চিত্রসূত্র – অন্তর্জাল
আকাশে তাকালে চোখে পড়ে একটিই মাত্র চাঁদ। গ্রহনক্ষত্রদের ভিড়ে সবচেয়ে বড়ো, সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে সুন্দর। যুগ যুগ ধরে চাঁদ দেখে মুগ্ধ শিশু থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই। চাঁদ কবি-সাহিত্যিকের, চাঁদ প্রেমিক-প্রেমিকার, শিল্পীর, ধর্মপ্রাণ মানুষের। চাঁদ প্রাণীজগতের উদ্ভিদজগতের। চাঁদ সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের, কৌতুহলী ও অনুসন্ধিৎসু মনের, চাঁদ বিজ্ঞানীদের।
২০০৬ সালে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্লুটো গ্রহ হিসাবে তার মর্যাদা খুইয়ে বামন গ্রহ হিসাবে পরিগনিত হওয়ার পর, সৌরমন্ডলে মোট গ্রহের সংখ্যা ৯টি থেকে হ্রাস পেয়ে এখন হয়েছে ৮টি : বুধ শুক্র পৃথিবী মঙ্গল বৃহস্পতি শনি ইউরেনাস ও নেপচুন। বামন গ্রহের সংখ্যা ৫টি : সেরেস প্লুটো হাউমিয়া মেকমেক এরিস। সব মিলিয়ে ১৩টি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এই তেরোটি গ্রহ ও বামন গ্রহের রয়েছে মোট ২৮৫টি চাঁদ। বুধ ও শুক্রগ্রহের কোনো চাঁদ নেই। পৃথিবীর চাঁদ ১টি। মঙ্গলের ২টি, বৃহস্পতির ৯৫টি, শনির ১৪৬টি, ইউরেনাসের ২৭টি, নেপচুনের ১৪টি। বামন গ্রহদের মধ্যে সেরেসের কোনো চাঁদ নেই; প্লুটোর ৫টি, হাউমিয়া-এর ২টি, মেকমেক-এর ১টি, এরিস-এর ১টি। এছাড়া গ্রহাণুকে ধাক্কা মেরে কিছুটা সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি নাসার 'ডার্ট' মিশনের জন্য বিখ্যাত গ্রহাণু ডিডাইমসের রয়েছে ১টি চাঁদ (আসলে যুগ্ম গ্রহাণু) ডাইমরফস। একটি করে চাঁদ রয়েছে গ্র্হাণু হারমেস, সোম, এফিমভ, মুর, হয়েল, জুইকি, পুলকোভা, ডপলার, লেভি, ডিকেন্স, ইউরেকা, হারকিউলিস, কিয়েভ ইত্যাদির। দুটি করে গ্রহাণু রয়েছে পার্বতী, ক্লিওপেট্রা, মিনার্ভার; তিনটি আছে ইলেক্ট্রার। এভাবে বামন গ্রহ ও ছোটো গ্রহাণুদের চাঁদ আছে ৪৬৭টি। এখনো পর্যন্ত সৌরমন্ডলে মোট চাঁদের সংখ্যা ৭৫২টি। সৌরজগতের বাইরে বহু বহু দূরবর্তী 'এক্সো-প্লানেট' আবিষ্কার হয়েছে প্রায় ৫৭০০টি। তাদেরও কারো কারো নিজের নিজের চাঁদ আছে।
পৃথিবীর কি একটাই চাঁদ ? এই প্রশ্নে আলোড়িত হয়েছে জোতির্বিজ্ঞানীমহল দীর্ঘকাল। বহু পর্যবেক্ষণ হয়েছে। ১৯৮৬ সালে ডানকান ওয়েল্ডরন এক ছোটো গ্রহাণু ৩৭৫৩ ক্রুইন্যা (Cruithne) আবিষ্কার করবার পর ১৯৯৭ সালে পল উইগার্ট, কিসমো ইন্নানেন ও সেপ্পো মিক্কোলার পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেল, ক্রুইন্যার কক্ষপথ বেশ অস্বাভাবিক। ক্রুইন্যার ব্যাস মাত্র ৫ কিলোমিটার, পৃথিবী থেকে সবচেয়ে কম দূরত্ব দাঁড়ায় ১,২০,০০,০০০ (এক কোটি কুড়ি লক্ষ) কিলোমিটার; কক্ষপথ বেশ লম্বাটে ডিমের মত। পৃথিবী এবং ক্রুইন্যা উভয়েই আলাদা আলাদা কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। পৃথিবীর কক্ষপথ কোথাও ক্রুইন্যার কক্ষপথকে ছেদ করছে না। এইসব কারণে আগামী লক্ষ লক্ষ বছরে পৃথিবীর সঙ্গে ক্রুইন্যার সংঘর্ষের কোনো সম্ভাবনা নেই। সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে ক্রুইন্যার সময় লাগে ৩৬৪ (তিনশো চৌষট্টি) দিন, পৃথিবীর চাইতে সামান্য কম; অর্থাৎ পৃথিবীর চেয়ে ক্রুইন্যার গতিবেগ দ্রুততর। তাই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবার পথে ক্রুইন্যার পিছনে পড়ে থাকছে পৃথিবী। প্রতিবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে করতে দূরত্বের ফারাক ক্রমশ বাড়ছে। এরকম চলে বছরের পর বছর। তারপর ঘটছে বেশ অদ্ভুত বেশ মজার ঘটনা। সামনে থেকে এগিয়ে যাওয়া নয়, সবটাই যেন উল্টে গিয়ে পৃথিবী চলে যায় সামনে, তার পিছনে ক্রুইন্যা। প্রায় চারশো বছর অন্তর প্রতিবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবার সময় পৃথিবীর খুব কাছাকাছি থাকে ক্রুইন্যা। এরপর আবার পুরোনো অবস্থায় ফিরে যায়। এরকম চলতে থাকে বারবার। এরফলে পৃথিবী থেকে টেলিস্কোপে এই সময়ে মনে হয়, ক্রুইন্যা যেন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। অর্থাৎ ক্রুইন্যা পৃথিবীর দ্বিতীয় চাঁদ। কিন্তু আদৌ তা নয়। ক্রুইন্যা কোনো সময়ই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল, হাওয়াইয়ের প্যানোরামিক সার্ভে টেলিস্কোপ অ্যান্ড র্যাপিড রেসপন্স সিস্টেম সনাক্ত করেছে ৪১ (একচল্লিশ) মিটার ব্যাসের বেশ ছোটো এক গ্রহাণু (2016HO3)। এটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ৩৬৬ (তিনশো ছেষট্টি) দিনে, প্রায় পৃথিবীর সমান দূরত্ব থেকে। নিজের কক্ষপথে এর গতিপথ এমনই যে মনে হয়, পৃথিবীকে চাঁদের মত প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু আদৌ তা নয়। যাত্রাপথে প্রায় ছয়মাস এটিকে পৃথিবীর সামনে এবং পরের ছয়মাস পিছনে দেখতে পাওয়া যায়। ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর দেখতে পাওয়া গিয়েছিল 2010TK7 গ্রহাণুকে দেখতে পাওয়া যায়, যেটিকে পৃথিবী থেকে চাঁদের মত মনে হলেও, এরা আসলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। সুতরাং এটিও পৃথিবীর উপগ্রহ নয়।
১৮৪৬ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক পেটিট ঘোষণা করেছিলেন, তিনি পৃথিবীর দ্বিতীয় চাঁদ দেখতে পেয়েছেন। তাঁর মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে যখন এটি আসে, তখন এটি পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মাত্র প্রায় সাড়ে এগারো কিলোমিটার (১১.৪) উচ্চতায় থাকে। যেদিনের সভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন নেপচুন গ্রহের যৌথ আবিষ্কারক, লা উরবায়েন ভেরিয়ার। তিনি আপত্তি জানালেন, ঐ উচ্চতায় রয়েছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল, তার সঙ্গে ঘর্ষণের (ড্রাগ) ফলে গতিবেগের পরিবর্তনকে পেটিটের হিসাবের মধ্যে ধরা হয়নি; নতুনভাবে হিসাব করা প্রয়োজন। লা ভেরিয়ারের মত গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীর মতামতকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না পেটিটের পক্ষে। পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের পরিক্রমণ পথের অতি সামান্য বিচ্যুতিকে হিসাবের মধ্যে ধরে এরপর পেটিট ১৮৬১ সালে নতুন করে আবার হিসাব পেশ করলেন; দ্বিতীয় চাঁদের সম্ভাব্য অবস্থানের পূর্বাভাসও দিলেন। কিন্তু পূর্বাভাস অনুযায়ী এই চাঁদ কখনো দেখতে পাওয়া যায় নি। পেটিটের এই চাঁদের কথা জুলে ভার্ণে তাঁর চন্দ্র অভিযানের কল্পকাহিনীতে বর্ণনা করেছেন।
১৮৯৮ সালে গিয়র্গ ওয়াল্টেমথ একটির পরিবর্তে পৃথিবীর অনেকগুলি চাঁদ আছে বলে তাঁর তত্ত্বে দাবী করে বললেন, ৭০০ (সাতশো) কিলোমিটার ব্যাসের এরকম এক চাঁদ পৃথিবী থেকে প্রায় ১০,৩০,০০০ কিলোমিটার (দশ লক্ষ তিরিশ হাজার) দূরে রয়েছে। ওয়াল্টেমথ হিসাব করে বললেন, এই চাঁদ ১৮৯৮ সালের ২রা, ৩রা এবং ৪ঠা ফেব্রুয়ারী সূর্যের সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে দেখা যাবে, অর্থাৎ সূর্যের গায়ে কালো দাগ হিসাবে সরে সরে যেতে দেখা যাবে। গ্রীণল্যান্ড থেকে কয়েকজন পর্যবেক্ষক জানালেন, তাঁরা ঐসব দিনে ঐরকমই দেখেছেন। কিন্তু ঐদিন দুইজন অভিজ্ঞ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডব্লিউ উইঙ্কলার এবং ব্যারণ আইভো ভন বেঙ্কো ঐসময়েই কাছাকাছি এলাকা থেকে পৃথক পৃথকভাবে সূর্য পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তাঁরা দুজনেই বললেন, ঐদিন কয়েকটি সাধারণ সৌরকলঙ্ক তাঁরা সূর্যের উপর দেখতে পেয়েছেন। আসলে গ্রীণল্যান্ডের পর্যবেক্ষকরা ঐদিন সৌরকলঙ্কই দেখেছিলেন; চাঁদ নয়। ওয়াল্টেমথের এই তত্ত্ব ও দাবী পরিত্যক্ত হয়েছে।
এরপর ১৯০০ সালের প্রায় শুরু থেকে জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হেনরি পিকারিং দ্বিতীয় চাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালিয়েছিলন। কিছুই পাওয়া যায় নি। তিনি অবশ্য একই সঙ্গে বলেছিলেন, যদি কোনো পৃথক উপগ্রহ থেকেও থাকে, তার আকার ৩ (তিন) মিটারের চাইতে কম হবে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লাইড টমবাউ প্লুটো গ্রহ (এখন বামন গ্রহ) আবিস্কার করেছিলেন। পৃথিবী এবং চাঁদের মাঝখানে কোনো বস্তুপিণ্ড আছে কিনা তা জানতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র টমবাউকে দায়িত্ব দিয়েছিল। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তখন মহাকাশ অভিযানের চিন্তাভাবনা করছে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৯ পর্য্যন্ত ছয় বছর জুড়ে আকাশ খুঁটিয়ে সমীক্ষা করে টমবাউ জানালেন, এরকম কোনো কিছু তিনিও দেখতে পান নি। তবে ফুটবলের আকারের চাইতে ছোটো কিছু থাকলেও থাকতে পারে, কারণ তাঁর টেলিস্কোপে এর চাইতে ছোটো বস্তু দেখা সম্ভব ছিল না।
চাঁদ বা সূর্যের মত মহাজাগতিক বস্তুর কক্ষপথের দুটি এলাকাকে বলা হয় ল্যাগর্যাঞ্জ এলাকা। ১৯৫১ সালে পোলিশ (পোল্যান্ডের) জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোজেফ উইটকাউস্কি বললেন, চাঁদের ঐ ল্যাগর্যাঞ্জ এলাকাতে খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধূলিকণার মেঘের মত থাকলেও থাকতে পারে। ঐবছর থেকে পোল্যান্ডের অপর এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী কাজিমিয়ের্জ কোরডাইলিউস্কি টেলিস্কোপের সাহায্যে তন্ন তন্ন খুঁজলেন এই দুটি এলাকা। কিন্তু না; আগেকার সব অনুসন্ধানের মত এবারেও কোনো কিছুই মিললো না। নতুন মতামত দিলেন উইটকাউস্কি; তিনি এবার বললেন, ওখানে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখতে পাওয়ার মত বড়ো বস্তুপিণ্ড সম্ভবত নেই। টেলিস্কোপে দেখলে শুধু যে তাদের আকার আকৃতি বেড়ে যায় তাতো নয়; সেইসঙ্গে তাদের মধ্যকার দূরত্বও বেড়ে যায়। তার ফলে অতিক্ষুদ্র আকারের বস্তুকণাগুলিকে আর দেখতে পাওয়া যায় না, খালিচোখে হয়তো দেখা গেলেও যেতে পারে।
আবার পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন কোরডাইলিউস্কি। লোকালয় থেকে দূরে এক পাহাড়ের উপর চলে গেলেন। ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসের এক ঘনকৃষ্ণ অন্ধকার রাত্রি। আকাশ নির্মল প্রশান্ত; চাঁদ উঠতে তখনো অনেক দেরী। কাজিমিয়ের্জ কোরডাইলিউস্কি দেখতে পেলেন ঐ ধূলিপুঞ্জ - অত্যন্ত ম্লান আলোর পটির মত, আকারে চাঁদের অন্তত চারগুণ। ১৯৬১ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে এর ছবিও তুলে ফেললেন কোরডাইলিউস্কি। অর্বিটিং সোলার অবজারভেটরি মহাকাশ টেলিস্কোপের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে এটিকে আবার দেখা গিয়েছে এবং ১৯৯০ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইনিয়ারস্কি পুনরায় এর ছবি তুলতে পেরেছেন।
তাহলে, পৃথিবীর কি আরো দুটি চাঁদ রয়েছে ? দুটির কোনোটিই কঠিন বস্তুপিন্ড নয়। একটি আমাদের অতি প্রিয় চাঁদের অনেকটা সামনে, অন্যটা অতি পরিচিত সবেধন নীলমণি চাঁদের পিছনে। দেখা অত্যন্ত দুরূহ। সত্যিই কি আছে ? নাকি দৃষ্টিবিভ্রম ? সে যাই হোক, আন্তর্জাতিক ভাবে পৃথিবীর স্বীকৃত চাঁদের সংখ্যা তিনটি নয়; কেবলমাত্র একটিই।।
|