রোবোস্ফিয়ার

লেখক - ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

                                                           চিত্রসূত্র – অন্তর্জাল

কঠিন একটা শব্দ। ঠং করে। 
মিহি একটা শব্দ। একটা গাড়ির। 
একটা সুসজ্জিত বিজ্ঞান সম্মত গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। নেমেছে কেউ একজন। ধীরে ধীরে যান্ত্রিক গতিতে সে এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে একটা গামছায় মুখ ঢাকা বসে থাকা মানুষের দিকে। মাথা নিচু তার। সামনে পাতা একটা এলুমিনিয়াম জাতীয় বাটি। 
সেই যান্ত্রিক পদক্ষেপ যান্ত্রিক হাতে একটা ধাতুর টুকরো ফেলল সেই ধাতুর পাত্রে। 
ঠং করে আওয়াজটা উঠল ঠিক তখনই।
যান্ত্রিক মুখ তো যন্ত্রের সঙ্গে থাকে না। সেটা থাকে তার নিয়ন্ত্রকের কাছে। তাই যান্ত্রিক মুখের প্রতিক্রিয়া সেই মুখে নয় বরং দেখা গেল অন্য কোথাও অন্য কোনও এক রক্তমাংসের মুখে। 
যান্ত্রিক পা যান্ত্রিক গতিতে ঘুরল একশ আশি ডিগ্রি। তারপর আবার এগিয়ে চলল যান্ত্রিক পায়ে গাড়িটার দিকে। 
এদিকে রক্তমাংসের হাত দুটো জড় হয়ে যান্ত্রিক গতিতে এসে নিজের কপাল স্পর্শ করল হালকা ভাবে। সে খুব অনুগ্রীহিত এই অর্থটুকু পেয়ে। 
মিঃ মালহোত্রা। আগেকার নাম ছিল। যখন একটা কারখানার মালিক ছিল সে। যখন সে কোটিপতি ছিল। 
এখনকার নাম নেই। হয়ত নম্বর দিয়ে পরিচয়। মূল গেট থেকে পাঁচ নম্বর। সেই সারির পেছন দিকে থেকে ছাপ্পান্ন নম্বর। এখন কোটি দূরে থাক কারোর পতি নয়। কোটি আর পত্নি দুইই ছেড়ে চলে গেছে তাকে। 

সেদিন মিঃ মালহোত্রার চোখে পড়ে গিয়েছিল হঠাৎ। একটা টিয়াপাখি খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে লোকের ভাগ্য বলে দিচ্ছে। বলে দিচ্ছে মানে লোকটার সামনে পড়ে থাকা অনেক ভাগ্য লেখা কার্ড থেকে সামনে দাঁড়ানো লোকটির ভাগ্য লেখা কার্ড ঠোঁটে করে তুলে এনে ভাগ্য গণকের হাতে দিচ্ছে। গণক সেটা তুলে ধরছে ভাগ্য অন্বেষকের হাতে। সে নীরবে তার ভাগ্যের ফল জানছে। 
মিঃ মালহোত্রা তাঁর গাড়ির সামনেটা দেখতে পান উইন্ড স্ক্রিন দিয়ে। কিন্তু ভাগ্যের সামনেটা বা সামনের ভাগ্যটা দেখতে পান না। কাঁটায় বিছানো বা গোলাপের পাপড়ি সেটা দেখার লোভ হল। 
-মাল্টি মিলিওনেয়ার বনেগা। ভাগ্যগণক বলল। 
প্রাপ্যের দশগুণ টাকা দিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন মিঃ মালহোত্রা। লক্ষগুণ যখন উঠে আসবে তখন মাত্র দশগুণ দিতে আপত্তি কোথায়? 

মিঃ মালহোত্রা গুম মেরে বসেছিলেন। রোজ কাজে ভুল আর কাজে ফাঁকি এরা ব্যবসাটা ডকে তুলে দেবে নাকি? পঞ্চাশটা লোক কাজ করে অফিসে। অবশ্য বেশ খরচ করতেও হয়। নেহাত ভাগ্য জানতে ভাল লাগে তাই টিয়া গণকের কাছে যাওয়া। নইলে কে আর বিশ্বাস করে সেটা? মাল্টি মিলিয়ন পাওয়া দূরের কথা কারখানাটা ডকে না উঠেলেই হল।
দরকারী একটা ফোন এল।
-হ্যালো-
-আমি মিঃ তপাদার বলছি। আপনার কনসার্ন কী কাজ করছে মশাই। ভুল আর ভুল। 
মিঃ মালহোত্রা মেজাজ ঠিক রাখলেন, প্লিজ একটু মানিয়ে নিন মিঃ তপাদার। বোঝেন তো মানুষের ভুল হয়। টু আর হিউম্যান। আর সব রকমের লোক নিয়েই তো কাজ করতে হয়? 
-কটা লোক আছে আপনার? 
-এই সব মিলিয়ে জনা ষাটেক আর কী। 
-তা আপনার তো এফিসিয়েন্ট লোক চাই? যারা খুব নিট এন্ড ক্লিন কাজ করবে আর একেবারে পারফেক্ট।
মুখ বেজার মিঃ মালহোত্রার, চাই তো কিন্তু পাই কোথায়?
-হোয়াই? আমি দেব সাপ্লাই। 
-আছে নাকি?
-জরুর। এখন একটা নিন। মেশিন ধরতে পারেন। কিনতে হবে। 
-সরি ম্যানপাওয়ার কি কিনতে পাওয়া যায়?
-ম্যানপাওয়ার নয় মেশিন পাওয়ার। আপনাকে দিতে হবে—
চক্ষু একেবারে চড়ক গাছ মিঃ মালহোত্রার। বললেন, বাস রে এত!
-বললাম না দশজনের কাজ করবে তাও একেবারে পারফেক্ট। আর আমি তো লোনে দেব। ই-এম-আই যা হবে সেটা দশজনের স্যালারি আর পারকুইজিটের থেকে অনেক কম। ভাবতে পারেন? তবে ই-এম-আই ফেল করলে সঙ্গে সঙ্গে কোর্টের নোটিশ পাবেন। এগ্রিমেন্ট ছাড়া দেওয়া যাবে না কিন্তু। এগ্রিমেন্ট মাস্ট। 
-বুঝলেন তো? চুপ করে ভাবতে থাকা মিঃ মালহোত্রাকে জিজ্ঞেস করলেন মিঃ তপাদার। 
বোঝার বেশ কিছু সময় নিয়ে মিঃ মালহোত্রা বললেন, ওকে তাই সই। 
মেশিন সাপ্লাই হয়ে গেল। মানুষ নয় কিন্তু মানুষের মত দেখতে। মেশিন এল দশজনের থেকেও বেশি কাজ করে। অতএব দশজন বাড়ি চলে গেল। পরের দিন আর আসতে হল না। নজনের স্যালারি আর পারকুইজিট পকেটে ঢুকল মালহোত্রার। 

এখন লাভের মুখ বেশ ভাল করেই দেখছেন তিনি। এ মাসে আর একটা মেশিন কিনবেন। এ মেশিনটা খুব পাওয়ার ফুল। জনা কুড়ি লোকের কাজ একসঙ্গে করতে পারে। অতএব আরও উনিশ জনের স্যালারি পকেটস্থ হবে। সেই টিয়াপাখির মালিককে স্বপ্নে দেখলেন মালহোত্রা। নিজেই হাত জোড় করে বললেন, সাচ বোলা আপ। 
-কী কেমন লাগছে মিঃ মালহোত্রা? 
মিঃ তপাদারের ফোনের জবাবে বললেন, ওয়ান্ডারফুল। আগের মত ভিড় ভাট্টা নেই। চেঁচামেচি হৈ হট্টগোল নেই। স্মুথলি কাজ হয়ে যাচ্ছে। 
-আর আপনার ব্যালেন্স শিট লাল কালির বদলে কালো কালিতে লেখা হচ্ছে এই তো? 
-ও সিওর। সে আর বলতে। 
টিয়ার ঠোঁটের কথা সে কি আর মিথ্যে হতে পারে? ভাবছেন মিঃ মালহোত্রা। কেন যে অবিশ্বাসীগুলো খামোখা অবিশ্বাস করে। 

এখন তাঁর অফিস আর কারখানায় তিনি ছাড়া আর কোনও মানুষ কর্মী নেই। মাত্র গুটিকয় মানুষের মত দেখতে মেশিন দিয়ে গড় গড় করে দিব্বি চলছে। এদের ইন-বিল্ট পোশাক আছে। কেউ বলবে না অমানুষ এখানে কাজ করে। 
তপাদারের মেসেজ এল, সব রোবো বাবদ যা দাম হয়েছে ই-এম-আই বাদ দিয়ে তার সবটা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে দিতে হবে। 
মালহোত্রা সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানালেন, সে তো অনেক।
-কিন্তু এগ্রিমেন্টে সেটাই লেখা ছিল। You must pay on demand. 
হ্যাঁ এটা ঠিক। যখনই মিঃ তপাদারের মনে হবে সব ফিউচার ই-এম-আই বাতিল করে তিনি দাম একসঙ্গে নিয়ে নিতে পারেন। এই চুক্তি একসঙ্গে উভয়ের স্বাক্ষরিত। 
এক রোবো এসে ঢুকল তাঁর চেম্বারে।
-অর্ডার হয়েছে আপনার সব চার্জ এই অফিস আর কারখানার সিনিয়র মোস্ট এসিস্ট্যান্টের হাতে দিয়ে দিতে হবে। আমি সিনিয়র মোস্ট এসিস্ট্যান্ট।
মানুষের নয়, যান্ত্রিক স্বর। 
ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর ভ্রূতে ব্যথা হয়ে গেল কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকল না মালহোত্রার। তপাদারের ফোন চলে এল, আপনি রোবোর দাম দিতে পারেন নি তাই কোর্ট আপনার অফিস, বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স সব এটাচ করেছে।
মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন আর কী। রোবোর অটোমেটিক সেন্সর সিস্টেম আবার তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল। 
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি? বিস্মিত মালহোত্রার প্রশ্নের জবাবে তপাদার বলল, এটা ডিজিট্যাল যুগ। এখন সময়ের অনেক দাম। সে আর নষ্ট হতে দিতে চায় না নিজেকে। তাই সিদ্ধান্ত আর প্রতিপালনের মধ্যে এতটুকু ফাঁক থাকে না মিঃ মালহোত্রা। আপনি শুধু বর্তমানের চিন্তা করেছিলেন সেটা আপনার। আর আমি ভবিষ্যতের চিন্তা করেছিলুম সেটা আমার। 
বাড়িতে এসে ফোন করলেন তিন বন্ধুকে। তাঁর পরিচিত তিন বন্ধুকে। সবাই রোবো পোষার দাম দিয়েছে। বা খেসারত। 
হেঁটে হেঁটে অবশ্য মিঃ মালহোত্রাকে এখানে আসতে হয় নি। তাঁর অধস্তন এক রোবো তাঁকে এখানে রেখে গেছে। আর দিয়ে গেছে একটা বাটিও।  

মিঃ সরকার একজন ভাল অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর খ্যাতি দেশ জুড়ে। তিনি যে ইঞ্জিনের ড্রয়িং করেন সে গাড়ির বিশ্ববাজারে বিরাট দাম। আর সেই সঙ্গে নাম। কোম্পানীর চোখের মণি। 
একদিন মিঃ সরকার তাঁর চেম্বারে ঢুকতে গিয়ে দেখলেন কেবিনের দরজা বন্ধ। দরজার সামনে একটা লাল বর্ডার এঁকে দেওয়া হয়েছে। সেই বর্ডারে পা পড়া মাত্র মাইক্রোফোন ককিয়ে উঠলঃ নক বিফোর ইউ এন্টার।
অবাক কান্ড তাঁর নিজের চেম্বারে তাঁকেই কিনা ঢুকতে হবে নক করে? হঠাৎ চোখে পড়ল দরজায় একটা ‘নক’ লেখা বাটন হঠাৎ এসে হাজির হয়েছে। নক বাটন টিপে দাঁড়িয়ে আছেন। মাইক্রোফোনে উত্তর এল মিষ্টি আপ্যায়নের সুরেঃ প্লিজ হ্যাভ ইওর এন্ট্রান্স। 
হাত দিলেন দরজায়। এবার দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে দেখলেন তাঁর চেয়ারে এক অদ্ভুত চেহারার মানুষ বসে আছে। অবাক শুধু নয় অপমানিতও বটে। কর্তৃপক্ষ কাজ থেকে সরিয়ে দিতে চাইলে আগে লিখে জানাতে পারতেন। 
তা হোক ব্যাপারটা তো জানা দরকার। কিন্তু প্রশ্ন করার আগেই মাইক্রোফোনে উত্তরঃ ইউ আর হিয়ারবাই ডিসপ্লেসড অ্যাজ উই গেট এন এফিসিয়েন্ট সাবস্টিটিউট। প্লিজ হ্যাভ প্লেজার টু এসিস্ট ইওর নিউ নিয়ারেস্ট বস। 
নিয়ারেস্ট বস! রাগে অপমানে কান লাল হয়ে গেল মিঃ সরকারের। চীফ এঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনিই তো এই কোম্পানির ‘এঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ড্রয়িং বিভাগের কর্মকর্তা। আজ থেকে তাঁকেই মেনে চলতে হবে অন্যের অধস্তন হয়ে?
রেগে আগুন তেলে বেগুন হয়ে তিনি চিৎকার করলেন, হোয়াট ননসেন্স! 
সঙ্গে সঙ্গে একটা যান্ত্রিক হাত এগিয়ে এল। উল্টোদিকের চেয়ারে উল্টো করে বসিয়ে দিল। নড়াচড়ার উপায় নেই যান্ত্রিক হাত দুটো তো সাঁড়াশির মত চেপে ধরে আছে তাঁকে। হঠাৎ রোবোর দিকে চোখ পড়ল। এ তো তাঁর বিভাগের এক অধীনস্থ রোবো। মালিকের হুকুমে তিনি একে অর্ডার দিয়েছিলেন। ফাইফরমাশ খাটার জন্যে আর হুকুম তামিল করার জন্যে। আজ তার হুকুমই তামিল করতে হবে তাঁকে। 
কভি নেহি। আবার সোজা করে তাঁকে বসিয়ে দিল যান্ত্রিক লোকটা।  
যান্ত্রিক কন্ঠস্বর আবার বলল, ইউ আর হিয়ারবাই সাসপেন্ডেড ফর অ্যান আনলিমিটেড পিরিয়ড। 
বাড়িতে আসা মাত্রই আবার মেসেজঃ ইউ আর ইয়ারবাই ডিসচার্জড ফ্রম ইওর সার্ভিস এন্ড অল রেস্পন্সিবিলিটিজ। 
তারপর মেসেজে লেখা আছে যা তাতে তো তাঁর আক্কেল গুড়ুম একেবারে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অসদাচরণের জন্যে কোম্পানী তাঁকে বহিস্কার করছে। শাস্তি হিসেবে যে টাকা দিতে হবে সেটা একটা অবাস্তব সংখ্যা। তিনি নাকি চাকরিতে ঢোকার আগে এমনই বন্ড দিয়েছিলেন সারা চাকরি জীবনে যা বেতন ও অন্যান্য খাতে পেয়েছিলেন তার দ্বিগুন ফেরত দিতে হবে যদি কোম্পানি তাঁকে স্যাক করে। আসলে তখন তিনি ভাবেন নি যে তিনি এমন কাজ করবেন যাতে কোম্পানি তাঁকে স্যাক করতে পারে। 
দিন কয় পরে মিঃ সরকারের জায়গা হল মিঃ মালহোত্রার ঠিক পাশে। তাঁর একদা অধস্তন আর সদ্য নিযুক্ত বস তাঁকে সেখানে বসিয়ে দিয়ে গেল। একটা এলুমিনিয়ামের বাটি ফাউ। 
কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানি একটা চমৎকার গাড়ি বার করল। মিঃ সরকারের সেই অধস্তন রোবটের ডিজাইন। অটোপাইলটে চলে। দামটা মিঃ সরকারের ডিজাইন করা গাড়ির প্রায় দশগুণ বেশি। 
খুব নাকি ডিমান্ড সে গাড়ির। 

শান্তনুবাবুর ক্ষেত-খামারের কাজ আজকাল আর বেশি চলছে না। বীজ, সার, সেচের বিদ্যুৎ খরচ তারপর মজুর। সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে শস্যদানার দাম তেমন বাড়ে নি। আর এই গরিব দেশে কতই বা বাড়তে পারে। তাই আয়-ব্যায়ের ছোট্ট এক ফাঁকে লুকিয়ে থাকে লাভের কড়িটা যা তাঁর সংসার চালানোর সম্বল। 
একদিন অজানা এক ফোন এল তাঁর কাছে। তাঁর কাছে খবর জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর চাষবাস কেমন চলছে। তিনি সত্যি কথাই বললেন। তাঁকে অফার দেওয়া হল তাঁর চাষের জমির সব চাষ করে দেওয়া হবে যন্ত্র বসিয়ে। বিনিময়ে চাষের জমি আর বাড়ি তাঁকে বন্ধক রাখতে হবে।
চাষের খরচ আর লেবার কিছুই তিনি পাবেন না। তবে লাভের একটা অংশ পাবেন। যন্ত্রের খরচ একেবারে দিতে হবে না। মাসে মাসে ভাড়া হিসেবে দিতে পারেন। 
 তিনি বিক্রি করে দিতে পারেন। উপযুক্ত মূল্যে সেটা আমাদের কোম্পানি কিনে নেবে। আর তাদের বিদ্যাবুদ্ধি প্রয়োগ করে চাষ করবে। তবে চাষের ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। 
রাজি হয়ে গেলেন শান্তনুবাবু। জমির হস্তান্তর হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এক রিমোট কন্ট্রোলে চাষ হতে লাগল। প্রচুর ফলন। কিন্তু যারা কাজ করছিল তাদের ছাঁটাই করতে হল জমি হস্তান্তরের আগেই। এমনই নাকি শর্ত হয়েছিল। 
একটা ছোট অফিসে একজন রোবো বস। আর একজন রোবো লেবার। আব কাজ হয়ে চলেছে কম্পিউটারের মাপা গতিতে।  আর বেমাপা গতিতে একটা বিস্ফোরণ। জনরোষের বিস্ফোরণ। এতগুলো কর্মচ্যুত শক্তির বিস্ফোরণ। 
শান্তনুবাবুকে পুলিশ রেহাই দিল। কিন্তু সেই জমিগ্রহিতা কেস করল। এই বিক্ষোভে মদত দেওয়ার জন্যে। অনেক দিন কাজ আটকে থাকার জন্যে তাদের চাষের ক্ষতি হয়েছে। আর ই-এম-আই নয় কোম্পানি এবার তাঁর বাসা  আর জমি নিয়ে নেবে। 
শান্তনুবাবুর ঠাঁই হল মিঃ মালহোত্রা আর মিঃ সরকারের পাশে। মাথায় ঢাকার গামছা আর মাটিতে পাতার একটা বাটি অবশ্য উপরি পাওনা। 

এই ব্যাপারটা নিয়ে সবাই খুব আলোচনায় মেতে উঠল। কেউ বলল, ভালোই হয়েছে। এখন মানুষকে আর আঙ্গুল নাড়াতেও হবে না। হুকুম মাত্র মুখের গোড়ায় সব এসে পড়বে। আবার কেউ কেউ বলল, যা হচ্ছে তা মোটেই ভাল হচ্ছে না। মানুষের জীবন কাজ করার জন্যেই। আরাম করার জন্যে নয়।
বলা বাহুল্য ‘পেসিমিস্ট’ আখ্যা দিয়ে তাদের বক্তব্য নস্যাত করে দিল এক সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্র। সেই কাগজেই একটা বিজ্ঞাপন দেখে সবাই চমকে উঠল। বিজ্ঞাপনটা ছিল এক ‘সম্পূর্ণ রোবো পরিচালিত সংবাদপত্রের’। এই একশ শতাংশ নিরপেক্ষ সংবাদপত্রটি হবে রোবো উদ্ভাবিত, রোবো পরিচালিত আর রোবো পরিবেশিত। সাংবাদিক, সম্পাদক, ফিচার লেখক থেকে শুরু করে সব কিছুই রোবো নিয়ন্ত্রিত হবে। রিপোর্টারদের হাতে ক্যামেরা ধরতে হবে না। বুমও নয়। সব একেবারে ইনবিল্ট। 
প্রথমে সবাই খুশি। বিশেষ নেট দুনিয়ার মানুষ যাদের পরিশ্রম বলতে শুধু একটা আঙ্গুল দিয়ে মোবাইল নাড়াচাড়া করা।  দারুন ব্যাপার। সব সত্যি বলে দিচ্ছে! আহা যন্ত্র বলে তাই তো। নে এবার সব পর্দা ফাঁস হয়ে যাবে।
 তারপর অনেকে আবার বিপদে পড়ে গেল। একি হল। সব সত্যি বলে দিচ্ছে! মনে হয় এটা বিগড়ে যাওয়া যন্ত্রের কাজ। যন্ত্রের যন্ত্রণা আর কী। সব পর্দা ফাঁস হয়ে গেল রে! 
সদারঙ্গবিহারীলাল তার বাড়িতে বসে হো হো করে অট্টহাসিতে ফাটিয়ে দিচ্ছিল। আর সেই সঙ্গে বলছিল, তোমরা ভাবছ সব যন্ত্রই করছে। আরে বাবা যন্ত্র কখনও কি নিজে থেকে চলে। যন্ত্র কি কখনও কি নিজে থেকে উদ্ভাবিত হয়? সব কিছুর পেছনে যদি মানুষ না থাকে? যন্ত্রী ছাড়া কি যন্ত্র চলে? 
তবে সব কিছুর পেছনে যাকে থাকতে হবে সেই টাকা থাকে সবার সামনে। যাকে কিন্তু পেছনের দরজা দিয়ে বার করে আনতে হয়। আর সে কাজ যদি যন্ত্র করে তো আনন্দের আর শেষ নেই। অপদার্থ অলস মানুষগুলোর টাকা আর অভাবী মানুষের কী প্রয়োজন মেটাচ্ছে? তার বদলে সেগুলো সদারঙ্গবিহারীলালের রঙ্গরসে ভরপুর করে তুলুক না কেন? 
সদারঙ্গবিহারীলালকে কেউ চেনে না, কেউ কখনও তাকে দেখেছে এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে না। সে সকলের সামনে বসে ভিক্ষে করে। মাঝে মাঝে গামছার আড়ালে রিমোট টেপে। রিমোটটা অবশ্য একটা ছোট বাদ্যযন্ত্রের আকারে। লোকে মনে করে সে বুঝি ভিক্ষে করার জন্যেই বাজনা বাজাচ্ছে। 
তবে এটাও তো এক ধরণের ভিক্ষা। তোমরা তোমাদের স্বাধীনতা দাও। আমি তোমাদের সুখ আর অসীম অলসতা দেব।  

মহাসাগরের ওপরে একটা প্রাসাদ হল। বাতাসে ভাসমান। এটা হল রোবোরাজ্য। রোবোরা এটা চালায়। রোবোরাই এর রক্ষণাবেক্ষণ করে। এরপর সব মহাসাগরে এক একটা শাখা খুলবে। এখানে চাষ করার দরকার নেই, বাস করারও। রোদ-বৃষ্টি-হাওয়া কিংবা গরম ঠান্ডা কোনও কিছু থেকেই সুরক্ষা দরকার নেই। দরকার কেবল সূর্যরশ্মির। সেটাই এদের খাদ্য আবার পানীয়। একঘন্টা সূর্যরশ্মি খেয়ে এরা দশঘন্টা কাজ করতে পারে। প্রখর গ্রীষ্মে সারা মাস রোদ খেলে বাকি মাসগুলো চলে যায় দিব্বি। তবে কাজ তেমন না থাকলে সারাদিন চলে যায়। এগুলো অদৃশ্য ডিজিট্যাল রক্ষাকবচে মোড়া। সেখানে মানুষের অস্ত্র প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে। তাই এদের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই সদারঙ্গবিহারীলালের। তাই সে এলুমিনিয়ামের বাটিতে কয়েন নাচিয়ে দিব্বি সুর তোলে টুং টুঙা টুং বলে। 

এই পৃথিবীটা খারাপ হয়ে গেছে। পরিবেশবিদেরা কান্নাকাটি করছে। সাধারণ মানুষ ভাবছে পরিবেশ দূষণ জিনিসটা কেমন? খায় না মাথায় দেয়? সত্যিই চিন্তার নাকি উড়িয়ে দেবার? এ বিষয়ে সদরঙ্গবিহারীলালের সর্বাঙ্গীন যন্ত্র পরিচালিত আর সারা বিশ্বব্যাপী প্রসারিত আর পরিবেশিত সংবাদ পত্র লিখলঃ  
পৃথিবীটা পালটে দেবার ক্ষমতা রাখে সদারঙ্গবিহারীলাল। দরকার হলে নতুন এক পৃথিবী বানাবে তারা। রঙ্গরসে ভরিয়ে রাখবে। 
অচিরেই বানানো হল সে পৃথিবী। জলে স্থলে রঙ্গরসে ভরা সেই পৃথিবী দেখতে পৃথিবীর মতই। তবে চলে ফিরে বেড়াবার ক্ষমতা রাখে আর সারা দুনিয়ায় সে ঘুরে বেড়াবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। এক গ্যালাক্সি থেকে আর এক গ্যালাক্সি। জ্বালানী আর সময় খরচ করে রকেট বানানোর কোনও প্রয়োজন নেই। 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb