আদিত্য এল-১ কৃত্রিম উপগ্রহ

লেখক - তপন কুমার বিশ্বাস


 

আকাশ জুড়ে তারার মেলা। অধিকাংশই  আমাদের চেনা ছায়াপথ গ্যালাক্সির নক্ষত্র।  ছায়াপথ গ্যলাক্সিতে রয়েছে কমপক্ষে দশ হাজার কোটি ছোটোবড়ো বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন বয়সের নানাধরণের নক্ষত্র। ছায়াপথ গ্যালাক্সির বাইরে সমগ্র মহাবিশ্বে কমপক্ষে দশহাজার কোটি গ্যলাক্সি রয়েছে , একলক্ষ কোটিও হতে পারে। মহাবিশ্বের মোট তারাদের সংখ্যা তাই লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি।  মহাবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এতো অসংখ্য তারাদের সম্পর্কে অকিঞ্চিতকর আমাদের জ্ঞান। টেলিস্কোপ আবিষ্কার, বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র ও পদ্ধতি ইত্যাদি  আবিষ্কার, পৃথিবীর মানমন্দির ও বায়ুমন্ডলের বাইরের মহাকাশে স্থাপিত টেলিস্কোপ ইত্যাদি অবশ্য প্রতিদিনই এসব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বহুগুণ বাড়িয়ে চলেছে। মহাবিশ্বের মোট নক্ষত্রসংখ্যার মাত্র অতি নগন্য   সংখ্যক নক্ষত্র সম্পর্কে আলাদা করে বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করা গিয়েছে। কেবলমাত্র দূরত্বজনিত ব্যবধানের কারণেই অসংখ্য নক্ষত্র সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। বহু নক্ষত্র থেকে এখনো পর্যন্ত  আলো এসেই পৌঁছায়নি  পৃথিবীতে।  

 

সৌভাগ্যক্রমে আমাদের একেবারে হাতের কাছে রয়েছে এক মাঝারি আকারের  সক্রিয়  নক্ষত্র, যাকে আমরা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারি। সেটি আমাদের সূর্য। পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সূর্য পৃথিবীর সমস্ত শক্তির উৎস; আবহাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। পৃথিবীর জীবনপ্রবাহ সূর্যের উপর নির্ভরশীল; প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান যুগে আরো বেশী বেশী করে নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবন এখন জিপিএস,  ইন্টারনেট নির্ভর : রেডিও ও দূরদর্শন (টেলিভিশন), টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিমান ও জাহাজ চলাচল, রেলওয়ে আসন সংরক্ষণ বা ট্রেনের অবস্থান জানা, আবহাওয়ার মতিগতি বোঝা, সমুদ্রে মাছের ঝাঁকের অবস্থান জানা, টেলিমেডিসিন ও টেলি-কনফারেন্সিং ইত্যাদির জন্য এসব  অপরিহার্য। এগুলি সবই পৃথিবী থেকে বিভিন্ন উচ্চতায় স্থাপন করা নানা ধরণের কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে গড়ে উঠেছে। কৃত্রিম উপগ্রহ বিগড়ে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাটাই বিপর্যস্ত হয়ে যাবে।

প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হওয়া সূর্য এক উত্তাল অগ্নিকুন্ড। এর কেন্দ্র এলাকায় পারমানবিক সংযোজনে (নিউক্লিয়ার ফিউশন)  হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামে রূপান্তর হওয়ার  প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হচ্ছে প্রায় দেড় কোটি  সেলসিয়াস তাপমাত্রা। তাপশক্তি, নিউট্রিনো কণিকা,  অতি শক্তিশালী বিকিরণ, আয়নিত হাইড্রোজেন তথা প্রোটন, আয়নিত হিলিয়াম ও অন্যান্য কণিকা, অতি শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র   ইত্যাদি সূর্যদেহ ভেদ করে  ছড়িয়ে পড়ছে  সৌরমণ্ডল জুড়ে। মিলিতভাবে এগুলো নিয়েই সৌরবায়ু প্রবাহ (সোলার উইন্ড)। এগুলো নিয়েই মহাকাশ আবহাওয়া (স্পেস ওয়েদার)।  সূর্য মাঝে মধ্যে যখন অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন প্রচন্ড শক্তিশালী কণিকাপ্রবাহ, প্রচন্ড শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র ও বিকিরণ, চারপাশে প্রবল গতিতে ছড়িয়ে পড়ে, যাকে সাধারণভাবে বলা হয় সৌরঝড় (সোলার স্টর্ম)। পৃথিবীর দিকে এই ঝড় ধেয়ে এলে, বা পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছে গেলে, এর ফলে প্রভূত ক্ষতির সম্ভাবনা  থাকে।  সূর্য পর্যবেক্ষণ  করে এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান এখন মানব সভ্যতার পক্ষে অপরিহার্য।   তাছাড়া  মহাবিশ্বে একই ধরনের  অন্যান্য নক্ষত্রদের সম্পর্কেও একটা ধারণা করা যায়, বিভিন্ন তত্ত্বকে যাচাই করে নেওয়া যায়,  তথ্যের আলোকে পরিমার্জিত করে নেওয়া যায়।

পৃথিবীর মানমন্দিরগুলি (অবজারভেটরি) এখন অনেক বেশী উন্নত ও সুক্ষ্ম। কিন্তু  একটা সীমাবদ্ধতা আছে, যা পৃথিবীপৃষ্ঠের মানমন্দিরগুলির পক্ষে লঙ্ঘন করা কোনদিনই সম্ভব নয়। সূর্য থেকে বা সৌরমন্ডলের বাইরের মহাকাশ থেকে অগণিত গ্যালাক্সির অগণিত নক্ষত্র থেকে প্রায় সমস্ত তরঙ্গদৈর্ঘের যেসমস্ত বিকিরণ  পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে, তার একটা অংশ বায়ুমন্ডলে শোষিত হয়ে যায়; প্রাণঘাতী  বহু বিকিরণ পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছাতেই পারে না। স্বভাবতই সূর্য থেকে ছুটে আসা সব বিকিরণের হালহকিকত পৃথিবীর মানমন্দির বা কোনো পরীক্ষাগারের পক্ষে জানা ও বোঝা সম্ভব নয়। জানতে গেলে, পরীক্ষানিরীক্ষা  করতে গেলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে পরীক্ষাগার স্থাপন করা ছাড়া নান্য পন্থা। আস্ত মানমন্দির তো আর পৃথিবীর বাইরে কক্ষপথে বসিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই পৃথিবীর কাছাকাছি কক্ষপথে সীমিত ক্ষমতার উপযুক্ত কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের পরিকল্পনা।  রাশিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি, জার্মানি,  চীন ইতিমধ্যেই পৃথিবীর কাছাকাছি কক্ষপথে এরকম কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করেছে। মহাকাশ থেকে সূর্যকে নিরন্তর পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে, এইবছর ২০২৩ সালের জুন-জুলাই নাগাদ আদিত্য এল১ কৃত্রিম উপগ্রহ কক্ষপথে স্থাপন করতে চলেছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো। এটিই হবে ভারতের প্রথম সূর্য পর্যবেক্ষণকারী কৃত্রিম উপগ্রহ।

আদিত্য এল১ স্থাপন করা হবে সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যেকার এল১ ল্যাগর‍্যাঞ্জ বিন্দুর চারপাশের এক কিরীট কক্ষপথে (হ্যালো অরবিট)।  পৃথিবী ও সূর্যের ক্ষেত্রে ল্যাগর‍্যাঞ্জ বিন্দু এল১,  পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মোট পাঁচটি ল্যাগর‍্যাঞ্জ বিন্দু আছে সূর্য ও পৃথিবী সিস্টেমে।  এগুলি হল এল১, এল২, এল৩, এল৪ এবং এল৫; এদের মধ্যে এল১, এল২, এল৩ এগুলির আবিষ্কর্তা লিওনহার্ড অয়লার।  এল৪, এল৫ আবিষ্কার করেছেন জোসেফ-লুইস ল্যাগর‍্যাঞ্জ, তাঁর নামেই সব বিন্দুগুলির নাম।   এল১ বিন্দু সূর্য ও পৃথিবীর সঙ্গে একই সরলরেখায় সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থিত। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি  কিলোমিটার, কিন্তু পৃথিবী থেকে এল১ এর দূরত্ব ১৫ লক্ষ কিলোমিটার,  অর্থাৎ পৃথিবী-সূর্যের দূরত্বের মাত্র এক শতাংশ।  এখানে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের সুবিধা হল এই যে, এখান থেকে সারা বছরজুড়ে সবসময় সূর্যকে দেখতে পাওয়া যাবে; কখনো আড়াল হবে না। এটি এক মস্তবড়ো সুবিধা। আর অত্যন্ত কঠিন বিষয় হলো, ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে কিরীট কক্ষপথে (হ্যালো অরবিট)  আদিত্য এল১ স্থাপন করা ও ঐখানে এটিকে তারপর সুস্থির (স্টেবল) রেখে দেওয়া। পৃথিবী থেকে একবারে এই কক্ষপথে আদিত্য এল১ স্থাপন না করে, প্রথমে এটি পৃথিবী সমীপবর্তী কক্ষপথে (নিয়ার আর্থ অরবিট) স্থাপন করে, তারপর  ধাপে ধাপে ক্রমশঃ কক্ষপথটিকে লম্বাটে গড়নের করতে করতে একেবারে শেষে এল১ এর কিরীট কক্ষপথে স্থাপন করা হবে।   উৎক্ষেপণের পর  কক্ষপথে পৌঁছাতে সময় লাগবে মোটামুটি চারমাস। উৎক্ষেপণ করা হবে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় অবস্থিত ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ISRO) সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে। দিনক্ষণ এখানো স্থির  হয়নি।

সূর্য পর্যবেক্ষণের জন্য আদিত্য এল১ সঙ্গে নিয়ে যাবে সাতটি অত্যাধুনিক ও অতি সংবেদী যন্ত্র (ইনস্ট্রুমেন্ট)। এগুলি হল : (১) ভ্যারিয়েবল এমিশন লাইন করোনাগ্রাফ, (২) সোলার আল্ট্রাভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপ, (৩) আদিত্য সোলার উইন্ড  পার্টিকলস এক্সপেরিমেন্ট,(৪) প্লাজমা অ্যনালাইজার প্যাকেজ  ফর আদিত্য, (৫) সোলার এনার্জি এক্স-রে স্পেক্ট্রোমিটার, (৬) হাই এনার্জি এল১ অরবিটিং এক্স-রে স্পেক্ট্রোমিটার, (৭) ম্যগনেটোমিটার। সবগুলিই সম্পূর্ণভাবে ভারতের বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়াররা ভারতের প্রখ্যাত সব গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তৈরী করেছেন। এখন চলছে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার কাজ।

সূর্যের কেন্দ্র এলাকায় তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি কেলভিন হলেও, আলোকমন্ডলে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় গড়ে ৫৭৭২ কেলভিন। কালো কালো রঙের সৌরকলঙ্ক এলাকায় তাপমাত্রা আরো কম। কিন্তু এরপর তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বর্ণমন্ডলে (ক্রোমোস্ফিয়ার) ২০,০০০ হয়ে কিরীটমন্ডলে (করোনা) তা এমনকি কোথাও কোথাও প্রায় দেড়কোটি দুকোটি কেলভিনে পৌঁছায়। কেন এই অভাবনীয়  তাপমাত্রা বৃদ্ধি তা এক অপার রহস্য। এখানে তো কোনো পারমাণবিক সংযোজন  হচ্ছে না! হতে পারে আলোকমন্ডলের নীচ থেকে অতিতপ্ত আয়নিত কণিকা, প্লাজমা, পরমাণু ইত্যাদি   চৌম্বকক্ষেত্রের খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে, সূর্যপৃষ্ঠ থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে আলোকমন্ডল বর্ণমন্ডলের ভিতর দিয়ে, কিরীটমন্ডলে পৌঁছিয়ে গিয়ে সেখানে মুক্ত হয়ে এমন ঘটাচ্ছে। কিন্তু এটি নিতান্তই এক অনুমান। সঠিক কারণ ও প্রক্রিয়া বোঝা দরকার। কিরীটমণ্ডল থেকে সেকেন্ডে ৪০০ থেকে ৮০০  কিলোমিটার বেগে মহাকাশে ধাবিত হয় মহাশক্তিশালী  কিরীটমন্ডলীয় ভর উৎক্ষেপ (করোনাল মাস ইনজেকশন)। এক একটি কিরীটমন্ডলীয় ভর উৎক্ষেপে প্রায় হাজার দেড় হাজার কোটি টন প্রচন্ড তপ্ত ও আয়নিত গ্যাসপুঞ্জ উৎক্ষিপ্ত হয় সূর্যদেহ থেকে। সূর্যপৃষ্ঠে মুক্তিবেগের চাইতে (সেকেন্ডে ৬১৭ কিলোমিটার) এই উৎক্ষেপনের বেগ কম হলে তা সূর্যে ফিরে আসে, নচেৎ পাড়ি জমায় আন্তর্গ্রহ মহাকাশে। যদি পৃথিবীর দিকে এটি উৎক্ষিপ্ত হয়, তাহলে তা পৃথিবীকে ঘিরে থাকা ভূচৌম্বক মন্ডলে  (ম্যাগনেটোস্ফীয়ার) প্রবেশ করে, চৌম্বক ক্ষেত্রের অদল বদল ঘটিয়ে দেয়; উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে সৃষ্টি করে উজ্জলতর মেরুজ্যোতি (অরোরা)। পৃথিবীর আয়নোস্ফিয়ারে পরিবর্তন ঘটায় ইত্যাদি।

অনুরূপ কারণে সূর্যপৃষ্ঠ থেকে উৎপন্ন বিশাল বিশাল ও অতি শক্তিশালী সৌরশিখা (সোলার ফ্লেয়ার) কখনো কখনো পৃথিবীর দিকে ধাবিত হয় এবং একই রকম প্রতিক্রিয়া ঘটায়। এগুলি কৃত্রিম উপগ্রহের  স্বাভাবিক কাজকর্মকে ব্যহত করে দিতে, এমনকি কৃত্রিম উপগ্রহকে সম্পূর্ণ বিকল করে দিতে পারে। মহাকাশযানের আরোহীদের ক্ষতিসাধন করতে পারে। উভয় গোলার্ধের উচ্চ অক্ষাংশের দেশগুলির বিদ্যুৎ সাবস্টেশন ও টেলিফোন কেন্দ্রগুলি হঠাৎ করে সাময়িকভাবে বিকল হয়ে যেতে পারে, আগুন লেগে যেতে পারে ইত্যাদি। এরকম ঘটনা অতীতে অনেকবার ঘটেছে। যদি সূর্যে কিরীটমন্ডলীয় ভর উৎক্ষেপ বা সৌরশিখার মত বিধ্বংসী ঘটনার পূর্বাভাস যথেষ্ট আগে দেওয়া সম্ভব  হয়, তাহলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে এসব ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো ভবিষ্যতে  নিশ্চয়ই সম্ভব হবে। তার জন্য এসব প্রক্রিয়ার উৎপত্তি ও  বিস্তার, শক্তিপ্রবাহের ধরণ ও মাত্রা ভালোভাবে জানা ও বোঝা প্রয়োজন। সেজন্যেই সূর্যকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। আদিত্য এল১ তারই সূচনা ।।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb