সোকোত্রা

লেখক - ডঃ জয়শ্রী পট্টনায়ক

ভোরের প্রথম আলোয় গুহা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলো দুই মানব মানবী । হাঁটছে সোজা হয়ে, দুপায়ে। মাথায় লম্বা লম্বা চুল। সম্পূর্ণ অনাবৃত সুঠাম শরীর। গায়ের চামড়া মসৃণ। এই দ্বীপের  অন্য জীব জন্তুর মত দেখতে নয়। স্বভাব ও হিংস্র নয়। পথের দুপাশে অজস্র ফল ফুলের গাছ। অন্য চারপেয়ের মত পায়ের ব্যাবহার না করে শুধু হাত দিয়ে পরম যত্নে গাছ থেকে প্রয়োজন মত ফল পেড়ে খেল তারা।  নিজেদের খাবারের ভাগ দিল তাদের থেকে অশক্ত জীবজন্তুকে। তারপর সমুদ্রে নেমে সাঁতার কাটতে শুরু করলো। বিরল প্রজাতির নানান রঙের মাছ, কাঁকড়া আর  লবসটার তাদের দুজনকে ঘিরে উত্তাল ঢেউয়ের সাথে যেন নাচতে শুরু করল। সেই নাচ দেখে সমুদ্রের ধারের বালিতে হালকা হলুদ রঙের আর টকটকে লাল রঙের ঘোস্ট ক্র্যাব বা ভুত কাঁকড়া গুলো আনন্দে ছুটোছুটি শুরু করে দিল। এভাবে দিনের আরম্ভ সোকোত্রার তটভূমিতে।
মানব মানবী এই দ্বীপে কি ভাবে এলো তা কারো জানা নেই। হয়ত ভিনগ্রহ থেকে,পথ ভুলে। শৈশব থেকে এরা এখানে। দ্বীপের কোন প্রাণী এদের মত দেখতে না হলেও এদের  সখ্যতা সবার সাথে।  কোনও অজানা  কারণে এদের রক্ষা করে এখানকার পশুপাখিরা।  সমুদ্র থেকে ফেরার সময় সরু লম্বা, ছাতার মত শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে দাড়িয়ে থাকা ড্রাগন ব্লাড ট্রির জঙ্গলে জীবজন্তুর সাথে খানিকটা ছুটোছুটি করে নিলো ওরা। ফেরার পথে দেখল আহত পশু পাখিরা ড্রাগন ব্লাড ট্রি থেকে চুইয়ে পড়া লাল রস এ গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওরা বসে পড়ে আহতদের গায়ে পরম যত্নে লাগিয়ে দিল ঐ রঙিন তরল। তারপর গাছের ছায়ায় তাদের সযত্নে শুইয়ে রেখে গুহার পথে এগোল।

সারা দুপুর নানান রঙের পাথরের টুকরো নিয়ে ছবি আঁকলো গুহার গায়ে।  দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই সূর্যাস্তের কমলা আলোয় প্রকৃতি মোহময়ী হয়ে উঠলো।  দিনের শেষ আলোয় বনভূমি আজ বিশেষ সাজে সেজেছে। মানব মানবি সেই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ফুল দিয়ে  সাজাতে শুরু করলো একে আরেকজনকে।  তারপর ঘুরে ঘুরে নৃত্য। তাদের নাচ দেখে লাল ফুলে নুয়ে পড়া গাছগুলোর ডালে ডালে ওয়ার্বলার পাখি, বান্টিং পাখি ছাড়াও নানান প্রজাতির পাখি খুশীতে ডানা ঝাপটাতে আরম্ভ করলো।  একটা ওয়ার্বলার পাখি তো মনের আনন্দে তাদের সঞ্চিত এক গুচ্ছ অদ্ভুত সুন্দর ফল তাদের পায়ের কাছে ফেলে উড়ে গেল গাছের ডালে।  এত সুন্দর লাল ফল এই জঙ্গলে তারা আগে কখনো দেখেনি। দিনের শেষে খিদেও পেয়েছে, তাই মনের আনন্দে দুজনে ভাগা ভাগি করে খেতে শুরু করল ফলগুলো---------।

-অপূর্ব স্বাদ

-এমন ফল ত আগে খাইনি

-ফল খেয়ে এমন আনন্দ তো আমরা কোনদিন অনুভব করিনি!

-আমরা এত শিহরিত হচ্ছি কেন?

একসময় তারা ভাষা হারাল। সূর্যাস্তের মায়াবী আলোয় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল একে অন্যের দিকে তারপর পরম আবেগে হাত ধরাধরি করে গুহায় দিকে এগোল। পরম মমতায় সন্ধ্যার  হালকা অন্ধকার ঢেকে দিল গুহা পথ আর বন চরাচর।     

মনে ধন্ধ জাগছে। এরাই কি সেই আদি মানব মানবী………… আদম ও ইভ!

হয়ত এই সুস্বাদু লাল ফলের আমেজে, আলো আঁধারের সন্ধিক্ষণে, আজ পৃথিবীতে মানুষের বংশবিস্তার এর শুভক্ষণ শুরু হল।

-ম্যাডাম তাঁবুতে ফিরবেন না, অন্ধকার হয়ে গেল যে ………………  

গাইডের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বসে আছি সোকোত্রার মুল ভূখণ্ডের দিক্সাম এ, ড্রাগন ব্লাড ট্রির বনে। চারিদিক হালকা অন্ধকারে ঝাপসা, একটু আগে ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম গুহার চারিদিকের বনভূমির মত। মনে পড়ল সরকারের বিশেষ প্রচেষ্টায় প্রকৃতি বিজ্ঞানের কাজে আসতে পেরেছি আদিম এই দ্বীপটিতে। এখানে অহর্নিশি উপলব্ধি করছি জীব বৈচিত্র্য ভরা আদিমতম এক পৃথিবীকে। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করে উঠলো। এতক্ষণ আমি জগত সংসার ভুলে কি দেখলাম, কোন সময়ে ফিরে গেছিলাম?  

ফিরবার পথে গাইডের অনর্গল কথাবার্তার মাঝে আমার টুকটাক প্রশ্ন, সোকোত্রার বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার জন্য----------।        

-ম্যাডাম, ছোট ছোট একাধিক ভূখণ্ড নিয়ে সোকোত্রা দ্বীপ গড়ে উঠলেও মুল ভূখণ্ডেই মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। এই দ্বীপের লোকসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। এদের পেশা মুলত মাছ ধরা, মধু সংগ্রহ ও পশুপালন। জীব বৈচিত্র্যর কারণে বিশ্বখ্যাত এই ভূখণ্ডে অন্তত ১৯০ প্রজাতির পাখি  রয়েছে। এদের মধ্যে ৪৪ টি প্রজাতি এই দ্বীপেই থাকে বাকিরা পরিযায়ী।  

-তাই নাকি? আর এখানকার জলজ জীবন?      

-সেটাও খুব বৈচিত্র্যময়। বিরল প্রজাতির মাছ কাঁকড়া, লবসটার, কচ্ছপ, ক্র্যাব ইত্যাদি এখানকার সমুদ্রে দেখতে পাওয়া যায়, যা বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না-------।

শুনতে শুনতে চোখে ভেসে উঠলো আজ দিনভর দেখা দৃশ্য গুলো………দুই আদিম মানব মানবী কে ঘিরে সমুদ্রে জলজ প্রাণীদের নৃত্য, সমুদ্রের তীরে বালিতে রঙিন ক্র্যাব দের ছুটোছুটি------।  

দূর থেকে যেন ভেসে আসছে গাইডের কথাগুলো-------------   

-তাছাড়া এখানে বিরল প্রজাতির ওয়ার্বলার পাখি, বান্টিং পাখি, শকুন………       

আর কিছু কানে গেল না। এখন তো মন পড়ে আছে সেই লাল ফুলে নুয়ে পড়া গাছগুলোর ডালে ডালে নানান প্রজাতির পাখিদের মেলায় নৃত্যরত দুই মানব মানবীর দিকে।    

-ম্যাডাম, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?     

ফিরে এলাম বর্তমানে---------  

-না না, শুনছি তোমার কথা । এবার এখানকার গাছ গাছালির কথা বল ।

-বিচিত্র গাছ গাছালির জন্য এই দ্বীপ বিশ্বখ্যাত। এখানকার বিশেষ কিছু গাছের নাম বোতল ট্রি বা কুকুম্বার ট্রি, ফ্রাঙ্কিসেন্স, নানান প্রজাতির ঘৃত কুমারী ইত্যাদি। তবে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ড্রাগন ব্লাড ট্রি । এই গাছের ছাল থেকে লাল রঙের তরল রজন বা রেজিন বেরিয়ে আসে, যার কারনে একে ড্রাগন ব্লাড ট্রি বলে। গাছটির রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা ভারি অদ্ভুত। এই লাল তরল ওষুধ তৈরির কাজে লাগে। এতে গড়াগড়ি খেয়ে বন্য পশুপাখিরা নিজেদের রোগ সারায় । চেষ্টা করেও এই গাছ দ্বীপের বাইরে অন্য কোথাও লাগানো যায়নি---।

শুনতে শুনতে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম! চোখে ভাসছে ড্রাগন ব্লাড ট্রি র লাল রঙের তরলে পশুপাখিদের লুটোপুটি খাওয়ার দৃশ্য।    

এসব কি দেখলাম?   

কেন দেখলাম?  

এসব কি এখানে বেড়াতে আসার আগে সোকোত্রা সম্পর্কে অতিরিক্ত পড়াশোনার ফল!      

মাথায় ঘুরছে বইয়ে পড়া কিছু কথা---------       

ভারত মহাসাগরের বুকে বিস্ময় দ্বীপ সোকোত্রা। আরবীয় উপদ্বীপ থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার  দক্ষিণে অবস্থিত এই দ্বীপ কে আফ্রিকা মহাদেশের অংশ বলে ধরা হয়।  আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব উপকূলের আশেপাশে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দ্বীপটি। বিরল প্রজাতির  প্রাণী ও গাছ পালা একে বিশ্বের অন্যান্য ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে রেখেছে। পৃথিবীর বাকী  ভূখণ্ডের সাথে সংযোগ না থাকার জন্য এখানে গাছপালা ও জীবজন্তু বেড়ে উঠেছে আপন খেয়াল খুশীতে।  সমুদ্র ঘেরা এই দ্বীপের সব কিছুই অন্যরকম। বিরল প্রজাতির প্রাণী ও গাছপালার আঁতুড় ঘর হওয়ার জন্য এই ক্ষেত্রকে পৃথিবীর বাইরের কোন ভিনগ্রহী দের দেশ বলে মনে হয়।

তবে বিজ্ঞানীরা বলেন , আজ থেকে প্রায় আড়াই কোটি বছর আগে, পৃথিবীর স্থলভাগ যখন মহাদেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি, তখন থেকেই সোকোত্রার বিচ্ছিন্নতার সূচনা। সেই সময় সমস্ত মহাদেশীয় ভূখণ্ড একসঙ্গে গোন্দয়ানা নামে পরিচিত ছিল। তা থেকে কোন ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারত মহাসাগরের বুকে শুরু সোকোত্রার একার রাজত্ব। পৃথিবীর মুল ভূখণ্ডের সংস্পর্শে না থাকার জন্য এই দ্বীপের উদ্ভিদ ও সমস্ত প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে নিজস্ব স্বাতন্ত্রে। বৈচিত্র্যে  ঠাসা এই দ্বীপ সেই কারণে রহস্যের আঁতুড় ঘর। প্রকৃতি এখানে আজও আপন খেয়ালে এগিয়ে চলেছে স্থানীয় গাছ গাছালী আর প্রাণীজগৎ নিয়ে।       

উপসংহারঃ সম্প্রতি সোকোত্রা সংলগ্ন নানান দেশ এই ভূখণ্ড কে বিখ্যাত পর্যটক কেন্দ্র বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। জানিনা এই দ্বীপটি তার আদিম সৌন্দর্য আর কতদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে! 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb