গণিতের ট্র্যাজিক হিরো নিলস হেনরিক অ্যাবেল

লেখক - বিকাশ মণ্ডল

সময়টা ছিল ১৮২৯ সালের ৮ই এপ্রিল। বার্লিন শহর থেকে একটি চিঠি নরওয়ের একটি ছোট্ট গ্রাম ফ্রোল্যান্ডে এসে পৌঁছালো । পত্র প্রেরকের নাম অগাস্ট লিওপোল ক্রেল। ক্রেল চিঠিতে লিখেছিলেন, “ আপনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনি এখন সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারেন। আপনি এখন আমাদেরই একজন এবং নিরাপদ।“ সবশেষে লিখলেন, ” আপনি একটি ভালো দেশে, একটি ভালো জলবায়ুতে , বিজ্ঞানের কাছাকাছি এবং আন্তরিক বন্ধুদের কাছে আসবেন যারা  আপনাকে প্রশংসা করে এবং ভালোবাসে।“  কিন্তু হায়! ভাগ্যের কী পরিহাস। যাঁর নামে এই চিঠি, যাঁর জন্য এই সুখবর, সেই মানুষটিই তো মাত্র দুদিন(৬ই এপ্রিল) আগেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।  সেই মানুষটি হলেন গণিতের ট্র্যাজিক হিরো নিলস হেনরিক অ্যাবেল যিনি মাত্র ২৬ বছরে তাঁর অসামান্য গণিত প্রতিভার নিদর্শন রেখে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।

১৮০২ সালের ৬ই আগস্ট নরওয়ের স্ত্র্যান্দা গ্রামে এক দরিদ্র ধর্মযাজকের ঘরে   নিলস হেনরিক অ্যাবেলের জন্ম। তিনি ছিলেন পিতা সোরেন জর্জ  অ্যাবেল এবং মাতা অ্যানি মারী সাইমনসেনের দ্বিতীয় পুত্র। ১৮১৫ সালে অ্যাবেলের বয়স ১৩ বছর হলে তাঁর পিতা তাঁকে ক্যাথিড্রাল স্কুলে ভর্তি করে দেন। তখন ওই  স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন হ্যান্স পিটার বেডার। শিক্ষক হিসাবে তাঁর সুনামও  ছিল। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে একদিন ঘটে গেল এক অঘটন। অঘটনটি ঘটেছিল ১৮১৯ সালের নভেম্বার মাসে। এক ছাত্রকে তিনি এমনভাবে বেত্রাঘাত করেছিলেন যে সেই ছাত্রটি দীর্ঘ আটদিন শয্যাশায়ী থাকার পর আঘাতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। এই ঘটনায় স্কুলের অন্যান্য ছাত্ররা এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পরেছিল যে ওই শিক্ষকের ক্লাস আর কেউ করতে চাইত না। শেষমেশ তাঁকে ওই স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হল । স্কুলের  প্রধান শিক্ষক তড়িঘড়ি তাঁরই এক প্রাক্তন ছাত্র বার্নট মাইকেল  হম্বোকে  ওই শূন্যপদে  নিয়োগ করলেন। এই নতুন অঙ্কের শিক্ষকের চোখে  অ্যাবেলের  অসাধারণ গণিত প্রতিভা প্রথম  ধরা পরেছিল। প্রকৃতপক্ষে মাইকেল হম্বোই ছিলেন  অ্যাবেলের গণিতগুরু। অ্যাবেল  স্কুলের পাঠ শেষ করে ১৮২১ সালে রয়্যাল ফ্রেডরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে রাখা সমস্ত গণিত বই তিনি অধ্যায়ন করেছিলেন। এই সময় তিনি পঞ্চমঘাত সমীকরণের উপর কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে একটি পঞ্চম বা ততোধিক ঘাত সম্পন্ন সমীকরণের সমাধান সম্ভব নয়। স্নাতক হওয়ার পর অ্যাবেল  অধ্যাপক ক্রিস্টোফার হ্যানস্টিনের বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন। ১৮২৩ সালে নরওয়ের প্রথম বিজ্ঞান পত্রিকা “ম্যাগাজিন অব ন্যাচারাল সায়েন্সেস” এ অ্যাবেলের গাণিতিক নিবন্ধ প্রথম ছাপা হয়েছিল। অধ্যাপক হ্যানস্টিন ছিলেন এই পত্রিকার সহ সম্পাদক।  ১৮২৫ সালে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি চেয়ে অ্যাবেল নরওয়ের রাজা কার্ল জোহানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। রাজা তাঁকে অনুমতি দিলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারবন্ধুর সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণে পাড়ি দেন। বিদেশ ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গটিংজেনে তৎকালীন সর্বাধিক জনপ্রিয়, বিশ্ববিখ্যাত গণিতবিদ গাউসের সঙ্গে দেখা করা এবং তারপর প্যারিসে যাওয়া। কিন্তু বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে  প্রথমে তিনি কোপেনহেগেনে এবং তারপর সেখান  থেকে  বার্লিনে পৌঁছান। তিনি বার্লিনে চারমাস কাটিয়েছিলেন এবং এই সময় অগাস্ট লিওপোল ক্রেলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। ক্রেলের সম্পাদিত গণিত পত্রিকায় তিনি তাঁর একাধিক গণিত নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। সীমিত অর্থের কারণে অ্যাবেল তাঁর বিদেশ সফর বাতিল করে ১৮২৭ সালের মে মাসে নরওয়েতে ফিরে আসেন। ১৮২৭ সালের ক্রিসমাসে তিনি তাঁর বাগদত্তা ক্রিস্টিন কেম্পের সঙ্গে দেখা করতে  ফ্রোল্যান্ডে যান। যাত্রা পথে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। যদিও তিনি এরপর আরও কিছুদিন সুস্থ ছিলেন , তবুও তিনি আর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি কখনও । ১৮২৯ সালের ৬ই এপ্রিল মাত্র ২৬ বছর বয়সে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছিলেন। মৃত্যুর মাত্র দুদিন পরে ক্রেলের সেই চিঠি এসে পৌছায় যাতে অ্যাবেলকে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদে নিয়োগের কথা লেখা ছিল।

মাত্র ছাব্বিশ বছরের জীবনে গণিতে অ্যাবেলের অসাধারণ অবদান তাঁকে আজও অবিস্মরণীয় করে রেখেছে। তাঁর  অজস্র অবদানের মধ্যে কয়েকটি হল--  অ্যাবেল সমীকরণ,  অ্যাবেল ফাংশান,  অ্যাবেলীয়ান  গ্রুপ , অ্যাবেলের উপপাদ্য ইত্যাদি। গণিতে তাঁর অবদান সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফরাসী গণিতবিদ চার্লস হারমাইট বলেছিলেন,” অ্যাবেল গণিতবিদদের পাঁচশ বছর ব্যস্ত রাখার জন্য যথেষ্ট রেখে  গেছেন।“  

গণিতে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য প্রতি বছর এক বা একাধিক গণিতবিদকে গণিতের নোবেল নামে পরিচিত তাঁরই নামাঙ্কিত “অ্যাবেল পুরস্কার” প্রদান করা হয়।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb