পূর্বরাগ, অনুরাগ, অস্তরাগ

লেখক - -ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

                                           

সবাই কলকল করে উঠেছে। কে যেন বলছিল, সুন্দরবনে বাঘ দেখা আর টাইগার হিলে সানরাইজ দেখা একই ব্যাপার। আর একজন বলছিল, তিন বছর ধরে আসছি। প্রতিবার ভাবছি আকাশ এমন পরিষ্কার। সানরাইজ দেখা আমাদের কে আটকায়।

তা আটকায় ভাগ্য। একটা করে হতচ্ছাড়া মেঘ যে কোথা থেকে বেয়াড়া ছেলের মত লাফাতে লাফাতে চলে আসে রবিদাদুর রাস্তায় কে জানে। আর তক্ষুনি তার দুষ্টুমির ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায় সে রাস্তাটা। রবিদাদু পার হয় সেটা ঠিক তবে তখন সে বেশ বড় হয়ে যায়। তার সারা গায়ে কচি রোদমাখা শরীরটা দেখা যায় না।

বাবা, মা আর ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের পূর্বদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে মনে শোভনা শুধুই বলছে, এবারে যেন সানরাইজটা ঠিক দেখতে পাই হে ভাগবান।

ভোরের অন্ধকারটা এখন কমে গেছে আর সঙ্গে সঙ্গে সবাই দেখেছে এক অপূর্ব দৃশ্য। সারা আকাশ জুড়ে লালের শোভা। যেন এইমাত্র লাল আবিরের বস্তার মুখ খুলে ঢেলে দিল ঢেলে দিল মেঘের ওপর। আর অমনি সেই সাদা মেঘগুলো সে লালিমা বয়ে বেড়াতে লাগল লজ্জারাঙা নববধূর মত।

সূর্যটা উঠল। সবাই হৈ হৈ করে উঠেছে। এবার আর কোনও বাধা নেই। একেবারে টকটকে লাল সূর্য। শোভনা চেঁচিয়ে উঠল, দেখ ভাই কি সুন্দর লাল সূর্য।

পাশে দাঁড়ান ভাই বলল, আর কত বড় দেখ দিদি।

শোভনা হাঁ করে দেখতে দেখতে ভাবছিল সূর্যটা সত্যি কত বড় লাগছে। সে অবশ্য মাত্র কিছু অল্প সময়। এরপর লজ্জারাঙা সূর্যটা যেন তার গা থেকে লাল আবির ঝেড়ে ফেলতে লাগল। রঙ পালটে ঈষৎ হলুদ হয়ে গেল। আর আকারেও ছোট হয়ে গেল।

অমনি সব ওঠার তাড়া পড়ে গেল। সূর্যোদয় দেখে মন ভরেছে। এখন আর সূর্যের দিকে তাকানো যাবে না। এবার ফেরার পালা। ব্রেকফাস্ট করে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হবে সাইট থেকে সাইটে।

সূর্যের দিক থেকে যেন চোখ সরাতে পারছে না শোভনা। ওদিকে সূর্যের চোখও আর সরে না। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে সানরাইজ দেখেছ তবে তাকে মিথ্যে করেই বলতে হবে সে দেখেছে। কিন্তু সত্যি সত্যি দেখবে কি করে? সারাক্ষণ তো তার চোখ ছিল শোভনার মুখের দিকে। অমন ঢলঢলে ফর্সা মুখে যখনি পড়ল পূর্বরাগের ছোঁয়া অমনি আকাশ থেকে সূর্যের মুখ ঘুরল যে তার দিকে।

-দিদি যায়। ভাইয়ের ডাকেও সম্বিত ফেরে নি শোভনার। তার দৃষ্টি আকাশ থেকে নেমে এসে পড়েছে সূর্যের দিকে। ঐ লালিমা মাখা বলিষ্ট মুখখানা তো দারুন। বেশ মোটা গোঁফ আর চাঁপদাড়ি আর বাদামি রঙের জ্যাকেটে এক অন্য রঙের প্রতিফলন টের পেল সে। সে ফিরল বটে তবে গতি স্লথ হল। ক্রমে দূরত্ব বাড়তে লাগল বাবা, মা আর ভাইয়ের সঙ্গে।

-হাই। আপনি কি একা নাকি?

-না মানে ইয়ে-

দূরে তাকিয়ে শোভনা বলল, মানে আমাদের সব অনেক এগিয়ে গেছে।

বলে সে চলে যেতে উদ্যত হল। সূর্য বলল, আপনার বাবা মা নিশ্চয় বাচ্চা নয় যে রাস্তা হারিয়ে ফেলবে আর আপনাকে খুঁজতে যেতে হবে?

-না মানে-

-এত মানে বই ঘাঁটলে টেক্সট বই কখন পড়বেন?

এ এক অন্য সূর্যরশ্মি যা সর্বদাই লাল থাকে।

উত্তরের বদলে খিল খিল করে হেসে ওঠে শোভনা, আপনি দারুন কথা বলেন তো-  

-সূর্য- আমি সূর্য বোস।

এবার জোরে হেসে ফেলল শোভনা, কি কান্ড দেখুন। আপনি সূর্য আর আমরা কিনা-

-আমাকেই দেখুন না। ক্ষতি কি? সূর্যের মুখে এবার মিষ্টি হাসি, আমি কিন্তু যা দেখার তা দেখে নিয়েছি।

-কি?

-আজকের সানরাইজ। তবে আকাশে নয়। একজনের মুখে।

খুব অবাক হল শোভনা। একটা রোমাঞ্চ জাগল শরীরে। বলল, সে মুখ কি খুব দূরে ছিল?

-না ছিল খুব কাছে। যেন কত কাছে- আবগের একটা স্ফূরণ সূর্যের মুখে।

-আপনি তাহলে-

বাধা দিল সূর্য। বলল, অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকায়ে যায়। আমি একা এসেছি। বেড়াতে বেরিয়ে আমি আকাশ দেখি। পাখি দেখি, সাগরের ঢেউ দেখি। আর মিলিয়ে নিই আমার জানা সত্যের সঙ্গে। এসব আমার বন্ধুদের তেমন হজম হয় না।

শোভনার মনে হল ছেলেটা নিশ্চয় একটা কবি। এখুনি কবিতা নিয়ে কচকচ করবে। সে তার গতি বাড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গতি বাড়াল সূর্যও।

-রাগ করলেন বুঝি?

শোভনা উত্তর দেওয়ার আগেই তার মোবাইল বাজল।

-হ্যালো মা। আমি এখানেই আছি। একটু ঘুরছি।

-একা একা ঘুরছিস কি? আমরা এদিকে সবাই দাঁড়িয়ে আছি।

-একা নয় মা। সূর্যও আছে-

বলেই মনে মনে জিভ কেড়ে সূর্যের দিকে তাকাল শোভনা।

-সূর্যের সঙ্গে কি রে? সূর্য তো এখন আকাশে। আর এখন রোদের তেজটা দেখেছিস। খবরদার এখন সূর্যের দিকে তাকাবি না তুই-

সূর্যের দিকে তাকাল শোভনা। সূর্য মিটি মিটি হাসছে।

-না না মা। বেশ ভাল লাগছে মা। মানে – সূর্যের দিকে তাকাতে আর কি-

ওরা ফোন কেটে দিয়েছে। সূর্য হাসিটা বজায় রেখে বলল, আর ওনাদের চিন্তায় রেখে লাভ কি-

-শোভনা। আমার নাম শোভনা সেন। বি-এ পড়ি। আমি কবিতা ভালবাসি তবে কবিদের নয়।

-তবে তো মুশকিল হল। আমি তো আবার উল্টো। আমি আকাশের কথা লিখি, সাগরের কথা বলি- আমাকে যদি পাশে পাশে একটু যাবার অনুমতি দেওয়া যায় তো-

‘পাশাপাশি’ কথাটা শুনে চমকে উঠল শোভনা। কিন্তু কি আর করা যাবে। হঠাৎ দেখা হলেও তো বেশি অভদ্রতা করা যায় না।

-আমি সূর্য বোস। বলতে পারেন ডকটর সূর্য বোস। সিদ্ধানন্দ কলেজের ফিজিক্সের লেকচারার।

শোভনার বাবার সঙ্গে করমর্দন করে সূর্য বলল। বাবা, মা, ভাই বেশ খুশি। শোভনার মুখ ভার।

-তুই আবার মুখ অমন গোমড়া করলি কেন? শোভনাকে বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

-শুনলে না বাবা উনি পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। আর আমি নেহাত অপদার্থ কলা বিভাগের বি-এ থার্ড ইয়ার।

-বিজ্ঞানে আর কলায় তো কোনও ঝগড়া নেই ম্যাডাম। বলুন না কাব্য, সাহিত্য নাটক লিখতে কলাবিদ্যার সঙ্গে কলম তো লাগে একটা আর সেটা বিজ্ঞানের দান। চিত্রকলায় লাগে তুলি আর রঙ। সেগুলোও তো-

বাধা দিয়ে বাবা বলে উঠলেন, সূর্য তো ঠিক বলেছে। বিজ্ঞান সব বিভাগকেই সাহায্য করে। আর বিজ্ঞান ছাড়া যে কেউ একা চলতে পারে না মা। বিজ্ঞান এসেছে বলেই তো এসেছে সভ্যতাও।

আবার হাঁটা। সূর্যের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শোভনার গতি যথারীতি স্লথ হয়ে আসা।

-কেমন লাগল আজকের সূর্যোদয়? পরপর তিনবার ব্যর্থ হয়ে আজ প্রথম সফল হলাম।

শোভনার প্রশ্নে প্রথমে একটু থমকে গেলেও অস্ফুটে যেন নিজের মনে সূর্য বলল, মিষ্টি। ভারি মিষ্টি।

-কি মিষ্টি মিষ্টি করছেন? আপনি তো দেখেন নি। সারাক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন- আমি আড়চোখে কিন্তু সব দেখেছি।

-যা দেখেছি তা মিষ্টি। সূর্যোদয় আজ না দেখলেও আগামী বার দেখে নেওয়া যাবে। কিন্তু সেটা না দেখলে সে আক্ষেপের সীমা পরিসীমা থাকত না।

-কিন্তু আমার একটা আক্ষেপ রয়ে গেল।

ভ্রূ কুঁচকে গেল সূর্যের।

-আচ্ছা বলুন তো সূর্য ওঠার আগে সারা পূর্ব আকাশ অমন লাল আবির ছড়ান হল কেন? জানিনা প্রকৃতিবিদেরা কি বলেন-

-কেন পদার্থবিদের ওপর কি এততুকু ভরসা নেই যে প্রকৃতিবিদকে ডাকতে হবে?

-আরে না না তা কেন। আমি তো সেইজন্যেই বললুম।

-আসলে রঙ বলে আলাদা কিছু নেই। আলাদা আলাদা কম্পাংকের আলোক রশ্নি। এই যে সূর্যের সাদা আলো তা আসলে সাতটা আলাদা আলাদা কম্পাংকের আলোক রশ্মি। যখন একসঙ্গে থাকে তাকে সাদা দেখায়। কিন্তু প্রিজম বা অন্য কিছুর ওপর পড়লে এই সাদা আলো সাতটা আলোতে ভেঙ্গে যায়। আলোর এই ধর্মকে বলে আলোকের বিচ্ছুরণ বা dispersion of light.

শোভনার হঠাৎ মনে এল একটা কথা। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে উঠল, আরে জলের ওপর তেল পড়লেও তো-

-হ্যাঁ জলে তেল পড়লে যে অপদ্রব বা ইমালসন তৈরি হয় তা এমন একটা মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় যে আলোকের বিচ্ছুরণ হওয়ার পক্ষে যোগ্য। তাই সেখানেও সাতটা রঙ দেখা যায়। এবার আসি আকাশের কথায়। আকাশের নীল নিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যতই উন্মাদনা আর উচ্ছ্বাস থাক না কেন সেটা মোটেই নীল নয়।

শোভনা অবাক হয়ে বলল, নীল অথচ নীল নয়? দারুন ইন্টারেস্টিং।

-না বেবাক সাদা। সূর্য থেকে আসা আলোতে যেমন দেখায়। এখন প্রশ্ন হল নীল দেখায় কেন? কারণ আকাশে প্রচুর ধূলিকণা থাকে। এই ধূলিকণার ওপর আলো পড়ে আলোকের বিক্ষেপণ হয়। এটি আলোকের অন্য এক ধর্ম আর এই বিক্ষেপণে সাদা আলো বিভিন্ন রঙ্গে ভাগ হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যায়। প্রতিটি রঙের জন্যে এক একটি নির্দিষ্ট দর্শন কোণ বা angle of view আছে। আমাদের মাটি থেকে আকাশ যে দূরত্বে তাতে এখান থেকে নীল আলোটাই শুধু দেখা যায়। আর তাই আমরা নীল দেখি। এটা আমাদের ভারতীয় বিজ্ঞানী ডাঃ সি-ভি-রমণের আবিষ্কার scattering of light. আর এ জন্যেই ১৯৩০ সালে তিনি পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।

-তার মানে ধূলিকণা না থাকলে-

-সাদা রঙ থাকবে। তবে ধূলিকণা নেই এমন জায়গা তো নেই কোথাও।  

শোভনা চমৎকৃত হয়ে বলল, এই দেখুন আপনার সঙ্গে দেখা না হলে আমার তো এটাও জানা হত না।

-আরও একটা জিনিস জানা হত না ম্যাডাম। জানতে চাইছিলেন না পূর্বরাগের রহস্য?

খুব লজ্জা পেয়ে শোভনা বলল, যাঃ কি যে বলেন।

-আহা পূর্বরাগ মানে অনুরাগের আগের রাগ নয়। এটা হল ভোরে পূর্ব দিকে সূর্য ওঠার আগে আকাশে যে আবিরের ছোঁয়া পড়ে তাই হল পূর্বরাগ।

-আরে আরে বলুন বলুন। খুব উৎসাহিত শোভনা।

-সেই একই বিষয়। মানে আকাশে উপস্থিত অসংখ্য্য ধূলিকণায় সূর্যের আলোর বিক্ষেপণ। তবে এখন সূর্য থাকে দিকচক্রবাল বা হরাইজনের নিচে। তাই পরিবর্তিত বিক্ষেপণ কোণের জন্যে সূর্যের লাল আলোটা কেবল এসে পড়ে। কিন্তু সূর্যটা উঠে আকাশে অনেক দূর চলে এলে এই বিক্ষেপণ কোণ বদলে যায় আর তাই জন্যে কোনও বিক্ষেপণ হয় না।

সূর্যের মুখের দিকে অপলকে চেয়ে হাঁ করে সব শুনছিল শোভনা। বলল, সামান্য ধূলিকণার এত ক্ষমতা স্যার যে সূর্যের আলোকেও রঙ বদলে দিতে পারে মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে।

হাসল সূর্য, ক্ষমতাটা আপেক্ষিক ম্যাডাম। সামান্য একটা তেঁতুলের বীজও আপনার মাথা ভেঙ্গে চৌচির করে দিতে পারে যদি তা তেমন প্রচুর উচ্চতা থেকে পড়ে। ছোট বলে কাউকে উপেক্ষা করবেন না। এটা হয় স্থিতিশক্তি আর গতিশক্তির খেলায়। তবে-

-তবে?

-তবে এই খেলা প্রকৃতির খেলা। মানুষ শুধু রহস্যটা ভেদ করেছে মাত্র। নীরবে ঘাড় নাড়ে শোভনা। সূর্য বলল, প্রকৃতির এই খেলাটা তবে শেষ করি? মানে এই প্রকৃতির পূর্বরাগ পর্বটা?

আবেগে বশীভূত হয়ে শোভনা বলল, বলুন।

-একটা দারুন মজার কথা শুনুন। সকালে সূর্য ওঠার আগেই কিন্তু আমরা সূর্যকে দেখতে পাই আকাশে। মানে সূর্য তখন দিগন্ত রেখার নিচে থাকে।

শোভনা বলল, আমি যদিও সায়েন্সের স্টুডেন্ট নয় তবু কাব্য চর্চার দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে পারি-

-আপনি একেবারে ঠিক ম্যাডাম। দিকচক্রবালের নিচে থাকলে তাকে পৃথিবী থেকে দেখার কথাই নয়। কিন্তু প্রকৃতি একটা খেলা খেলে। এখানেও কিন্তু এই খেলাটা খেলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল। ভূপৃষ্ঠের ঠিক ওপর থেকে বাতাসের কতগুলো স্তর ভাবা যেতে পারে। সূর্য থেকে  আলো আসে বিকিরণ প্রথায়। মানে এটা বায়ুর মধ্যে দিয়ে এলেও বায়ুকে উত্তপ্ত করে না। সোজা চলে এসে পড়ে মাটিতে। মাটি গরম হয়। তারপর গরম হয় মাটির ঠিক সঙ্গে লেগে থাকা বায়ুর স্তর। তারপর পরিচলন পদ্ধতিতে এই তাপ ক্রমে বাতাসের উঁচু স্তরগুলোয় পৌঁছোয়। ভোরে রোদ না থাকায় ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি স্তর ঘন থাকে কিন্তু যত ওপর দিকে যায় তত লঘু বা হালকা হতে থাকে।

ভোরে সূর্যের আলোক রশ্মির গতিপথ আলোকের প্রতিসরণ নিয়মে পরিচালিত হয়। ঘন মাধ্যম থেকে লঘু মাধ্যমে যাওয়ার সময় দ্বিতীয় স্তরে প্রতিসরণ কোণ আপতন কোণের থেকে বেশি হয় আর এই কারণে সূর্যরস্মি ওপর থেকে বেঁকে গিয়ে নিচে মাটির দিকে আসতে থাকে। আমাদের চোখে প্রতিবিম্ব দেখা যাবে কিন্তু সর্বশেষ রশ্মিকে পেছন দিকে বাড়িয়ে দিলে সেই অবস্থানে। তাই ঊষালগ্নে সূর্যের আসল অবস্থান যেখানে দিকচক্রবালের নিচে তখন তার আপাত অবস্থান কিন্তু আকাশের ওপরে তাই ভোরের আগেই ভোর হয়ে যায় অর্থাৎ সূর্যকে দেখা যায় আকাশে। ঠিক একই কারণে ওপর থেকে নিচের দিকের ব্যাসার্ধটি বেড়ে যাওয়ায় গোল সূর্যকে ডিমের মত অর্থাৎ উপবৃত্তাকারে দেখায়। বুঝতে সুবিধে হবে আপনি যদি চট করে একটা কাগজ পেন নিয়ে আসেন।

শোভনা কাগজ পেন আনতেই সে সুন্দর করে এঁকে দিতেই লাফিয়ে উঠে শোভনা বলল, দারুন। একেবারে জলের মত সহজ লাগছে এবার।

সূর্য বলল, তার মানে ভোরের আগে সূর্যকে যেমন দেখা যায় তেমনি তাকে বড় করে দেখা যায় এটা আলোকের প্রতিসরণ নিয়মে। কিন্তু লাল রঙ আসার কারণ বাতাসে ধূলিকণার উপস্থিতিতে বিক্ষেপনের ফল। এক্ষেত্রে লাল রঙের জন্যে নির্দিষ্ট বিক্ষেপন কোনটি থাকায় সূর্যকে লাল দেখায়।

সূর্যকে খুব ভাল লেগে গেছে শোভনার তো বটেই আবার তার বাবা মায়েরও। যেমন মোলায়েম ব্যবহার তেমনি মোলায়েম তার বোঝানোর পদ্ধতি। অতএব বাড়িতে ফিরেও নিয়মিত শোভনার বাড়িতে সূর্যের আনাগোনা।

অনুরাগে বাঁধা পড়ার পর বিয়েও হয়ে গেছে দুজনের। আর এরপর যা হয় মানে মধুচন্দ্রিমা। সেটা সারা হল আন্দামানে। সারা দিনের ভ্রমণ শেষে তারা গেল ওয়ানডুর বিচে। এখানে সূর্যাস্ত দেখা যায় সুন্দর করে।

দুজনে দুচোখ ভরে সূর্যটাকে ডুবে যেতে দেখল। আবির মেখে আকাশের মেঘগুলোকে আনন্দে ছোটাছুটি করতে দেখল। শোভনা বলল, বুঝেছি।

-কি বুঝেছ?

-এই অস্তরাগের মহিমা আর তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।

-উল্টো বুঝলি রাম।

শোভনা চটে উঠে বলল, মানে?

সুর্য হেসে বলল, মানে খুব সোজা। এই অস্তরাগ হল পূর্বরাগের ঠিক বিপরীত। ঠিক যেন ফোটো এডিটিং-এর ভাষায় ফ্লিপ করে দেওয়া। ফ্লিপ হরাইজন্টাল। পূর্বরাগকে আকাশে উল্টে ফেললেই অস্তরাগ। প্রতিসরণের ব্যাপারটা ঠিক উল্টো ঘটবে। প্রতিসরণের মায়ায় সূর্য অস্ত যাওয়ার পরেও তার ছায়া থেকে যাবে আকাশে আর দৃশ্যমান হতে থাকবে আমাদের চোখে। তাই সন্ধ্যের অনেক পরে সন্ধ্যে হবে। সূর্য বড় আর লাল হবে।

শোভনা বলল, এ সব তো আকাশে ধূলিকণার মায়া তাই নয়?

-একেবারে ঠিক ম্যাডাম। আলোর বিক্ষেপন ধর্ম।

দুষ্টুমিষ্টি হাসল শোভনা, তবে অস্তরাগের পরে বিচ অন্ধকার হলে যা করা উচিত তা করতে যেয়ো না যেন। এটা কিন্তু ‘আট থেকে আশি’র পড়ার বই। মনে রেখ।

নিচু হয়ে বাও করে সূর্য বলল, ওকে ইওর এক্সেলেন্সি।

                                           

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb