরিতলে ভেসে ছিল আমার সহস্র কোটি খন্ডে খণ্ডিত ক্ষুদ্র দেহাবশেষ। মহাসাগরের ফুটন্ত জলে মিশে থাকা অজস্র জটিল যৌগকে ঘিরে ঘনীভূত হতে শুরু করেছিল আমার শরীর। আর তার ফলেই সেই ভয়ঙ্কর আবহাওয়ায় সবকিছু একসাথে এসে এক অদ্ভুত জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরি হয়েছিল প্রথম কোষ, প্রথম প্রাণ। জড় থেকে জীবনের উৎপত্তি ঘটেছিল …যেমন বারবার হয়ে এসেছে এই মহাবিশ্বে, আমারই হাত ধরে।

তারপর কেটে গেছে কত লক্ষ লক্ষ বছর। এককোষী জলজ প্রাণ থেকে বহুকোষী উদ্ভিদ আর প্রাণীদের উৎপত্তি হয়েছে আমার চোখের সামনে। আর পুরোটা সময় আমি থেকে গেছি সবার আড়ালে। আস্তে আস্তে কাছে এসেছে, ঘনীভূত, একীভূত হয়েছে আমার দেহখণ্ড, জোড়া লেগে সম্পূর্ন হয়েছে আমার প্রাচীন শরীর।

ভূপৃষ্ঠ শীতল হলেও ভূগর্ভের অভ্যন্তরে এখনও কয়েকশো মাইল পুরু পাথরের প্রাচীরের নিচে জেগে রয়েছে সৃষ্টির প্রথম সেই আগুন, গলিত ধাতু আর পাথরের মিশ্রণে এখনও জ্বলছে সে, অতুল শক্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। তাই সমুদ্রতলে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমি। সমুদ্রের উপরিতল থেকে বহু যোজন নীচে, যেখানে সূর্যের আলোর সামান্য আভাটুকুও পৌঁছায় না, যেখানে জীবজগতের স্বাভাবিক নিয়ম কাজ করে না, সেই গভীরতম অংশের চিরআঁধারের দেশে নিঃশব্দে বাসা বেঁধেছিলাম আমি। শীতল অন্ধকারই যে আমার পরিচয়।

সমুদ্রের এই অংশে বাস করি শুধু আমি, আর সামান্য সংখ্যক কিছু প্রাগৈতিহাসিক জলজ জীব। উপরিভাগের সঙ্গে এই এলাকার কোনো যোগাযোগ নেই। ছোট্ট এই সুন্দর গ্রহের পেটের মধ্যে এ যেন আরেক কোনো নতুন জগৎ। মহাকাশের স্থির, উন্মত্ত শূন্যতার থেকে মহাসাগরের জলের ছন্দময় প্রবাহের তালে নিজেকে আন্দোলিত করতে বেশি আনন্দ অনুভব করি আমি।

তারপর….এখানেই থেকে যাই আমি, বরাবরের মতো, কিংবা অন্তত আগামী কয়েক কোটি বছরের জন্য। আর অবিরাম শক্তি শোষণ চলতে থাকে সমুদ্রতল থেকে,ক্রমশ দ্রুত লয়ে বাড়তে থাকে আমার দেহের আকার। ধীরে ধীরে এই গ্রহের তিনভাগ সমুদ্রতলের সমস্তটাই জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হয়েছি আমি, আমার খণ্ডিত কিন্তু একত্রিত দেহের আস্তরণের নীচে ঢাকা পড়ে গিয়েছে নীচের পলি, বালি আর পাথরের স্তর। আমার পূর্ন বিকাশ ঘটেছে।

আর সেটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল।

(৭)

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, সূর্যেরতৃতীয় গ্রহ

স্থানীয় সময় : ইয়োসিন মহাযুগ

আমি মূর্খ !

আমি হন্তারক

কয়েক কোটি সৌরজগতের খুনের দায় নিয়ে আমি এখনও বেঁচে আছি, বেঁচে থাকব।

আমার কোনো বয়স নেই…জন্ম নেই, মৃত্যু নেই।

কারণ, আমিই সাক্ষাৎ মৃত্যু।

আজ বহু সহস্রাব্দের পর, লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ ভ্রমণের পর আমার আদিম স্মৃতিতে সম্পূর্ন হয়ে উঠেছে আমার কাহিনী।

আমি যেখানেই গিয়েছি, সর্বনাশ ঘটিয়েছি শুধুই। যে সৌরজগতে আমার পা পড়েছে, স্রেফ অন্ধকার নেমে এসেছে সেখানে।

আমার আদিম সত্ত্বা বুদ্ধিমান না, আসলে সে এক বুভুক্ষু পশুর মত। যুগ যুগ আমার সমগ্র অস্তিত্ব স্রেফ এক ঘৃণ্য রিপুর দ্বারা চালিত!

আমি মহাকাশে ঘুরে বেড়িয়েছি এ যাবৎ আমার গোটা জীবনকাল। জ্ঞানের জন্য না, বিনোদনের জন্য না, সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্যও না…এক মৃত নক্ষত্রের বুক চিরে উঠে এসে অন্য ছায়াপথের উজ্জ্বল আলোর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছি আমি, অসীম খিদে নিয়ে শুষে নিয়েছি সমস্ত আলো, উত্তাপ, শক্তি, তারুণ্য… আমার পিছনে ফেলে এসেছি শুধু অন্ধকার আর মৃত্যুর বর্ণহীন শীতলতা, ঠিক স্থবির এই মহাকাশের মতোই।

যেদিন সব আলো নিভে যাবে, থেমে যাবে সাজানো বাগানের মতো, গণিতের নিয়মে চালিত সূক্ষ সকল গতি…সেদিন সব খাবারও ফুরিয়ে যাবে। আবার এক মহাবিশ্বের অকাল মৃত্যু ঘটবে আমার হাতে।

তবু আমার অভিশাপ শেষ হবে না।

অনাহারে আমার মৃত্যু হয় না, মহাশূন্যের কবরখানার বাইরে আমি নিদ্রামগ্ন হই।

তারপর একদিন আবার সময় হয়ে আসবে। আবার কাছে আসবে মহাজাগতিক এই মৃত্যুপুরীর সমস্ত কণা, পদার্থ, শক্তি…পুঞ্জীভূত হবে এক বিন্দুতে…তারপর মহাবিস্ফোরণ।

আবার জেগে উঠব আমি।

এই সৌরজগতের দ্বিতীয় গ্রহের বুকেও অবশ্যই সৃষ্টি হতে পারত প্রাণ। মূর্খ আমি খাদ্যের লোভে ঘিরে ধরেছিলাম তার সমগ্র উপরিতল, কয়েক হাজার কোটি বছর ধরে অভ্যন্তর থেকে ক্রমাগত শোষণ করেছি শক্তি আর সেই তাপ বিকিরণ করেছি বায়ুমণ্ডলে, উত্তপ্ত নরকের মতো হয়ে উঠেছে আবহাওয়া, তৈরি হয়েছে বিষাক্ত রাসায়নিক মেঘের চাদর। নিজের হাতে প্রাণের বিকাশের সামান্য সম্ভাবনার শেষ লিখে দিয়ে এসেছি আমি।

কিন্তু এই সুন্দর নীলগ্রহের বুকে ভাগ্যক্রমে তেমন ঘটতে পারেনি। প্রথমেই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম আমি, তাই বিপর্যয় ঘটেনি। আর সেই আমার থেকেই জন্ম নিয়েছে এই মহাজগতের প্রথম স্বতস্ফূর্ত প্রাণ। কিংবা দ্বিতীয়…আমার পরে।

আজ আমার জন্য সেই প্রাণের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠেছে হঠাৎ। গোটা সমুদ্রতল ঢেকে ফেলেছি আমি, গ্রহ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আমার দানবীয় শরীর প্রতি মুহূর্তে বাতাসে ত্যাগ করছে লাখ লাখ ক্যালোরি শক্তি আর তাতে আশঙ্কাজনক ভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলও, আকস্মিক ভাবে আমূল বদল এসেছে আবহাওয়ায় । সেই মারাত্মক পরিবর্তন সইতে না পেরে এর মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে বহু উদ্ভিদ, ছত্রাক, অণুজীব আর প্রাণী। যে কটি প্রজাতি এখনও টিকে আছে ওরাও বা আর কতদিন!

আমি তা হতে দিতে পারিনা। কেন? আরও অনেক অজানা ' কেন ' র মতো এরও কোনো জবাব বা ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে।

আমি জানি সৃষ্টির প্রথম লগ্নে সেই কবেই আর দেহ থেকে আলাদা হয়ে অজস্র সৌরজগতে, নীহারিকার বুকে ছড়িয়ে পড়েছিল আমারই অংশ। গোটা মহাবিশ্ব জুড়ে আরো কত শত অজানা প্রান্তে এই মুহূর্তে আধিপত্য বিস্তার করছে, পূর্ন আকার ধারণ করে সমস্ত কিছু গ্রাস করে নিচ্ছে আমারই প্রতিভূ, অন্য 'আমি'রা। তারা কি ভেবে দেখে তাদের কাজের ফলাফলের কথা? না শুধু নিজের বাঁচার আদিম তাগিদটা কেবল চালনা করে তাদের? তাদের কি কষ্ট হয় আমার মত, জাগে অপরাধবোধ? তারা কি আমার মত চিন্তা ভাবনা মধ্যে পারে আদৌ? না শুধুই তারা সর্বভুক প্রাচীন বিভীষিকা হিসেবে পরিচিত হয়েছে তাদের জগতে ?

আমি জানি না। জানতে চাই না। এই গ্রহ আমার প্রিয়।

কয়েক সহস্র সৌরজগতের লক্ষ কোটি গ্রহ উপগ্রহের মধ্যে কদাচিৎ একটিতে স্বতস্ফূর্ত সৃষ্টি হয় প্রাণের…

এই পৃথিবী তেমনই এক ভাগ্যবান। আমি একে শেষ হয়ে যেতে দেব না।

ভূখণ্ড জুড়ে জালের মতো শিকড় গেড়ে বসা সিডার গাছ, সেই গাছের ডালেই বসে জীবনের গান গেয়ে চলা পাখি, সামনের দিগন্তবিস্তৃত তৃণভূমিতে খেলে বেড়ানো ঘোড়া কিংবা মহাসাগরের স্রোতের তালে নেচে চলা ডলফিন আর তিমি…কাউকেই হারিয়ে যেতে হবে না।

আজ এতগুলো বছর পরেও এখনও কোনো বুদ্ধিমান উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটেনি এই গ্রহের বুকে। তবে ঘটবে, খুব শীঘ্রই, আমি নিশ্চিত জানি। তাকে এভাবে মুছে যেতে হবে না।

অন্তত আমার জন্য না।

আমি জানি আমায় কি করতে হবে।

(৮)

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, সূর্যের তৃতীয় গ্রহ

স্থানীয় সময় : 14ই আগস্ট, 2019

অ্যানুয়াল কনফারেন্স অন ক্লাইমেট সায়েন্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোবায়োলজি

ইসরো হেডকোয়ার্টার্স, থিরুভনন্তপুরম, ভারত

"স্যার, অ্যাবাউট টাইম"

ডেলিগেট সিটের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে গেল জোসেফ। জোসেফ পেরুমল আইয়ার, সেন্টার ফর হিউম্যান জেনেটিক্সের তরুণ বায়োইনফর্মেটিক্স বিশেষজ্ঞএবং গবেষক।

আজকে ইসরোর এই বার্ষিক সম্মেলনে তাদের তরফ থেকে এখানে যে বক্তৃতাটি রাখা হবে, সেটার মূল খসড়া তারই লেখা। গত তিন বছর ধরে তাদের টিমের তেরোজন গবেষক মিলে প্রায় দিনরাত এক করে যে অমানুষিক পরিমাণ কাজ করেছেন আজই প্রথম প্রকাশ হবে তার আশ্চর্য ফলাফল।

ডায়াসে রাখা মাইকটা স্ট্যান্ড থেকে খুলে হাতে তুলে নিলেন প্রোফেসর রণেন বসু, স্টেজের উপরের বাকি আলো গুলো নিভে গেল, শুধু একটা মৃদু হলদে আলোয় উজ্জ্বল হয়ে রইল তাঁর দীর্ঘ অবয়ব। গোটা হলে চাপা গুঞ্জন। বিষয়বস্তু পুরোটা না জানলেও বাইরের বিশাল ভিনাইল বোর্ডগুলোয় লেখা আছে আজকের লেকচারের শিরোনাম : "দ্য গ্রেট ইনক্লুসন- প্রাগৈতিহাসিক ভাইরাস এবং জীবজগৎ"।

মাইকে দুটো টোকা দিয়ে টেস্ট করে নিলেন তিনি। তারপর গলা ঝেড়ে নিয়ে শুরু করলেন,

"গুড ইভনিং, অল মাই ওয়ান্ডারফুল কলিগস অ্যান্ড ফেলো সায়েন্টিস্টস প্রেজেন্ট হিয়ার, টুডে।

আজকের এই লেকচারের শিরোনাম আপনারা দেখেছেন। কেউ কেউ হয়তো একটু অবাকও হয়েছেন, আমার মতো জিন বিশেষজ্ঞ হঠাৎ ভাইরাস আর জীবজগতের সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে কেন?

ঠিক এই একই রকম অবাক আমিও হয়েছিলাম মাস দুয়েক আগে। সেদিন আমার রিসার্চ পার্টনার ডক্টর পেরুমল এসেছিল কিছু রুটিন অ্যানালিসিসের রেজাল্ট দেখাতে। কিন্তু দেখতে বসে দুজনেই খেয়াল করলাম, গন্ডগোল আছে কিছু, বড়সড় কোনো গন্ডগোল। নাহলে, হিউম্যান জিনোম আর ইন্ডিয়ান গ্রেট লিজার্ড, দুই দূরসম্পর্কের প্রাণীর সিকোয়েন্সে খুব চেনা অন্য একটা জিনোম কি করে ঢুকে থাকতে পারে। সেই চেনা জিনোমটা ঠিক কার সেটা বুঝতেই আমাদের আরো এক সপ্তাহ লেগে গেল। এর মধ্যে জানা গেল একইরকম জিনিস প্রায় একই অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছে ব্যাকটেরিয়া আর ফাঙ্গাসদের জিন সমষ্টিতেও। আরও অনেক সিকোয়েন্সিং আর ডেটাবেস সার্চের পর উত্তরটা জানতে পারলাম আমরা - ভাইরাস।"

একটু থেমে আবার শুরু করলেন প্রোফেসর বসু। মাঝে মাঝে দর্শকদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য এই বিরতিটুকু দরকার।

"মানে? অবাক হচ্ছেন? আমারও প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া সেটাই ছিল।

মানেটা এখন পুরোটাই পরিষ্কার। শুধু মানুষ কেন, আজকের পৃথিবীতে বিবর্তিত আধুনিক যেকোনো জীবের জিনোমের মধ্যে একটা বিরাট অংশ, প্রায় আশি থেকে নব্বই শতাংশই হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ক্রিয়, যাকে আমরা জীববিদ্যায় বলি হেটেরোক্রোমোজোম। এই ক্রোমোজোমের জিন সমষ্টি আমাদের শরীরের নিয়মিত যেসব জৈব প্রক্রিয়া চলছে নিরন্তর, তাতে সাধারণত হস্তক্ষেপ করে না। তাহলে এই বিশাল পরিমাণ জিন সংগ্রহ কোষের ভিতর কি স্রেফ আবর্জনা ?"

চোখ চকচক করে উঠছে তাঁর। এরপর যেটা বলবেন সেটা কেউ বিশ্বাস করবে কি না তিনি এখনও নিশ্চিত না, তবে তিনি তৈরি হয়েই এসেছেন। যুক্তিগ্রাহ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ দেখানোর মত সূত্র আছে হাতে।

তবু স্লাইড চেঞ্জ করতে গিয়ে হাতটা একটু কেঁপে গেল তাঁর।

"না। অবশ্যই না। আমরা খুঁজে পেয়েছি সমস্ত আধুনিক প্রাণীর জিনোমের এই অংশের ডিএনএ সিকোয়েন্স প্রায় হুবহু মিলে যায় ভাইরাসদের সাথে। তবে আধুনিক যুগের কোনো স্ট্রেন না। নিউক্লিওটাইড সিকোয়েন্সে কিছু চারিত্রিক মিল থাকায় চেনা গেলেও, সম্পূর্ন জিনোমের নিরিখে এই ভাইরাস বা ভাইরাস সদৃশ বস্তু আমাদের চেনাজানা ভাইরাসের থেকে ভীষণ অনুন্নত, বহু কোটি বছরের বিবর্তনের ব্যবধান মাঝখানে। এই ভাইরাসদের বয়সের কোনো গাছ পাথর নেই, তাদের খোদ পৃথিবীর থেকেও পুরোনো বলে অনেকে মনে করেন। তাই এরাও কিন্তু একধরনের ফসিল, যারা সম্ভবত প্রাণীদেহে এসে ঢুকেছিল মানুষের উৎপত্তিরও বহু লক্ষ বছর আগে। অর্ধমৃত, নিষ্ক্রিয় অবস্থায় লুকিয়ে থাকা প্রাগৈতিহাসিক দেহাবশেষ। হয়তো সরাসরি কাজে অংশ নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে তারা, কিন্তু ক্রোমোজোমের মূল গঠনগত ভিত্তি এই হেটেরোক্রোমোজোমই। এই ভাইরাসের জন্যই মরুভূমির শুকনো মাটিতে শিকড় ছড়াতে পারে গাছ, এই ভাইরাসের জন্যই অন্য ক্ষতিকর অণুজীবের থেকে রক্ষা পাই আমরা।

এই নিয়ে এখনও আরো অনেক কাজের দরকার। তবু অন্তত এইটুকুই বোঝা গেল যে ভাইরাস স্রেফ ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টিকারী মারণ বিভীষিকা না। আমাদের এই গ্রহের জল স্থল বায়ুমণ্ডল জুড়ে যেমন গড়ে উঠেছে বিশাল এক বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র, তেমনই পরসানুবিক্ষণিক এক বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে প্রতিটি জীবের দেহের ভিতরেও। ভাইরাসদের বা তাদের কয়েক হাজার কোটি বছর আগের অপরিচিত কোনো পূর্বপুরুষের কল্যাণেই গড়ে উঠেছে সেটা, যেটা ছাড়া এই গ্রহের ক্রমশ পরিবর্তনশীল পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকা সম্ভব হতো কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

তাই আমি আর নাম দিয়েছি - দ্য গ্রেট ইনক্লুসন। থ্যাংক ইউ"

মাইক নামিয়ে রেখে নমস্কার জানালেন প্রোফেসর বসু।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গোটা হল ফেটে পড়েছে হাততালিতে। অল্প কিছু মানুষের চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছাপ ঢাকা পড়ে গেল সেই উচ্ছ্বাসের জোয়ারে।

(৯)

আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, সূর্যের তৃতীয় গ্রহ

স্থানীয় সময় : ইয়োসিন মহাযুগ

ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। আবার বহু কোটি বছর আর অনেকগুলো মহাযুগ পেরিয়ে সমুদ্রের অতল গভীরতা ফুঁড়ে জলতলে উঠে এল আমার স্বচ্ছ বায়বীয় শরীর। জলজ প্রাণীরা অবাক হয়ে দেখল এক আশ্চর্য আস্তরণে ঢেকে যাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠ।

তারপর…ছিটকে উঠলাম আমি। একটানে আমি সোজা উঠে এলাম বায়ুমণ্ডলের বাইরের দিকে, চাদরের মতো ঘিরে ফেললাম পৃথিবীকে। প্রথম এবং শেষবারের মতো।

তারপর একদমে বুক ভরে শুষে নিলাম বায়ুমণ্ডলের সমস্ত অবশিষ্ট শক্তি, সমস্ত আবদ্ধ তাপ।

আর তারপরই…এর আগের বহুবারের মত ভেঙ্গে গেলাম আমি।

বিপুল পরিমাণ তাপশক্তির চাপ সইতে না পেরে ফাটল ধরল আমার অঙ্গে অঙ্গে, নিঃশব্দে চূর্ন বিচূর্ণ হয়ে ধুলোয় মিশে গেলাম আমি, আমার যাওয়ার আগে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেল সমস্ত শোষিত তাপ। যেমন হঠাৎ হয়েছিল বিশ্ব উষ্ণায়ন, তেমনই আচমকা গোটা গ্রহ জুড়ে নেমে এল চতুর্থ হিমযুগ।

আর আমি?

ফিরে গেলাম আমার সৃষ্টির আদিম রূপে, অসীম সংখ্যক বিন্দু হয়ে অঝোর ধারায় ঝরে পড়লাম পৃথিবীর বুকে।

কেউ কি জানতে পারল আমার কথা ? অনেক অনেক নীচের ভূপৃষ্ঠ থেকে কোনো কৌতূহলী জীব কি মুখ তুলে তাকাল আকাশের দিকে? তাকালে হয়তো দেখতে পেত, উপর দিকে ক্রমশ উঠে যাচ্ছে এক স্বচ্ছ ধোঁয়াটে মেঘ, আস্তরণের মত ঘিরে ফেলছে দিগন্তজোড়া আকাশ বাতাস আর তারপর.…হঠাৎ যেমন এসেছিল তেমনই এক লহমায় - আর  নেই.. হয়তো আরো অনেক মহাযুগ পর যেদিন উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটবে এই পৃথিবীতে, কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী সেদিন আবিষ্কার করবে ভূগর্ভের পাথরের মধ্যে রেখে যাওয়া আমার পারমাণবিক চিহ্ন, আমার বিকিরণ আর শক্তির স্বাক্ষর।

কিন্তু আমার মৃত্যু হল না।

আমার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই।

আমার আকার নেই। মহাকালের স্রোতে ভাসতে ভাসতে সময়ের খেলায় স্রেফ এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তর।

আরেকবার নতুন রূপ নেওয়ার সময় হয়েছে এইবার। আবার ঘনীভূত হতে শুরু করলাম আমি, বা আমার কয়েক হাজার ছিন্ন ভিন্ন বিন্দুর মত দেহাংশ, বায়বীয়তা মুছে গিয়ে তৈরি হল নূন্যতম আয়তনের অজস্র সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরা আণুবীক্ষণিক কণা। কিন্তু একিভূত হলাম না।

আর তারপর পৃথিবীর বুকে নেমে আসার পর, বিভিন্ন পথে প্রবেশ করলাম জীবদেহে। নির্বিচারে, যে কয়টি উদ্ভিদ আর প্রাণী প্রজাতি টিকে ছিল এখনও, তাদের প্রত্যেকের দেহে প্রবেশ করল আমার আণবিক শরীর। আর মিশে গেল কোষের সবচেয়ে ভিতরের সবচেয়ে সুক্ষ তন্ত্রীর মত গঠনে, যা জীবনের কার্যগত আর গঠনগত একক, যা এই গ্রহে পরবর্তীকালে পরিচিত হবে ডিএনএ অথবা জিন নামে।

কেউ সাক্ষী রইল না।

শুধু জানলাম আমি আর এই প্রিয় নীলগ্রহের অক্সিজেনপূর্ন স্বর্গের মতো খোলা বাতাস।

আমি খুশি। আমি পেরেছি। বাইরে থেকে না, বরং জীবনের গভীর অভ্যন্তরে অন্তর্নিহিত হয়েই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাব আমি। আরও কয়েক হাজার প্রাণের মাঝেই একসাথে, অবিচ্ছিন্ন ভাবে বেঁচে থাকবে আমার সত্ত্বা, আরো কোটি কোটি বছর। যতদিন এই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন…

আমি কে?

আমি আসলে কি?

যুগ যুগ ধরে কেই বা দিয়েছে আমায় এই গুরুভার?

উত্তরটা এখনও জানা নেই…কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে সেটা..

এখন অপেক্ষা, অনন্ত ঘুম।

আবার জেগে উঠব কখনও, অন্য কোনো আমি হয়ে, অসীম মহাকাশের অন্য কোনো অন্ধকার প্রান্তে।

তারপর, আরও এক বার…মহাবিস্ফোরণ।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb