শেষ উপপাদ্যের স্রষ্টা পিয়েরে ডি ফারম্যাট

লেখক - বিকাশ মণ্ডল



পেশায় আইনজীবী  হলেও  অঙ্কের প্রতি তাঁর  আকর্ষণ ছিল অসাধারণ। অবসর  সময়ে  অঙ্ক বিষয়ে চর্চা করা ছিল তাঁর শখ। অঙ্কের প্রতি তাঁর এই শখই  একদিন তাঁকে  জগদ্বিখ্যাত করেছে। এনে দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতবিদের সম্মান। তাই  অনেকেই  তাঁকে ‘শখের গণিতবিদ’ বলে থাকেন। ইনিই হলেন প্রখ্যাত আইনজীবী ও ততোধিক প্রসিদ্ধ গণিতবিদ পিয়েরে ডি ফারম্যাট।

1607 সালে(মতান্তরে 1601 সালে) ফ্রান্সের বোমো ডি লোম্যানে জনগোষ্ঠীর ধনী  ব্যবসায়ী পরিবারে ফারম্যাট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ডমিনিক ফারম্যাট ছিলেন একজন সফল চামড়া ব্যবসায়ী এবং চার জন সম্মানীয়  কাউন্সিলারের একজন। ফারম্যাটের বয়স যখন মাত্র সাত বছর, তখন তাঁর  মাতা ক্লেয়ার ডি লঙ ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন।  ফারম্যাটের দুই বোন ও এক ভাই ছিল। ছোটবেলায় লে কর্ডলিয়ার্স  নামক ক্যাথোলিক স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। ভাষা শিক্ষার বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। গ্রীক, ল্যাটিন,  ইতালিয়ান, স্প্যানিশ এবং অক্সিল্যান(দক্ষিণ ফ্রান্সের আঞ্চলিক ভাষা এবং সম্ভবত ফারম্যাটের মাতৃভাষা) ভাষায় তিনি কথা বলতে পারতেন। বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে 1623 সালে তিনি আইনের ছাত্র হিসাবে ভর্তি হয়েছিলেন অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিন বছর পর 1626 সালে মাত্র 18 বছর বয়সে এই বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে তিনি আইনে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেছিলেন। ঠিক পরের বছর তিনি ফ্রান্সের বোডো শহরে চলে এলেন এবং হাইকোর্টে  ওকালতি শুরু করলেন। এখন থেকে  অবসর সময়ে শুরু  হল তাঁর গণিত চর্চা। এদিকে কর্মজীবনের এক বছর পূর্ণ হতে না হতেই, 1628 সালে তাঁর জীবনে ঘটে গেল এক চরম বিপর্যয়। তাঁর পিতৃদেব বিদায় নিলেন এই পৃথিবী থেকে। তাঁকে করে গেলেন বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।  তবে ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে পাগল না হয়ে তিনি সমানভাবে ওকালতি ও গণিতচর্চা করে গেছিলেন।1630 সালে, যখন তাঁর বাইশ-তেইশ বছর বয়স, তখন তিনি তুলুসের হাইকোর্টে সিনিয়ার আইনী পদ পেতে বিপুল অর্থ খরচ করেছিলেন, আজকের দিনে যার মূল্য প্রায় এক মিলিয়ন ডলার। তৎকালীন সময়ে এটি ছিল একটি খুবই সম্মানীয় পদ। এই পদাধিকারী ব্যক্তিরা তাঁদের নামের সঙ্গে ‘ডি(de)’ পদবি টি ব্যবহার করতে পারতেন। তাই তখন থেকে তিনি পিয়েরে ফারম্যাট  না লিখে  পিয়েরে ডি ফারম্যাট লিখতেন। 1631 সালের জুন মাসে যখন তাঁর বয়স তেইশ বছর, পনেরো বছরের লুইস ডি লঙের সঙ্গে তিনি  বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন  এবং তাঁদের মোট আটজন সন্তান-সন্ততি হয়েছিল।1631 সালে তিনি তুলুসের ফৌজদারি আদালতে এবং এরপর ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ হিউম্যান রাইটস নামে খ্যাত ‘গ্র্যান্ড চেম্বারে’ র একজন আইনজীবী হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এমনকি ফ্রান্সের চ্যান্সেলর পিয়েরে সিগারের মুখপাত্র হিসাবে তিনি কাজ করেছিলেন।

সেই সময়ে দেশের সর্বোচ্চ আইনি পদে আসীন ফারম্যাটকে  বর্তমান বিশ্বের মানুষ একজন আইনজ্ঞ হিসাবে নয়, বরং তাঁকে চেনে একজন গণিত অনুরাগী প্রথিতযশা গণিতবিদ হিসাবে। তবে জীবদ্দশায় গণিতের  ওপর কোনো বই তিনি কখনও প্রকাশ করেননি। গণিতে তাঁর অবদান সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়  তার বেশিরভাগই অন্যান্য গণিতবিদদের সাথে তাঁর আদান প্রদান করা চিঠিপত্র এবং তাঁর মৃত্যুর পর প্রাপ্ত নোটগুলি থেকে পাওয়া গেছে।   

উচ্চ-স্তরের  গণিতের প্রতি ফারম্যাটের আগ্রহ প্রথম দেখা গিয়েছিল যখন তিনি 19 বছর বয়সে ফ্রান্সের বোডো শহরে আইনজীবী হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। এখানে এতিয়েন দেস্পানেত নামে এক গণিত অনুরাগীর সঙ্গে তাঁর নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যিনি উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু গণিতের বই সহ গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের একটি লাইব্রেরী পেয়েছিলেন। এসব কিছু গণিতের প্রতি ফারম্যাটের আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিশেষ করে একজন ফরাসী গণিতবিদ ফ্রান্সিস্কাস ভিয়েতার কাজের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। ভিয়েতার  কাজ এবং আর্কিমিদিসের গ্রন্থগুলি পাঠ করে 21 বছর বয়সে ফারম্যাট ম্যাক্সিমা, মিনিমা ও স্পর্শক নির্ণয়ের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। এটি ছিল গণিতে তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সম্ভাবনা তত্ত্বে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা মাথায় রেখে বর্তমানে তাঁকে ও ব্লেইজ পাস্কাল উভয়কে সম্ভাবনা তত্ত্বের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ফারম্যাটের ধারণা ছিল যে আলো দুটি বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব সম্ভাব্য ন্যূনতম সময়ে যায়। এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তিনি স্নেলের প্রতিসরণের সূত্র বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একথা অনস্বীকার্য যে সংখ্যাতত্ত্বের প্রতি ফারম্যাটের ভালোবাসা ছিল গভীর। মৌলিক সংখ্যা হল সেই সব সংখ্যা যাদেরকে এক এবং তাদের দিয়ে ভাগ করা যায়---এই ধারণা সর্ব প্রথম তাঁর মাথাতেই এসেছিল। তিনি বলেছিলেন-  p একটি মৌলিক সংখ্যা এবং a যে কোনো একটি পূর্ণসংখ্যা হলে  এমন একটি পূর্ণসংখ্যা হবে যাকিনা p এর  গুণিতক। তাঁর এই উপপাদ্যটি “ফারম্যাটের লিটল থিওরেম” নামে বিখ্যাত।

তবে গণিতে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজ হল তাঁর সৃষ্ট একটি উপপাদ্য, যা “ফারম্যাটের শেষ উপপাদ্য” নামে জগৎবিখ্যাত। এই উপপাদ্যে বলা হয়েছে

“একটি ঘন সংখ্যাকে অপর দুটি ঘন সংখ্যার যোগফল আকারে,  একটি চতুর্থ ঘাতের সংখ্যাকে অপর দুটি চতুর্থ ঘাতের সংখ্যার যোগফল আকারে লেখা অসম্ভব। সাধারণভাবে , দুইয়ের অধিক ঘাত সম্পন্ন কোনো সংখ্যাকে সমঘাত সম্পন্ন অপর দুটি সংখ্যার যোগফল আকারে লেখা অসম্ভব।“

গণিতের ভাষায় – “ এমন তিনটি  ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যা x, y ও z পাওয়া অসম্ভব যা  (  সমীকরণকে সিদ্ধ করবে।“

 1637 সালে প্রকাশিত গ্রীক গণিতজ্ঞ ডায়াফ্যান্টাসের লেখা বিখ্যাত ‘অ্যারিথমেটিকা’ গ্রন্থের মার্জিনে পাওয়া ফারম্যাটের এই উপপাদ্যটি তাঁর শেষ উপপাদ্য কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে একথা সত্য যে তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছর পর তাঁর ছেলে এই উপপাদ্যটি পেয়েছিলেন এবং জনসমক্ষে নিয়ে এসেছিলেন। যেহেতু সবশেষে ফারম্যাটের এই উপপাদ্যটির কথা জানা গেছিল, তাই একে ‘ফারম্যাটের শেষ উপপাদ্য’ বলা হয়। অন্যভাবে বলা যায় ফারম্যাটের অন্যান্য সমস্ত উপপাদ্য গাণিতিক প্রমাণের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও এই অসাধারণ উপপাদ্যটি প্রায় 300 বছর ধরে সকল প্রমাণকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে অবশেষে 1995 সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক অ্যান্দ্রু অয়াইলসের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সুতরাং বলা যায় এটি হল ‘ফারম্যাটের শেষ প্রমাণিত উপপাদ্য’।

1665 সালের  12 ই জানুয়ারী ফ্রান্সের ক্যাস্ট্রেসে মাত্র 58 বছর বয়সে শেষ উপপাদ্যের স্রষ্টা  গণিতজ্ঞ ফারম্যাটের জীবনাবসান হয়।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb