পিতা পুত্রের এক সঙ্গে নোবেল জয়

লেখক - পিনাকীশঙ্কর চৌধুরী

                                                                      
চিত্রসূত্র – অন্তর্জাল                

নোবেল প্রাইজ পাওয়া এক দুর্লভ সম্মান। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্বের জন্য দেওয়া হয় এই সম্মান। যে যে বিষয়ে কৃতিত্বের জন্য এই সম্মান দেওয়া হয় সেগুলি হল পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, ফিজিওলজি বা চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং বিশ্বশান্তি। পরবর্তি কালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনীতি।

                যে ব্যক্তি জীবনে একবার এই সম্মান লাভ করতে পারে সে নিজেকে কৃতার্থ বোধ করে।

                আমার আজকের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়ন এই দুটি বিষয়ের মধ্যে।

                ১৯০১ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে ডাব্লু সি রনজেন এবং রসায়নে জ্যাকেবাস হফকে দিয়ে এই মহান স্বীকৃতির জয়যাত্রা শুরু। তারপর থেকে সেই জয়যাত্রা অব্যাহত থেকেছে। প্রতি বছরই সারা বিশ্ব উদ্‌গ্রীব হয়ে জানার জন্য অপেক্ষা করে থকে এবছর কে এই সম্মান লাভ করল। 

                এর মধ্যে কিছু কিছু রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।

                ১৯০৩ সালে প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী মেরি ক্যুরি এই সম্মান লাভ করে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে যৌথভাবে এই সম্মান লাভ করলেন তাঁর স্বামী পিয়ারি ক্যুরির সঙ্গে। একসঙ্গে দুটি রেকর্ড। একজন মহিলা বিজ্ঞানীর প্রথম এই পুরস্কার লাভ এবং একই সঙ্গে একই পরিবারের দু’জনের এই পুরস্কার লাভ। 

                এরপর ১৯১১ সালে মেরি ক্যুরি দ্বিতীয় বার রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়ে আরো দুটি রেকর্ড স্থাপন করলেন। এক যে কোনো একজনের দু’বার নোবেল পাওয়া এবং কোনো এক মহিলার দু’বার নোবেল পাওয়া। দুবার নোবেল জয়  এরপর আরো হলেও একজন মহিলার দু’বার নোবেল জয় সেই এক এবং অদ্বিতীয়।

                এছাড়া আরও এক অমর কীর্তির অধিকারী ছিলেন আমেরিকান বৈজ্ঞানিক লিনাস কার্ল পাওলিন যিনি দু’বার একক ভাবে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি নোবেল জয় করেন রসায়নে এবং আট বছর পরে ১৯৬২ সালেও একক ভাবে এই প্রাইজ পান শান্তির জন্য। দুবার একক ভাবে এই প্রাইজ পাওয়ার আর অন্য উদাহরণ নেই।

                পিতা পুত্রের নোবেল সম্মান লাভ পৃথিবীর ইতিহাসে এক দুর্লভ সম্মান। এই দুর্লভ সম্মানের অধিকারী ছিলেন পিতা জোসেফ জন টমসন (১৯০৬) এবং পুত্র জর্জ প্যাগেট টমসন (১৯৩৭)। দু’জনেই ব্রিটিশ নাগরিক।

                একই পরিবারের একই সঙ্গে বা আলাদা ভাবে নোবেল জয় হয়তো আরো আছে। কিন্তু  ১৯১৫ সালে পিতা পুত্রের একই সঙ্গে নোবেল পাওয়ার যে ঘটনা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে সেটার পুনরাবৃত্তি দেখার জন্য আমাদেরকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে।

                এই কালজয়ী ঘটনার নায়ক দুজন হলেন পিতা উইলিয়াম হেনরি ব্রাগ এবং পুত্র উইলিয়াম লরেঞ্জ ব্রাগ। তাঁরা ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। 

                স্যার উইলিয়াম হেনরি ব্রাগ ছিলেন একাধারে ফিজিসিস্ট কেমিস্ট এবং ম্যাথমেটিসিয়ান। সেই সঙ্গে একজন কৃতি খেলোয়ার্ডও ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৮৬২ সালের ২ জুলাই ওয়েস্ট ওয়ার্ড নামের এক অখ্যাত গ্রামে। সাত বছর বয়সে মাকে হারান এবং কাকিমার স্নেহে বড় হন। কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে ১৮৮৪ সালে “র‍্যাংলার” সম্মান সহ স্নাতক হন। (কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে সব বিষয়ের মধ্যে যিনি সব চেয়ে বেশি নম্বর পেতেন তাঁদের প্রথম তিনজন হতেন প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় র‍্যাংলার। হেনরি ব্রাগ হয়েছিলেন তৃতীয় র‍্যাংলার।) ১৮৮৫ সালে তিনি ট্রাইপোজ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

                ১৮৮৫ সালে ২৩ বছর বয়সে অষ্ট্রেলিয়ার এডিলেড ইউনিভার্সিটিতে “এল্ডার প্রফেসার অফ ম্যথেমেটিক্স অ্যাণ্ড এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স” পদে নিযুক্ত হন। পদার্থ বিদ্যায় নিজের ব্যবহারিক জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য তিনি এই সময় একটা যন্ত্র তৈরির কোম্পানীতে অ্যাপ্রেন্টিস হিসাবে যোগ দেন। ইউনিভারসিটিতে তিনি ছাত্রদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।  

                ১৮৯৫ সালে নিউজিল্যাণ্ড থেকে কেম্ব্রিজ যাবার পথে তাঁর পরিচয় হয় আর্নস্ট রাদারফোর্ডের সঙ্গে। এই বন্ধুত্ব সারা জীবন স্থায়ী হয়। উইলহেল্‌ম্‌ রনজেনের এক্স-রে র ব্যাপারে তিনি আকৃষ্ট হন। ১৮৯৬ সালের ২৯ মে তারিখে তিনি স্থানীয় ডাক্তারদের সামনে এক্স-রে র ডিমন্সট্রেশন দিয়ে অনেক অদৃশ্য বস্তুকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে দেখান। তাঁদের মনের সন্দেহ নিরিসনের জন্য তিনি নিজেরই হাতের একটা এক্স-রে করতে রাজি হয়ে যান। (এই কাজটা এক্স-রে আবিষ্কারের পর রনজেন নিজেও করেছিলেন।) হেনরি ব্রাগের এই কাজের ফলটা হয়েছিল বেশ মজার। সেই এক্স-রেতে তাঁর হাতে ছোটোবেলায় খেলতে খেলতে আঘাত পাওয়া হাড়ের একটা দাগ ধরা পড়ে যায়।

                হেনরি ব্রাগ পরে ১৯০৯ থেকে ১৯১৫ লীড্‌স্‌-এ ক্যাভেণ্ডিস প্রফেসার অফ ফিজিক্স পদে, ১৯১৫ থেকে ১৯২৫ ইউনিভারসিটি কলেজ অফ লণ্ডনে কুইন প্রফেসার অফ ফিজিক্স পদে এবং পরবর্তী জীবনে রয়াল ইন্সটিটিউশনে ফুলেরিয়ান প্রফেসার অফ কেমিস্ট্রি পদে কাজ করেন।

                ১৯১৩ – ১৪ সালে তিনি পুত্র লরেন্স ব্রাগের সঙ্গে গবেষণা ক’রে এক্স-রে র সাহায্যে ক্রিস্টাল স্ট্রাকচারের বিশ্লেষণের এক দিগন্ত উন্মোচন করেন। এই কাজের স্বীকৃতিতে ১৯১৫ সালে পিতা হেনরি ব্রাগ এবং পুত্র লরেন্স ব্রাগকে যুগ্মভাবে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।

                প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হেনরি ব্রাগের উপর জলের নিচের তরঙ্গ বিচার ক’রে সাবমেরিনের উপস্থিতি অনুসন্ধানের ভার দেওয়া হয়েছিল। এই কাজে তাঁর সাফল্যের জন্য ১৯১৭ সালে তাঁকে C.B.E. এবং ১৯২০তে নাইট সম্মানে ভূষিত করা হয়। ১৯০৭ সাল থেকেই তিনি রয়াল সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ১৯৩৫ সালে তিনি সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। হেনরি ব্রাগকে ১৬টা বিশ্বিবিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডিক্টরেট দেওয়া হয়। তিনি বিদেশেরও বহু প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলেন। বহু পুরস্কারও লাভ করেন। তার মধ্যে ১৯১৬তে রূমফোর্ড মেডেল ১৯৩০এ কোপলে মেডেল অন্যতম।

                ১৯৪২ সালের ১২ মার্চ এই কর্মময় এবং বর্ণময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। 

                হেনরি ব্রাগের পুত্র লরেন্স ব্রাগও ছিলেন পিতার মতোই প্রতিভাধর। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৯০ সালের ৩১ মার্চ দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড শহরে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা হয় সেন্ট পিটার্‌স্‌ কলেজে। ১৯০৮ সালে গণিতে প্রথম শ্রেণীর অনার্স নিয়ে স্নাতক হন। ১৯০৯ সালে পিতার সঙ্গে ইংলণ্ডে চলে আসেন এবং কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১২ সালে ট্রাইপোজ পাশ করেন। এই বছরই তাঁর প্রথম পেপার প্রকাশিত হয়।

                ১৯১৪ তে ট্রিনিটি কলেজে ন্যাচারাল সায়েন্সের ফেলো এবং লেকচারার  নিযুক্ত হন। একই বছর তিনি বার্নার্ড মেডেল পান। ১৯১২ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত পিতার সঙ্গে এক্স-রে র সাহায্যে ক্রিস্টাল স্ট্রাকচারের উপর গবেষণা করেন এবং ১৯১৫ তে “এক্স-রে অ্যাণ্ড ক্রিস্টাল স্ট্রাকচার” নাম দিয়ে একটা পেপার প্রকাশ করেন। তাঁদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯১৫ তেই পিতা পুত্রকে যুগ্মভাবে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়। এই সময় লরেন্স ব্রাগের বয়স ছিল মাত্র ২৫ বৎসর। ফিজিক্স-এ এত অল্প বয়সে নোবেল পুরস্কারের এটাই আজ পর্যন্ত রেকর্ড হয়ে আছে।

                ১৯১৯ সাল পর্যন্ত লরেন্স ব্রাগ Sound ranging to the map section, G.H.Q. Franceএর টেকনিকাল অ্যাডভাইসার হিসাবে কাজ করেন। এই কাজে কৃতিত্বের জন্য তিনি OBE এবং MC উপাধি লাভ করেন। ১৯১৯ সালে তিনি ম্যাঞ্চেস্টার ইউনিভার্সিটিতে ‘ল্যাঙোয়ার্দি প্রফেসার’ নিযুক্ত হন এবং ১৯৩৭ পর্যন্ত সেই পদে কাজ করেন।

                লরেন্স ব্রাগ ১৯২১ সালে রয়্যাল সোসাইটির সদস্য হন। ১৯৩৭–৩৮ সালে National Physical Laboratory-র ডাইরেক্টর ছিলেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে Cavendish Professor of Experimental Physics পদে কাজ করেন। ১৯৫৮-৬০ তে Frequency Advisory Committee-র চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।           

                ১৯৪১এ তাঁকে Knight উপাধি দেওয়া হয়। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিগ্রি ও ডক্টরেট পান। আমেরিকা ফ্রান্স সুইডেন চিন হল্যাণ্ড বেলজিয়ামে নানা বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩১এ রয়্যাল সোসাইটির হিউজেস মেডেল, ১৯৪৬এ ওই সোসাইটিরই রয়্যাল মেডেল এবং ১৯৪৮এ আমেরিকার মিনারাল সোসাইটির রোবলিং মেডেল পান। পিতা পুত্র মিলে তাঁরা অনেক পেপার প্রকাশ করেন।

                ১৯৭১ সালের ১ জুলাই এই প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর জীবনাবসান হয়। 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb