মহাকাশে সবচেয়ে বেশী দিন

লেখক - তপন কুমার বিশ্বাস

 

                                           

বাতাসে গোলাবারুদের কটু গন্ধ, মুহুর্মুহু ছুটে চলেছে ক্ষেপণাস্ত্রের ঝাঁক। ধ্বংস মৃত্যু রক্ত, আহতের আর্তনাদ,  একটু নিরাপদ আশ্র‍্য়ের খোঁজে গৃহহারা মানুষ; দুর্লভ দুর্মূল্য খাদ্য চিকিৎসা  ইত্যাদি। সব যুদ্ধের চিত্র একইরকম হয়ে থাকে। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ চলছে।  একদিকে প্রবল পরাক্রান্ত রাশিয়া,  তার বিপরীতে পশিমী দেশগুলির সমর্থনপুষ্ট  প্রতিপক্ষ ইউক্রেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভুক্ত পরাক্রান্ত পশিমী দেশগুলি  রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছে  বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা,  পাল্টা নিষেধাজ্ঞা  জারি করেছে রাশিয়া। এসবের জেরে স্থগিত হয়ে গিয়েছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বৃটেন ফ্রান্স জার্মানি ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সির  একাধিক মহাকাশ প্রকল্প, পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়া থেকে শক্তি সংগ্রহ করবার মত  গুরুত্বপূর্ণ  প্রকল্প ইত্যাদি। এরকম টানটান উত্তেজনার মধ্যে ভরসা যোগাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে একই মহাকাশযানে সওয়ার হয়ে দুজন রুশ ও একজন মার্কিন মহাকাশচারীর নিরাপদে নির্বিঘ্নে রাশিয়ার কাজাখস্তানে  অবতরণ । যুদ্ধ একদিন থেমে যাবে। দেশে দেশে মানুষে মানুষে  পারস্পরিক বোঝপড়া ও সহযোগিতাই, মানবসমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

গত ৩০ মার্চ ২০২২, রাশিয়ার সোয়ুজ এমএস-১৯ মহাকাশযানে সওয়ার হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশচারী মার্ক থমাস ভ্যানডে হেই, ঐ একই মহাকাশযানের অপর দুই মহাকাশচারী,  রাশিয়ার পিওতর ভ্যালেরিয়েভিচ ডুবরভ ও রাশিয়ার আন্তন নিকোলায়েভিচ স্কাপলেরভ-এর সঙ্গে, পৃথিবী প্রদক্ষিণরত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে নিরাপদে রাশিয়ার  কাজাখস্তানে অবতরণ করেছেন।  কিছু রুটিন শারীরিক পরীক্ষা ইত্যাদির পর, ভ্যানডে হেই বিমানে চেপে ফিরে গিয়েছেন নিজের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে অবস্থিত মহাকাশকেন্দ্রে। একইভাবে পিওতর ডুবরভ ও আন্তন স্কাপলেরভ ফিরে গিয়েছেন মস্কোর কাছে অবস্থিত রুশ  মহাকাশচারীদের জন্য নির্দিষ্ট স্টার সিটিতে।

ভ্যানডে হেই এক বছরের কিছু কম সময়, ৯ এপ্রিল ২০২১ থেকে ৩০ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত,  একটানা ৩৫৫ দিন মহাকাশ স্টেশনে কাটিয়েছেন। তাঁর রুশ সঙ্গী  ডুবরভ মহাকাশ স্টেশনে কাটিয়েছেন ঐ একই সময় অর্থাৎ  ৩৫৫ দিন। প্রায় একবছর আগে দুজনে একসঙ্গে একইদিনে মহাকাশস্টেশনে গিয়েছিলেন। ৩৫৫ দিনে তাঁরা প্রায় ৫৬৮০ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছেন, অতিক্রম করেছেন ২৪ কোটি কিলোমিটারের বেশী শূন্যপথ।  তুলনায় স্কাপলেরভ কাটিয়েছেন বেশ কিছুটা কম সময়, ১৭৫ দিন। এর মধ্যে একটা সময় তাঁরা    কাটিয়েছেন  অল্পদিনের জন্য মহাকাশস্টেশনে  আগত দুজন জাপানি পর্যটক এবং  মহাকাশস্টেশনের ভিতরে সিনেমার শ্যুটিংয়ের জন্য আগত একজন অভিনেত্রী ও একজন চিত্রপরিচালকের সঙ্গে। সিনেমার নাম ' দ্য চ্যালেঞ্জ  '। এটিই হতে চলেছে খোদ মহাকাশে অংশবিশেষ শ্যুটিং হওয়া প্রথম সিনেমা, দাবী করেছেন রুশ মহাকাশ সংস্থা  ' রসকসমস '। একসময়ে তাঁরা আরো ২২ জনের সঙ্গে একসাথে মহাকাশস্টেশনে কাটিয়েছেন অর্থাৎ একসঙ্গে ২৫ জন।

৩৫৫ দিন মহাকাশে কাটিয়ে ভ্যানডে হেই এখন নাসার মহাকাশচারীদের মধ্যে একটানা সর্বোচ্চ সময়  মহাকাশে বসবাস করবার রেকর্ডের অধিকারী।  তিনি ভেঙে দিয়েছেন ২০১৬ সালের মার্চে নাসার মহাকাশচারী স্কট কেলির একটানা ৩৪০ দিন আন্তর্জাতিক মহাকাশস্টেশনে বসবাস করবার রেকর্ড। তবে ভ্যানডে হেই বা স্কট কেলির   চাইতে  মহাকাশে একটানা এর বেশী সময়  কাটানোর রেকর্ড রয়েছে তিনজন রুশ মহাকাশচারীর। পৃথিবীর সমস্ত মহাকাশচারীদের মধ্যে মহাকাশে একটানা সর্বোচ্চ সময় কাটানোর রেকর্ডধারী হলেন রুশ মহাকাশচারী ভ্যালেরি ভলাদিমিরোভিচ পলিয়াকভ। ৮ জানুয়ারী ১৯৯৪ থেকে ২২ মার্চ ১৯৯৫ পর্যন্ত রাশিয়ার তৎকালীন মির মহাকাশস্টেশনে   একনাগাড়ে ৪৩৭ দিন ১৭ ঘন্টা ৫৮ মিনিট অর্থাৎ ১৪ মাসের বেশী সময় কাটিয়েছেন পলিয়াকভ। সাধারণত অবতরণের পর ক্যাপসুল থেকে বার করে মহাকাশচারীকে বহন করে নিয়ে গিয়ে বসানো হয়। ফিরবার পর অনেকেই শারীরিক নানা অসুবিধা বোধ করে থাকেন। অবতরণের পর পলিয়াকভ এভাবে তাঁকে বহন করে নিয়ে যেতে নিষেধ করেন। পরিবর্তে কোনো সাহায্য ছাড়াই তিনি নিজেই হেঁটে গিয়ে বসেন কাছাকাছি রাখা গার্ডেন চেয়ারে। তারপর সেখান থেকে পায়ে হেঁটে পরিবহন যানে উঠে পড়ে কাজাখস্তানের বৈকনুর কসমোড্রোমে পৌঁছান। এভাবে প্রমান করেন যে দীর্ঘ মহাকাশযাত্রা শেষে তিনি বেশ সুস্থই রয়েছেন। চিকিৎসক– মহাকাশচারী  হিসাবে পলিয়াকভ মানবদেহের উপর মাইক্রোগ্রাভিটির প্রভাব সম্পর্কে বিশদে আলোকপাত  করেছেন। ১৯৮৭ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৮ সালের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মির মহাকাশস্টেশনে একটানা ৩৬৫ দিন ২২ ঘন্টা ৩৮ মিনিট কাটিয়েছেন দুই রুশ মহাকাশচারী মুসা খিরাম্যানোভিচ ম্যানোরভ ও ভলাদিমির গিয়র্গিয়েভিচ টিটভ। বস্তুতপক্ষে ম্যানোরভ এবং টিটভ প্রথম একবছরও বেশী সময় ধরে মহাকাশে বসবাস করে এসেছেন। এইসব অভিযান থেকে বোঝা গিয়েছে,  মানবদেহ দীর্ঘকালীন মেয়াদে মহাকাশে বসবাস করবার উপযুক্ত। মঙ্গলগ্রহে অবতরণ করা বা চাঁদে উপনিবেশ গড়ে কিছুকাল বসবাস করবার উপযুক্ত।  আরো পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে।

বেশ মজার গল্প শুনিয়েছেন ভ্যানডে হেই। তিনি মজা করে বলেছেন, বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেলাম তাজা সবুজ কাঁচালঙ্কা ও পাকা লাল লঙ্কা, সরষে দিয়ে রান্না করা তাজা পালংশাক এবং মুলো। তিনি একা নন, সঙ্গে আরো কয়েকজন মহাকাশচারী। রান্না করেছেন মহাকাশস্টেশনে অবস্থানরত একজন মহিলা মহাকাশচারী। লঙ্কাগুলি স্টেশনের বাগান থেকে তুলেছেন ভ্যানডে হেই। অন্যান্য সব্জী ফলিয়েছেন বা তুলেছেন অন্য মহাকাশচারীরা। এপর্যন্ত মনে হতে পারে, এ আর তেমন কি ব্যাপার!কিন্তু মহাকাশস্টেশনে মাইক্রোগ্রাভিটিতে কাজটি সুকঠিন। সেখানে পৃথিবীর মত জমির মাটিতে চাষবাস করা যায়না।  চাষ করা হয় এক ভিন্ন পদ্ধতিতে।  প্রজাপতি,  পাখী বা মৌমাছি নেই, বহমান বাতাসও নেই। তাই মহাকাশস্টেশনে ফুলের পরামিলন ঘটানো হয় একেবারে হাতে করে। একটি সরু দন্ডে পরাগ লাগিয়ে তারপর সেটিকে ছুঁইয়ে দেওয়া হয় ফুলের গর্ভমুন্ডে। পরাগনিষেক ঠিকমতো হলে ফল ধরে। শুধু সব্জী নয়, মহাকাশে তাঁরা ফুটিয়েছেন জিনিয়া ফুল। এরকম অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। দীর্ঘ মহাকাশযাত্রায় পৃথিবী থেকে সমস্ত খাবারদাবার নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়; মহাকাশচারীদের  নিজেদেরকেই উৎপাদন করে নিতে হবে শাকসব্জী ইত্যাদি । তাছাড়া এইসব কাজের মধ্য দিয়ে মাহাকাশে কাটানোর একঘেয়েমিও দূর হবে।

মহাকাশস্টেশনের ভিতরে তোলা এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ভ্যানডে হেই ভাসমান তরলের দুটি অংশকে সামলাচ্ছেন। মহাকাশস্টেশনের প্রায় শূন্য অভিকর্ষে (মাইক্রো গ্রাভিটি)  তরল মেঝেতে পড়ে যায় না, ভাসমান থেকে টলমল করে পদ্মপাতায় জলের মত। দেখা যাচ্ছে, একটি ফাঁপা সরু নল দিয়ে ভাসমান তরলের  দুটি অংশকে একজায়গায় আনবার চেষ্টা করছেন ভ্যানডে হেই। দুটিরই পৃষ্ঠতল এবড়োখেবড়ো। অনেক চেষ্টার পর তিনি দুটিকে একসঙ্গে লাগাতে সক্ষম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, দুটি মিলে গিয়ে একটিমাত্র তরলখন্ডে পরিণত হয়ে গেল। নতুনটির পৃষ্ঠতল অসমান। নলটি দিয়ে এটির ভিতর ফুঁ দেবার পর আকৃতি যেমন বড়ো হয়ে গেল (সেটাই স্বাভাবিক), তেমনি সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিণত হল এক নিখুঁত গোলকে,  পৃষ্টতল সম্পূর্ণ মসৃণ – যেন সাবানের ভাসমান ফেনা। ফুঁ দেওয়া বন্ধ করলে আবার সেই অসমান পৃষ্ঠতলের তরলখন্ড। কৌশিক বলের জন্য এমনটা হয়েছে বলে মনে হয়।

মহাকাশস্টেশনে নানা ধরণের দৈনন্দিন কাজ করে থাকেন মহাকাশচারীরা। এর মধ্যে রয়েছে মহাকাশযানের রুটিন পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিভিন্ন পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, পৃথিবী ও মহাকাশ পর্যবেক্ষণ, নানাধরণের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা সম্পাদন করা ইত্যাদি।   খাওয়াদাওয়া, ঘুম  ও শরীর চর্চা করে শরীর ফিট রেখে দেওয়া। নিজেদের দেহের উপর, বিভিন্ন ছোটো প্রাণী ব্যক্টেরিয়া ও গাছপালার উপর নিম্ন অভিকর্ষের প্রভাব লক্ষ করা, শাকসবজি ফল বা ফুলচাষ করা ইত্যাদি। পৃথিবীতে বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শরীরের মাংসপেশী, হাড় এসবের ক্ষয় ঘটে, জোর কমে আসে; কিন্তু মহাকাশে তা হয় দ্রুততর হারে। পেশীর কালচারের উপর মহাকাশে পরীক্ষা  চালিয়ে বিষয়টি বুঝবার চেষ্টা চলছে।  দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা উপর চলছে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা। বিভিন্ন কেলাস প্রস্তুতি, গঠন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা,  মাইক্রোগ্রাভিটিতিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন  ইত্যাদির নিয়ে চলছে পরীক্ষানিরীক্ষা।

                                                 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb