রকেট ওড়ার বিজ্ঞান

লেখক - সংকেত হক


রকেট তৈরির প্রযুক্তি (Technology) ঠিক কবে থেকে এলো - এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন গত চোদ্দ শতকের শুরুতে চিন সবার আগে এই প্রযুক্তি এনেছিলো। আমাদের দেশের Department of Archaeology Heritage and Museums-এর বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে জানান সতেরো শতকের শেষে মহীশূরের সুলতান টিপু ইংরেজের বিরূদ্ধে লড়াইতে রকেট ব্যবহার করেছিলেন। তারপর এই প্রযুক্তি ব্রিটেনে পাচার হয়েছিলো। বিশ শতকের গোড়া থেকে ব্রিটেন, রাশিয়ায় এ-নিয়ে কাজ চলতে থাকে। পরে জার্মানিও যোগ দেয়। কিন্তু রকেট নিয়ে গবেষণা তুঙ্গে ওঠে ওই শতকের মাঝামাঝি। এই সময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই চলছিলো। নিউক্লিয় বোম তৈরির কায়দা তখন এই দু-দেশই জানতো। সোভিয়তের পশ্চিম দিক ঘেঁষে ছিলো আমেরিকার বন্ধু দেশ গুলো। সোভিয়েত ভাবলো – আমেরিকা চাইলে এদের জমি ব্যবহার করে তার ওপর বোমা ফেলতে পারে। কিন্তু উল্টোটা করা অত সোজা নয়। বোমারু বিমানে চরে অতলান্তিক মহাসাগর পেরিয়ে আমেরিকায় বোমা ফেলে আবার ফেরৎ আসা কি মুখের কথা? তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো দূর পাল্লার (Range) ক্ষেপনাস্ত্র (Missile) বানাবে। আর সেই ক্ষেপনাস্ত্র এমন হবে যা কিনা নিউক্লিয় বোম বইতে পারে। হালের ক্ষেপনাস্ত্র আসলে রকেটের (Rocket) আধুনিক রূপ।

মনে করি, মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো দর্শক দেখছে - একটা ভরযুক্ত (Massive) বস্তুকণা (Particle) একদম সোজা (Linear) পথে গতি নিয়ে যাচ্ছে। এই গতিটা শূন্য মাধ্যমে (vacuum) আলোর গতির(সেকেণ্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল) তুলনায় অনেক কম। তাহলে, ঐ দর্শকের সাপেক্ষে কণাটার রৈখিক Momentum হবে ওর ভর আর বেগের গুণফল। মানে, কণাটি স্থির অবস্থায় (At rest) থাকলে তার momentum শূণ্য হয়। এখন ধরা যাক, কণাটার ওপর বাইরে থেকে কোনো বল (External Force) কাজ করছে না। গতি নিয়ে মহাবিজ্ঞানী নিউটনের ২য় সূত্র অনুযায়ী প্রমান করা যায় - এই অবস্থায় সময়ের সঙ্গে কণাটার Momentum-এর মান ও দিক বদলায় না। একটার পরিবর্তে অনেকগুলো কণার সমবায় (System) নিলেও পুরো System-এর জন্য নিয়ম (Law) একই থাকে। তাহলে দেখা যাক এই নিয়ম দিয়ে আকাশে রকেট চালনার (Propulsion) বিজ্ঞানটা ব্যাখ্যা করা যায় কিনা।

রকেট তো খালি থাকে না, তার পেটের মধ্যে জ্বালানি (Fuel) ভরা থাকে। ভাবা যেতে পারে - জ্বালানি সমেত খালি রকেট মিলে একটা System তৈরি করে। মনে করা যাক, মাটিতে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম System-টা স্থির হয়ে মাটির তলের সাথে অনুভূমিক (Horizontal) ভাবে আছে। তাই, আমাদের সাপেক্ষে প্রাথমিক (Initial) ভাবে System-এর মোট Momentum শূন্য হবে। এবার রকেটের Engine চালু করা হলো। ফলে, তার জ্বালানি একটা নির্দ্দিষ্ট হারে (Rate) পুড়তে শুরু করে। এরম হতে দিলে একটা বিশেষ সময় পর আর কিচ্ছুটি থাকবে না।


                                                                             ছবি - ১

জ্বালানি পোড়ার জন্য একসাথে দুটো ঘটনা ঘটে। এর ফলে তৈরি হওয়া গরম গ্যাস প্রচণ্ড গতি নিয়ে System থেকে বাইরে বেরিয়ে (Exhaust) আসে। আর আমাদের সাপেক্ষে রকেটও সামনের দিকে একদম সোজাসুজি এগোতে আরম্ভ (সূত্র: ছবি – ১) করে। তাহলে, ইঞ্জিন চালু হওয়ার কিছু সময় পরে আবার আমরা পুরো System-এর Momentum হিসেব করতে পারি।  যেহেতু পুরো ঘটনায় বাইরে থেকে System-কে কেউ ধাক্কা (Push) দিচ্ছে না, তাই এই Momentum আগের মতই শূন্য থাকবে। এখান থেকে একটা সমীকরণ দাঁড় করানো যাবে। অন্যদিকে, আপেক্ষিক (Relative) গতির সজ্ঞা থেকে রকেটে বসে থাকা কোনো দর্শকের সাপেক্ষে গ্যাসের গতি কি হবে তার একটা সমীকরণ লেখা যায়।  এই দুটো সমীকরণ ধরে দু-লাইন অঙ্ক কষলে রকেটের ওপর প্রযুক্ত ঘাত বল (Thrust) বার করা যায়।  এই ঘাত দিচ্ছে রকেট থেকে বেরিয়ে আসা গ্যাস। এর কারনেই রকেট নিজে-নিজে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

                                                                                  ছবি - ২

শুনে খটকা লাগলে বাড়িতে হাতের কাছে থাকা কয়েকটা জিনিস দিয়ে চট করে একটা Experiment করে ফেলা যেতে পারে। ধরা যাক, ঘরের ভিতর দুখানা কাঠের চেয়ারকে কিছুটা দূরে উল্টোদিকে মুখ করে রাখা হলো। এরপর, তাদের মধ্যে একটা শক্ত-পোক্ত সুতো বেঁধে দেওয়া হলো। একটা বড় বেলুনে বেশ অনেকটা হাওয়া ভরে তার মুখটা ভালো করে আঁটা হলো। দুটো প্লাস্টিকের ছোট্ট চোঙের মত অংশকে Cello tape দিয়ে ফোলানো বেলুনের ওপর দু-জায়গায় চিপকে দেওয়া হলো। এবার ওই চেয়ারে যে সুতো বাঁধা ছিলো, তার একদিক খুলে চোঙ গুলোর মধ্যে দিয়ে গলিয়ে দেওয়া হলো। এরকম অবস্থায় বেলুন পুরো শূন্যে ঝুলে (সূত্র: ছবি-২) থাকবে। এই সময় যদি বেলুনের মুখ হালকা খুলে দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে – পেছন থেকে ভুসসস… করে হাওয়া ছাড়তে ছাড়তে বেলুন এক চেয়ার থেকে আরেক চেয়ারের দিকে ছুটছে। একই ঘটনা রকেটের ক্ষেত্রেও ঘটে।

আবার তাহলে আসল আলোচনায় ফেরা যাক। রকেটের ওপর প্রযুক্ত বলের ঘাত (Impulse) থেকে কলনবিদ্যার (Differential Calculus) সাহায্যে আমাদের সাপেক্ষে রকেটের গতি বার করা যায়। একক সময়ে যে পরিমাণ জ্বালানি কমে, ঠিক একই পরিমান গ্যাস বেরোয়। তাই, ইঞ্জিন চালু হওয়ার পর থেকে যত সময় যায়, রকেটে অবশিষ্ট জ্বালানির শতকরা পরিমান একটানা কমতে থাকে। তার সাথে তাল রেখে রকেটের গতি-ও বাড়তে থাকে। সব জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে, রকেটের গতিও চরমে পৌঁছয়। ফাঁকা রকেটের ওপর আর কোনো ঘাত কাজ করে না। রকেট তখন ঐ গতিতেই চলতে থাকে।

একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। ধরা যাক, একটা রকেট-জ্বালানি System নেওয়া হয়েছে যার ভর ১২ টন। এর মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ রকেটের নিজের, বাকিটা জ্বালানির। মনে করা যাক, সেকেণ্ডে ৪৮ কেজি হারে তার জ্বালানি পুড়ছে। তবে, অঙ্ক বলছে ১.৬৭ মিনিটে সব শেষ হয়ে যাবে। যদি, রকেটে বসে থাকা কোনো দর্শকের সাপেক্ষে গ্যাসের গতি সেকেণ্ডে ২ কি.মি. হয়, তবে সবটুকু জ্বালানি শেষ হলে আমাদের সাপেক্ষে প্রতি সেকেণ্ডে রকেটের গতি হবে ৩৩৫২ ফুট।

                                                                                   ছবি - ৩

এবার দেখা যাক - রকেটটাকে মাটি থেকে খাড়া ভাবে (Vertically) উঠোলে কি হয়। এখন আর বলা যায় না যে System-এর ওপর বাহ্যিক ভাবে কোনো বল কাজ করছে না (সূত্র: ছবি – ৩)। পৃথিবীর অভিকর্ষ বল (Gravity) আছে। তাছাড়া, বাতাসের বাধা (Air Drag) তো আছেই। অভিকর্ষ বল System-এর ভরের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু সময়ের সঙ্গে System-এর ভর ক্রমশ: কমতে থাকে, তাই তার ওপর অভিকর্ষ বলের প্রভাবও দুর্বল হয়ে আসে। অন্যদিকে, রকেটে প্রযুক্ত ঘাত পুরোটা সময় একই (Const.) থাকে। তাহলে একটা সময় নিশ্চয় আসে যখন এই ঘাতটা উল্টোদিকে কাজ করা সব বাহ্যিক বলের মোট পরিমাণকে ছাপিয়ে যায়। আগের রকটের জন্য এ-সব ধরে অঙ্কটা আবার কষলে দেখা যাবে - ইঞ্জিন চালু থাকা সত্ত্বেও প্রায় ১.৫৭ মিনিটের আগে রকেট কিছুতেই মাটি ছেড়ে উঠতে পারছে না। যখন ঊঠতে আরম্ভ করেছে, মোট জ্বালানির কেবল ৬ শতাংশ তখন বাকি আছে। সেটাও শেষ হলে আমাদের সাপেক্ষে প্রতি সেকেন্ডে রকেটের গতি হয় ৬৪.৭৪ ফুট মাত্র।

পৃথিবীর পিঠে (Surface) থাকা একটা ঢিলকে আকাশে যত জোরেই ছোঁড়া হোক না কেন, অভিকর্ষ বলের জন্য কিছু সময় পরে সেটা আবার মাটিতে নেমে আসে। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব অনুযায়ী একমাত্র তখনই ঢিলটা অভিকর্ষের টান থেকে মুক্ত হয়ে পুরোপুরি পৃথিবীর বাইরে চলে যায় যদি একে সেকেন্ডে ৬.৯৬ মাইল বা তার বেশি গতিতে ছোঁড়া হয়। একে আমরা মুক্তি (Escape) বেগ বলি। বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের কল্পনা করা রকেটের গতি এর অনেক নীচে। তাহলে গতি বাড়ানোর উপায় কি? অবশ্যই System-এ জ্বালানির ভর যতটা পারা যায় বেশি করতে হবে

বিষয়টা তলিয়ে ভাবার জন্য আবার একটা উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। মনে করা যাক, এমন System বানানো হয়েছে যার মোট ভর ৩০০০ টন। এর মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ ফাঁকা রকেটের। বাকিটা জ্বালানি। প্রতি সেকেণ্ডে ১৫ টন করে জ্বালানি পুড়ে শেষ হচ্ছে। এই অবস্থায়, যদি, রকেটে বসে থাকা কোনো দর্শকের সাপেক্ষে গ্যাসের গতি সেকেণ্ডে ৩ কি.মি. হয়, তাহলে ইঞ্জিন চালু হওয়ার মিনিটখানেক পর-ই রকেট মুক্তি বেগ পেয়ে যাবে। যদিও জ্বালানি তখন প্রায় শেষের মুখে। যদি রকেটে বসে থাকা কোনো দর্শকের সাপেক্ষে গ্যাসের গতি সেকেণ্ডে ৪.৫ কি.মি. হয়, তাহলে আরও কম সময়ে রকেট মুক্তি বেগকে ধরে ফেলে। শুধু তাই নয়, এর পরেও তার মধ্যে অনেকটা জ্বালানি বেঁচে থাকে, যেটা দিয়ে সে তার গতিকে আরও বাড়াতে পারে।      

পঞ্চাশের দশকে সোভিয়েত প্রযুক্তিবিদরা ঠিক এই কাজটাই করেছিলেন। রকেটের গতি বাড়াতে বাড়াতে তারা মুক্তি বেগের চেয়ে বেশি করে ফেলেছিলেন। সেটা দিয়ে তারা মহাকাশে পাঠিয়েছিলেন স্পুৎনিক-১, সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম কৃত্রিমভাবে (Artificial) তৈরি উপগ্রহকে (Satellite)। তামাম বিশ্বের মানুষ এই ঘটনায় নড়ে চড়ে বসেছিলো। তারপর আরও উন্নত রকেট বানানোর পরিকল্পনা হতে লাগে। একটা সময় শুধু কল্পবিজ্ঞানের গপ্পে মানুষ পৃথিবী-গ্রহের বাইরে কোথাও সফর করতে পারতো। ষাটের দশকে মানুষ শুধু মহাকাশে নয়, পা ফেলেছে চাঁদের মাটিতেও। যে যানটার গবেষণা শুরু হয়েছিলো নেহাত যুদ্ধ জয়ের খাতিরে, আজ সেই রকেটের দৌলতেই কল্পনা পরিণত হয়েছে বাস্তবে। আমেরিকায় এক বিদ্যালয়ের ছাত্র হোমার হিকাম আকাশে স্পুৎনিক-কে দেখতে পেয়ে স্বপ্ন দেখতো ভবিষ্যতে রকেট বানানোর। বন্ধুদের সাথে মিলে কত-না ঝড়-ঝাপটা সামলে শেষমেশ হোমার কাজটা হাসিল করেছিলো। বড় হয়ে তিনি হন বিখ্যাত মার্কিন মহাকাশ সংস্থা NASA-র প্রযুক্তিবিদ। সেখানে তিনি হবু মহাকাশচারিদের (Astronaut) তালিম দিতেন। আমাদের এখানে হোমারের মত বহু কিশোর-কিশোরী আছে। তাদেরও ইচ্ছে ভবিষ্যতে রকেট-বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার। এই লেখা পড়ে যদি তারা সামান্য হলেও উৎসাহ পায়, তবে সেটুকুই লেখকের পুরস্কার।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb