অবাক পৃথিবী

লেখক - ড. জয়শ্রী পট্টনায়ক

                                                                                   চিত্রসূত্র – অন্তর্জাল

অসুস্থ শরীরটাকে টানতে টানতে ঝাং চলেছে বেজিং এর রাজপথে। রাজধানী শহরের জাঁকজমক  আর কোলাহলে তার নজর নেই।  দুশ্চিন্তায় মাথা ভার।  হাঁটতে হাঁটতে সে এক প্রায়ান্ধকার সুড়ঙ্গ  পথের মুখে এসে দাঁড়ালো। ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার দেখে নিল রৌদ্রজ্জ্বল পৃথিবীটাকে।  আকাশের দিকে তাকিয়ে খোলা বাতাসে বুক ভরে নিশ্বাস নিল তারপর জল কাদা নোংরা ডিঙ্গিয়ে মাটি থেকে প্রায় ১০/১৮ মিটার গভীরে আরেক শহর ডিক্সিয়া-চেং এর দিকে পা বাড়ালো।  রাজধানী শহরের বিপুল  জনসংখ্যা আর আবাসনের আকাশ চুম্বী দামের জন্য প্রায় দশ লক্ষ নিম্নবিত্ত মানুষের বসবাস ভূগর্ভস্থ এই জনবসতিতে। এখানে সূর্যের আলো না পৌঁছালেও জীবনধারণের জন্য সস্তার বাড়িঘর, দোকানপাট, হোটেল, রেস্তরাঁ, সিনেমা, থিয়েটার ইত্যাদি সবকিছু আছে।   

আস্তানায় ফিরে পরিশ্রান্ত ঝাং ঝপাস করে গড়িয়ে পড়লো বিছানায়। পাশাপাশি আরো তিনটি খালি খাট। সবশুদ্ধ চারজন এই ঘরে থাকে। বাকিরা এখনও ফেরেনি। বয়সে তরুন হলেও অসুস্থ দেহে এতটা পথ হাঁটার ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল, তখন আবার কানে এল সেই সরকারি ঘোষণা    

  • “ শোন শোন শোন সবাই------   

বেজিং সরকার মাটির নীচের এই ভবন গুলো কে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকির কারণে বাড়িগুলোকে যত শীঘ্র সম্ভব খালি করে দিতে অনুরোধ করা হচ্ছে---------।“      

ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ততক্ষণে এই কুঠরির বাকি তিনজন ফিরে এসেছে। উদ্বিগ্ন ঝাং উঠে বসে প্রশ্ন করল--  

-আমাদের কি এবার বাড়ি ছাড়তে হবে?

-ও নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা। গত দুবছর আমরা এখানে এসে অব্দি প্রায় প্রতিদিন এই ঘোষণা শুনছি।  

-তুমি তো এখানে নতুন, তাই ভয় পাচ্ছ । ঈশ্বরে ভরসা রাখো। দ্বিতীয় জন বলে উঠলো ।   

-আমাদের তো আর কোন উপায় নেই, যাব কোথায়? তৃতীয় জনের স্বগোক্তি!          

সত্যি, ঈশ্বরে ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। বাড়ি ভাড়া খুব নগন্য হওয়ার জন্য, কাজের খোঁজে বেজিং আগত দুস্থ লোকজন এবং কর্মরত শ্রমিকদের ডিক্সিয়া-চেং ই প্রধান আশ্রয়স্থল। টাকা জমিয়ে মাটীর উপরের শহরে বসবাসের স্বপ্ন এখানে অনেকে দ্যাখে কিন্তু বাস্তবে তা আর সম্ভব হয় না, অস্বাস্থ্যকর অন্ধকার ভূগর্ভস্থ নগরীতেই কেটে যায় দিন মাস বছর।               

ঝাং এর জন্মের অনেক আগে, ১৯৬৯ সালে সাবেক সোভিয়েত –চিন উত্তেজনা যখন তুঙ্গে তখন পারমাণবিক আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে বেজিং এর মাটির তলায় ৭৮ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত ভূগর্ভস্থ  শহর ‘ডিক্সিয়া-চেং’  নির্মাণের নির্দেশ দেন চিনের কমুনিস্ত পার্টির চেয়ারম্যান মাও যে দং। পরমাণু ও জৈব রাসায়নিক হামলা  থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের বসবাসের উপযুক্ত করে গড়ে তলা হয়েছিলো শহরটিকে । বেজিং এর উপর হামলা হলে যাতে সরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ মানুষ এখানে প্রবেশ করতে পারেন তার জন্য নানান দিক থেকে অসংখ্য  প্রবেশ পথ বা সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল। যদিও যে উদ্দেশে এটি তৈরি করা হয়েছিল পরবর্তীকালে সেই কাজে ব্যাবহার করা হয় নি। পরিবর্তে বেজিংয়ে কর্মরত শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ এখানে থাকতে শুরু করে আর মাটির তলায় বসবাস করার জন্য তারা র‍্যাট ট্রাইবাল নামে পরিচিত সকলের কাছে। নির্মম হলেও সার্থক নামকরণ। সুড়ঙ্গ পথের আনাচে কানাচে অন্ধকার নোংরা বাড়িগুলিতে ইঁদুরের মত বেঁচে আছে ওরা। বর্তমান সরকার এদের নিরাপত্তা সঙ্ক্রান্ত ঝুঁকির কথা বার ঘোষণা করেও সরাতে পারে নি এখান থেকে নিরুপায় মানুষগুলোকে।                   

 ডিক্সিয়া-চেং এর অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরে শুয়ে আর সবার মত ঝাং ও এখন স্বপ্ন দ্যাখে।  না  না, মাটির উপরের ঝলমলে শহরে বসবাসের স্বপ্ন নয়------------- রোগ মুক্তির স্বপ্ন, বাঁচার স্বপ্ন  এবং সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার স্বপ্ন। সেই উদ্দেশে গ্রাম থেকে এত বড় শহরে এসেছে। রোগের উপশম হলেই ফিরে যাবে নিজের ছোট্ট গ্রামে মা বাবার কাছে। ২৬ বছরের ঝাং এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নিলেও ছোট থেকে স্বাস্থ্যবান ছিল।  চেহারাটা হাড়গিলে ধরণের হলেও তার পেটটি ছোটবেলা থেকে একটু ফোলা ছিল, যেন দেহের যত মেদ পেটে এসে জমা হয়েছে।  আর বিশেষ কোন শারীরিক সমস্যা ছিল না। শরীরের বাকি অংশ মোটামুটি স্বাভাবিক। ফোলা পেট নিয়ে স্কুলে সহপাঠীদের অনেক উপহাস কটূক্তি সহ্য করতে হলেও ডাক্তার দেখানোর কথা মাথায় আসেনি কখনো। তাছাড়া তাদের মত দিন মজুরের ঘরে শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে অত মাথা ঘামালে চলে না। সমস্যাটা বাড়ল যখন বয়স প্রায় ২৫। চোখে পড়ার মত বাড়তে থাকলো পেটের ফোলা ভাব সঙ্গে নতুন এক উপসর্গ - শরীরে সর্বদা ভারী ভাব। তার হাঁটা চলা ও স্ফীতোদরের সঙ্গে একজন অন্তঃসত্ত্বার কোন পার্থক্য ছিল না। তাই  গ্রামবাসী তাকে ঠাট্টা করে প্রেগন্যান্ট ম্যান বা গর্ভবান পুরুষ বলে ডাকতে শুরু করল।  

বাবা মা ছেলেকে বললেন,    

-বাবা তুই এবার শহরের বড় ডাক্তার দেখা।      

-এখন চাষের কাজ ফেলে কেমন করে চিকিৎসা করাতে যাই বলত তোমরা! তাছাড়া শরীর একটু ভারী হওয়া ছাড়া আর তো কোন অসুবিধা নেই। হাতে একটু টাকা পয়সা জমুক, তখন না হয় শহরে যাব। সরকারি হাঁসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা হলেও থাকা খাওয়ার তো একটা খরচা আছে!      

বাবা মাকে কোনরকমে শান্ত করলেও নিজেই বুঝতে পারছিল না যে তার পেটে এত মেদ জমা হচ্ছে কি করে। গরীবের সংসারের জোয়াল কাঁধে দিন রাত পরিশ্রম করে, দু বেলা পুষ্টিকর খাবার ও জোটে না তবুও পেটে এত মেদ! এদিকে ধীরেধীরে যেন পাঁজর ঠেলে পেট বাড়তে শুরু করল। শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বেজিং শহরে চলে এলো সে। অনেক খোঁজ খবর করে নাম মাত্র মূল্যে মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজে পেল ভূগর্ভস্থ ডিক্সিয়া-চেং এ।             

এখানে আসার কিছু দিনের মধ্যেই স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পৌঁছল সরকারি হাঁসপাতালে। ডাক্তাররা পেটে টিউমার হয়েছে ভেবে অপারেশানের জন্য ভর্তি করে নিলেন। অপারেশান টেবিলে তার পেটে ছুরি চালিয়ে প্রথমে বেরোল প্রচুর জল তারপর আতঙ্কে পাথর হয়ে গেলেন ডাক্তারের দল। একজন বললেন   

-পেটে প্রচুর হাড়গোড় দেখতে পাচ্ছি।

দ্বিতীয় জন প্রথম জনের সহায়তায় এগিয়ে এসে পেট থেকে টেনে বার করে আনলেন একটা পা।  

গা ছমছম করে উঠলো সকলের। তবু ও সাহস করে পেটে হাত চালাতেই বেরিয়ে পড়লো আরেকটি পা, হাত, থুতনি ইত্যাদির অংশ। ধীরেধীরে বেরিয়ে এলো এক অগঠিত মানবশিশুর দেহাংশ।           

বিভ্রান্ত ডাক্তারের দল বুঝতে পারছিলেন না এটা কি হচ্ছে । আতঙ্ক ও বিস্ময় ঘিরে ধরেছিল তাদের।    

পরে তাঁরা ধরতে পারলেন রোগ। এটি আসলে এক বিরলতম ঘটনা। চিকিৎসা শাস্ত্রে এই ধরনের ঘটনা কে বলে ‘ফিটাস ইন ফিটু’। মায়ের গর্ভেই একটি ভ্রূণর মধ্যে আরেকটি ভ্রূণ জন্ম নেয়। মা যমজ সন্তানের জন্ম দিলেও এক সন্তানের শরীরের ভেতরে জন্ম নেয় আরেক জন। প্রথম জন স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেও আরেকজন পরজীবীর মত থেকে যায় প্রথম জনের শরীরে। ডাক্তাররা বলেন

A fetus in fetu can be considered alive, but only in the sense that its component tissues have not yet died or been eliminated. “

সাধারণত যার শরীরে এসব ঘটছে সে ধীরেধীরে তা টের পায় কিন্ত ঝাং বা তার পরিবার সেই সব উপসর্গ দারিদ্রের চাপে এতদিন অবহেলা করেছে। ইদানীং পেটে জল জমতে শুরু করায়, শরীর ভারী হতে আরম্ভ করল, তাই সে ছুটে এলো হাঁসপাতালে।          

চিকিৎসা শেষে ঝাং কে বিশদে সব বোঝালেন তার চিকিৎসক তারপর প্রশ্ন করলেন—

-আপনি কি আপনার যমজ ভাইয়ের দেহাংশ দেখতে চান?       

সে বিতৃষ্ণায় মাথা নেড়ে না বলে দিল। সারাটা জীবন যাকে শরীরে বয়ে নানান শারীরিক অসুবিধার সঙ্গে লোকের পরিহাসের পাত্র হতে হয়েছে তাকে দেখতে মন চায়নি।     

চিকিৎসা শেষে ঝাং ফিরে গেল গ্রামের আলো হাওয়ায়, প্রকৃতির কোলে। শ্রমিক শ্রেণীর কাজের সুযোগ থাকলেও ইঁদুরের মত বেজিং এ বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়নি। স্ফীতোদর উধাও হতেই আবার শারীরিক সক্ষমতা ফিরে পেয়েছে এবং অধিক পরিশ্রম করে নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে চেষ্টা করছে সে।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb