অ্যালিগেটর গার ও পরিবেশের বিপদ

লেখক - সৌম্যকান্তি জানা

                                    

গত ২৯ অক্টোবর সকালে জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকের একটা খবরে গেল চোখ আটকে – “ডায়মন্ড হারবারে মিলল মৎস্য অবতার, ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ ঘিরে চাঞ্চল্য”। খবরটা পড়ে বছর দশেক আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আমার সহকর্মী একদিন বলল, “আমার পুকুরে একটা অদ্ভুত মাছ পাওয়া গেছে। জালে উঠেছে। লোকজন দেখে বলছে এটা নাকি ক্রোকোডাইল ফিস। অ্যাকোয়ারিয়ামে পোষে। কেউ নিশ্চয়ই আমার পুকুরে কখনও ছেড়ে দিয়েছিল। তুমি চেনো?” এই বলে তিনি আমাকে মোবাইল ফোনে তোলা মাছটার ছবি দেখালেন। ক্রোকোডাইল ফিসের ছবি আগে কোথাও দেখেছিলাম। হয়তো কোনও পত্রিকায় বা টিভিতে। ঠিক মনে নেই। সবজান্তা গুগলের শরণাপন্ন হলাম। দেখলাম, হ্যাঁ ওটা ক্রোকোডাইল ফিসই। সহকর্মীটি জানতে চাইলেন, “এই মাছ কি খাওয়া যায়?” বললাম, “আমাদের দেশে যে খাওয়া হয় না তা নিশ্চিত। তবে আজকাল মানুষে কী না খায়!” উনি বলছিলেন, ওঁর পুকুরের প্রায় সব মাছই নাকি সাবাড় করে দিয়েছে ওই ক্রোকোডাইল ফিস। আমি বললাম, “মাছটা আমাকে দাও। আমি স্কুলের ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষণ করে রাখবো।” সেই থেকে সাত-আট ইঞ্চি লম্বা ক্রোকোডাইল ফিসটি আমার ল্যাবে জারবন্দী। আর তাই সংবাদপত্রের খবরটি পড়ে আমার আদৌ বিস্ময় জাগেনি, বরং চিন্তার ভাঁজ পড়ল কপালে।

চিন্তার কারণটা পরে বলছি। আগে ক্রোকোডাইল ফিসের পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলি। ক্রোকোডাইল ফিস হল এর সাধারণ নাম। কুমিরের সাথে এর আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। আসলে এর লম্বাটে চোয়াল আর তাতে তীক্ষ্ণ দাঁতের দুটি সারি এবং দেহ জুড়ে শক্ত ও ধারলো আঁশের উপস্থিতির জন্য সাধারণ লোক এর সাথে কুমিরের মিল খুঁজে পেয়েছে।

ক্রোকোডাইল ফিসের বিজ্ঞানসম্মত নাম অ্যালিগেটর গার (Alligator gar)। উত্তর আমেরিকার মেছো কুমির অ্যালিগেটরের সাথে এদের লম্বাটে চোয়ালের সাদৃশ্য থাকায় এমন নাম। এই মাছ আদতে উত্তর আমেরিকার আদি বাসিন্দা। এরা উত্তর আমেরিকায় মিষ্টি জলে বসবাসকারী মাছদের মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড়ো হয়। গড়ে এরা লম্বায় ছ’ফুট আর ওজন ৪৫ কেজি। তবে ১০ ফুট পর্যন্ত লম্বা ও ১৫৯ কেজি ওজনের অ্যালিগেটর গার পাওয়া গেছে।

মাছটার নানারকম বিশেষত্ব আছে। এদের পটকা অন্য মাছেদের থেকে ভিন্ন। এদের পটকার সাথে ফুলকার সংযোগ আছে। ফলে পটকা যে এদের শুধু জলের মধ্যে ভাসতে বা ডুবতে সাহায্য করে তাই-ই নয়, শ্বাসকার্যেও সাহায্য করে। আর তার ফলে কম অক্সিজেনযুক্ত যে জলে অন্য মাছের পক্ষে বাঁচা কষ্টকর সেখানে এরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। এদের আঁশও অন্য মাছেদের থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। অত্যন্ত ধারালো, করাতের মতো খন্ডিত কিনারাযুক্ত, রম্বসাকৃতি ও খুব শক্ত এই আঁশ গ্যানয়েড প্রকৃতির। এইরকম আঁশের জন্য অন্য কোনও জলজ প্রাণী এদের খাদ্য হিসেবে শিকার করতে পারে না। এদের পৃষ্ঠ পাখনা আর পায়ু পাখনা দেহের অনেকটা পেছনের দিকে থাকে যা সচরাচর অন্য মাছের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। আর পুচ্ছ পাখনা হাঙরের পুচ্ছ পাখনার মতো অসম-বিভক্ত অর্থাৎ হেটেরোসারকাল। আবার হাঙরের সাথে আরও একটা মিল আছে। হাঙরের মতো এদের অন্ত্রেও সর্পিলাকার কপাটিকা (Spiral Valve) উপস্থিত। এইসব বৈশিষ্ট্য দশ কোটি বছর আগেকার অ্যালিগেটর গারের জীবাশ্মেও দেখা গিয়েছে। অর্থাৎ এরা কমপক্ষে দশ কোটি বছর ধরে প্রায় কোনও পরিবর্তন ছাড়াই বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে। তাই অ্যালিগেটর গারকে “জীবন্ত জীবাশ্ম” বা “Living Fossil” বলা যায়। প্রাগৈতিহাসিক অ্যালিগেটর গারের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ভারত থেকে। এ থেকে বোঝা যায় প্রাচীনকালে মাছটির বিস্তার ছিল প্রায় সমগ্র পৃথিবী জুড়ে।

অ্যালিগেটর গার খাদ্য হিসেবে প্রধাণতঃ মাছ শিকার করে। এছাড়া কাঁকড়া, কচ্ছপ, এমনকি জলজ পাখিও খায়। এরা রাত্রিবেলায় খাবার শিকার করতে অভ্যস্ত। এরা বাঁচে দীর্ঘদিন। স্ত্রী মাছ ডিম পাড়ার উপযুক্ত হয় প্রায় দশ বছর পর। যখন জলের উষ্ণতা ২০-২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পৌঁছোয় এবং জলে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায় তখন ঘাস ও আগাছাপূর্ণ জলাশয়কে ডিম পাড়ার উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেয়। এক একবারে এরা প্রায় দেড় লক্ষ ডিম পাড়ে। ডিমের রঙ উজ্জ্বল লাল। আর এই ডিম বিষাক্ত। মানুষ যদি ভুল করে খেয়ে নেয় বিষক্রিয়াজনিত কারণে মৃত্যুও হতে পারে। খাদ্য হিসেবে মাছটি মানুষের গ্রহণযোগ্য না হলেও উত্তর আমেরিকা ও ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জের আদি অধিবাসীরা এই মাছের আঁশ দিয়ে তীরের ফলা বানানোর কৌশল আয়ত্ত করেছে বহুকাল আগে থেকে। তাছাড়া এই মাছের চামড়া দিয়ে প্রাচীনকালে মানুষ কাঠের লাঙলের আবরণ তৈরি করত।

বর্তমানকালে কেবল অ্যাকোয়ারিয়ামে পালন করা ছাড়া অন্য কোনও কাজে এই মাছ ব্যবহার করা হয় না বললেই চলে। আর এটাই পরিবেশের জন্য হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক। মাছের আকার যখন অ্যাকোয়ারিয়ামে পালনের পক্ষে বড়ো হয়ে যায় তখন অনেকেই এই মাছকে অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে বের করে স্থানীয় জলাশয়ে ছেড়ে দেয়। যেহেতু এরা প্রতিকূল পরিবেশে দারুণ অভিযোজিত হতে পারে তাই এরা জলাশয়ে দিব্যি বেঁচে থাকে। পুকুর, খাল-বিল, হ্রদ বা নদীর স্বাভাবিক মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীদের নির্বিচারে খেয়ে ফেলে জলজ বাস্তুতন্ত্রের দফারফা করে দেয়। অ্যাকোয়ারিয়ামে চাষের জন্য যে-সব প্রজননকেন্দ্রের জলাশয়ে এই মাছের বাচ্চা চাষ করা হয় সেখানে যদি বন্যা হয়ে যায় তবে সহজেই এই মাছ বিপুল পরিমাণে জলজ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। কিছুদিন আগে কেরালায় ভয়াবহ বন্যার সময় এই ঘটনা ঘটেছে।

শুধু অ্যালিগেটর গার নয়, একই দোষে দুষ্ট আরও কিছু বিদেশি মাছ, যেমন তেলাপিয়া, রূপচাঁদা, আফ্রিকান মাগুর ইত্যাদি। আফ্রিকার স্বাভাবিক মাছ তেলাপিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার স্বাভাবিক মাছ রূপচাঁদা (Red bellied Pacu) বা আফ্রিকান মাগুর যদিও খাদ্য হিসেবে বর্তমানে আমাদের দেশে চাষ হচ্ছে। কিন্তু এগুলো বন্যার সময় চাষের পুকুর থেকে নদী-খাল-হ্রদ ইত্যাদিতে সহজেই চলে যাচ্ছে এবং তারপর ওইসব জলাশয়ের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর প্রমাণও আমরা পাচ্ছি। আগে গঙ্গায় যে পরিমাণ স্বাভাবিক মাছ পাওয়া যেত এখন তার অধিকাংশই পাওয়া যায় না। বরং পাওয়া যায় ওইসব বহিরাগত মাছের প্রজাতি।

তাহলে এই বিপদ থেকে রক্ষার উপায় কী? উপায় তো আইনেই বলা আছে। জীববৈচিত্র্য আইন (২০০২) অনুসারে পরিবেশের পক্ষে বিপজ্জনক কোনও বিদেশি প্রজাতিকে দেশের মধ্যে আনা বা প্রতিপালন করা দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আইনের রক্ষকরা যদি চোখ বুজে থাকেন তবে পরিবেশ রক্ষা পাবে কী করে? শুধু অ্যালিগেটর গার নয়, পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর সমস্ত বিদেশি প্রজাতির মাছের চাষ দ্রুত বন্ধ করার জন্য সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।  আর আইন অমান্যকারীদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশে বিদেশি প্রজাতির মাছের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও গড়ে তুলতে হবে। পরিবেশ রক্ষা পেলে তবেই না আমরা বেঁচে থাকবো।

                               

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb