এক ব্যতিক্রমী বিজ্ঞানী জর্জ ওয়াশিংটন কার্ভার

লেখক - ড. শতাব্দী দাশ


                                                                                      
বিজ্ঞানীদের জীবন আমাদের সবসময়ই প্রেরণা দেয়, উৎসাহ দেয়।  তাঁদের জীবন সংগ্রামের কথা পড়লে আমরা জানতে পারি যে কত প্রতিকূলতাকে সরিয়ে, পাহাড় প্রমাণ বাধা ডিঙিয়ে তাঁরা বিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরকমই একজন বিজ্ঞানী হলেন জর্জ ওয়াশিংটন কার্ভার। তাঁর শৈশবের কথা জানলে অবাক হতে হয়।

বিজ্ঞানী জর্জ ওয়াশিংটন কার্ভার ছিলেন আমেরিকার একজন কৃষিবিজ্ঞানী। তিনি বহু- চাষ পদ্ধতির (multiple cropping system) প্রবক্তা , যে পদ্ধতিতে একই জমিতে চক্রাকারে বিভিন্ন ফসল চাষ করে জমির গুণাগুণ বাড়িয়ে নেওয়া যায়। এতে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এক ফসলী চাষ ব্যবস্থা থেকে এই ভাবে চাষের ফলে জমির অবস্থা যেমন ভাল হয়, তেমনি একাধিক ফসলও পাওয়া যায় একই জমি থেকে।

জর্জের বিজ্ঞানী জীবনের কথায় পরে আসছি। এখন বলি তাঁর শৈশবের কথা।

কার্ভারের বাবা-মা ছিলেন আমেরিকার মিসৌরির নিউটন কাউন্টির এক খামার- মালিকের ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসী। হ্যাঁ,  তখনও সেখানে ক্রীতদাস প্রথা চলত রমরমিয়ে।  কার্ভার- এর জন্মের আগেই তাঁর বাবা গাইলস্ এর মৃত্যু হয়। তাঁর মায়ের নাম ছিল মেরী।  তাঁরা যার কাছে ক্রীতদাস ছিলেন তিনি হলেন আদতে একজন জার্মান,  নাম মোজেস কার্ভার।  ১৮৫৫ সালে এই মোজেস মেরী ও গাইলস্ কে ক্রয় করেন উইলিয়াম ম্যাক গিনিস এর কাছ থেকে।

বিজ্ঞানী কার্ভার এর জন্ম ১৮৬০ দশকের কোনো এক বছরে ( সম্ভবত ১৮৬৪)। তাঁর আরও দুজন বড় ভাই- বোন ছিল।  তাঁর বয়স যখন মাত্র এক সপ্তাহ,  তখন এক রাতে তাঁর মা- বোনের সঙ্গে তিনিও অপহৃত হন।  তাঁদের তিনজন কে কেন্টাকিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়।  তাঁদের মালিক মোজেস কার্ভার তাঁদের খুঁজে বের করার জন্য লোক নিযুক্ত করেন। পরে জর্জ কে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হন,  কিন্ত তাঁর মা আর বোন কে খুঁজে পাওয়া যায় নি।  ১৮৬৫ সালে মিসৌরিতে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হয়। এরপর মোজেস কার্ভার ও তাঁর স্ত্রী সুসান জর্জ ও তাঁর দাদা জেমস কে নিজেদের সন্তানের মতই পালন করেন।  সুসান -এর কাছেই তাঁর প্রথম পড়ালেখা শেখা।

যেখানে কার্ভার থাকতেন , সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের  পড়ার জন্য কোনও বিদ্যালয় ছিল না ( আগে বলা হয় নি,জর্জ ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ)। প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরের একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য তিনি নিওশো (Neosho) শহরে পৌঁছালেন যখন,  তখন রাত ঘনিয়েছে। তিনি এক জায়গায় ঘুমিয়ে পড়লেন।  পরদিন সকালে তিনি মারিয়া ওয়াটকিনস্ নামে এক ভদ্রমহিলার সাক্ষাৎ পেলেন এবং তাঁর কাছে ঘর ভাড়া নিতে চাইলেন। মারিয়া যখন জানলেন যে জর্জ হলেন কার্ভার এর জর্জ,  তখন তিনি জর্জকে বললেন যে ঐদিন থেকে তিনি হলেন জর্জ কার্ভার।

মারিয়া ওয়াটকিনস্ তাকে বলেছিলেন, " তোমার যা কিছু ইচ্ছা, তুমি শেখো, এবং শিক্ষা শেষে যা শিখেছ তা মানুষের কাছে ফিরিয়ে দাও। " এই কথার গভীর প্রভাব পড়েছিল জর্জের জীবনে।

১৩ বছর বয়সে তিনি কান্সাসে অন্য একটি পরিবারে আশ্রয় পান।  পরে ঐ শহর ছেড়ে তিনি বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং কানসাসের মিনিয়াপোলিস হাইস্কুল থেকে ডিপ্লোমা পান।

এই সময়ে জর্জ কার্ভার নামে অন্য এক ব্যক্তি ছিলেন ঐ শহরে। এতে চিঠিপত্র পেতে তাঁর অসুবিধা হত।  প্রায়ই তাঁর চিঠি অন্য 'জর্জ কার্ভার' এর কাছে পৌঁছে যেত। তাই তিনি তাঁর নামের মাঝে 'ওয়াশিংটন ' শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেন।

কার্ভার বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হবার চেষ্টা করতে লাগলেন। পরে কানসাসের হাইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ভর্তির আবেদন বিবেচিত হল।
কিন্তু তিনি সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হল তিনি কৃষ্ণাঙ্গ বলে। তিনি শহর ছেড়ে চলে এলেন এবং একটি ছোট সংগ্রহালয় গড়ে তুললেন তাঁর বাড়ির লাগোয়া অঞ্চলে, যেখানে প্রচুর ফুলের গাছ ও ভূতাত্বিক সংগ্রহ রাখলেন।  প্রায় ১৭ একর জমি তিনি নিজের হাতেই চাষ করতেন এবং সেখানে লাগাতেন ধান,  ভুট্টা, ফলের গাছ, বনাঞ্চলের কিছু গাছ।  কাছাকাছি শহরে গিয়ে বিভিন্ন রকম কাজ করে অর্থ উপার্জন করতেন তিনি।

১৮৯০ সালে তিনি আইওয়াতে শিল্পকলা এবং পিয়ানো বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।  তাঁর অঙ্কন শিক্ষক তাঁর ফুল ও গাছপালা আঁকার বিষয়ে প্রতিভার কথা বুঝতে পারেন।  ওই শিক্ষক তাঁকে আইওয়া স্টেট এগ্রিকালচারাল কলেজে ( বর্তমানে আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি)  তে উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে পড়ার জন্য উৎসাহ দেন।

১৮৯১ সালে তিনি ওই কলেজে পড়া শুরু করেন। তিনি ছিলেন 'আইওয়া স্টেট ' এ প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র।  ১৮৯৪ সালে তিনি সেখান থেকে ব্যাচেলরস ডিগ্রি পেলেন।  তাঁর থিসিসের শীর্ষক ছিল "  Plants as modified by Man"। ওখানকার অধ্যাপকদের পরামর্শে তিনি ওখানেই মাস্টার্স ডিগ্রি করতে মনস্থ করেন।  পরবর্তী দুবছর তিনি আইওয়া এক্সপেরিমেন্ট স্টেশনে গবেষণা করেন। এখানে তিনি গাছের রোগ এবং ছত্রাকের ওপর কাজ করেন  । এইসময় দেশব্যাপী তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে একজন তরুণ উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিসেবে। ১৮৯৬ সালে কার্ভার মাস্টার্স ডিগ্রি পেলেন।  তিনি প্রথাগত ভাবে ডক্টরেট ডিগ্রি না পেলেও,  পরবর্তীকালে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে, সিম্পসন কলেজ এবং সেলমা বিশ্ববিদ্যালয়। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মরণোত্তর 'ডক্টরেট' পান ১৯৯৪ সালে।
১৮৯৬ সালেই টাস্কগি বিশ্ববিদ্যালয়ের ( Tuskegee Institute) প্রথম অধ্যক্ষ ও প্রেসিডেন্ট বুকার টি. ওয়াশিংটন তাঁকে ঐ প্রতিষ্ঠানে কৃষি বিভাগের প্রধান পদে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান।  সেখানেই তিনি ৪৭ বছর অধ্যাপনা করেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ও পরিশ্রমে ঐ বিভাগটি গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। তিনি চক্রাকার পদ্ধতিতে শস্য চাষ (crop rotation) এবং নতুন নতুন শস্য চাষের পদ্ধতি শেখাতেন চাষিদের। তিনি প্রধানত তুলো চাষের জমিতেই এই চক্রাকার চাষ পদ্ধতির প্রচলন করেন।  এর ফলে জমির গুণাগুণ ঠিক থাকে এবং উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। শস্য থেকে বিভিন্ন উপজাত ও প্রক্রিয়াজাত পদার্থ তৈরিও তিনি শুরু করেন।  এ বিষয়ে গবেষণার সূত্রপাতও তিনিই করেন।  কৃষ্ণাঙ্গ চাষিদের ও ছাত্রদের তিনি এইসব বিষয়গুলি শেখান, যাতে তারা স্বনির্ভর হতে পারে।
তিনি ভ্রাম্যমাণ  শ্রেণিকক্ষ চালু করেছিলেন একটি গাড়িতে। এ ব্যাপারে তাঁকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন মরিস কেচাম্ জেসাপ ( Morris Ketchum Jesup), তাই ঐ গাড়ির নাম তিনি দেন 'Jesup Wagon'।

শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে কার্ভারকে উদ্ভিদবিদ্যার খামারে বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজ করতে হত। Tuskegee Institute এর খামারে উৎপাদিত বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার দায়িত্ব ছিল তাঁর।  ১৯১৫ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তিনি মিষ্টি আলু , সয়াবিন, চীনাবাদাম এবং অন্যান্য শস্য নিয়ে গবেষণা করেন।  বারবার একই জমিতে তুলো চাষের ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পেত। জমিতে নাইট্রোজেন পুনর্বার ফিরিয়ে আনার জন্য কার্ভার দুবার তুলো চাষের মধ্যবর্তী সময়ে মিষ্টি আলু বা বাদাম বা সয়াবিন বা মটর চাষ করার জন্য চাষিদের পরামর্শ দেন ও উৎসাহিত করেন।  এর ফলে তুলো চাষে উন্নতি হয় এবং একই সঙ্গে অন্যান্য ফসলও উৎপাদিত হয়, যার থেকে চাষিরা বাড়তি কিছু উপার্জনও করতে সক্ষম হন।  এই ফসলগুলি মাটিতে নাইট্রোজেন আবদ্ধ করতে পারে এবং একই সঙ্গে মানুষের খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত সমাদৃত হয়।  কার্ভার চাষিদের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য আলাবামাতেও একটি কার্যক্রম গ্রহণ করেন।  ধীরে ধীরে অন্যান্য জায়গাতেও এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।  এছাড়া,  তিনি একটি শিল্প- গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন।  এখানে তিনি ও  তাঁর সহকারীরা নতুন উৎপাদিত ফসলগুলির বিভিন্ন রকম ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালাতেন।  ফলে বিভিন্ন রকমের খাদ্যদ্রব্য এবং তাদের বিভিন্ন রকম প্রস্তুতপ্রণালী তাঁরা আবিষ্কার করেন।

১৯১৬ সালে কার্ভার ইংলন্ডের রয়্যাল সোসাইটি অফ আর্টস- এর সদস্য হন।  চীনাবাদাম ও তার থেকে তৈরি দুধ সম্পর্কে বলার জন্য ১৯২০ সালে তিনি " ইউনাইটেড পীনাট অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকা" থেকে আমন্ত্রণ পান এবং সেখানে তাঁরা চীনাবাদাম থেকে তৈরি ১৪৫  রকমের খাদ্যদ্রব্য প্রদর্শন করেন।  এইভাবে কৃষির উন্নতির ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় (Tuskegee University)  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করে।

১৯২৩ থেকে ১৯৩৩  সাল পর্যন্ত কার্ভার এইসব প্রযুক্তি ও পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করেন।  ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি চীনাবাদামের তেল কিভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত  শিশুদের সুস্থ করতে কাজে লাগানো যায় , সে  ব্যাপারে কাজ করেন।  এছাড়া, তিনি উদ্ভিদের রোগ ও ছত্রাকের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। 

১৯৪৩ সালের ৫ জানুয়ারি ৭৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।  তাঁর  সংগ্রামমুখর জীবন, আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই  এবং কৃষিবিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া, এসব আমাদের কাছে এক দৃষ্টান্ত।

                                             
 

 

 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb