টুটুলের মহাকাশ ভ্রমণের টিকিট

লেখক - ডঃ দীপঙ্কর বসু

                                        

টুটুল বাবুর বয়ানে তার ঠামার সঙ্গে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরির কাহিনী শোনার আগে শুনে নেওয়া যাক টুটুল বাবুর সম্বন্ধে দু চার কথা। টুটুল ‘বাবু, শুনে ভাববেন না যেন , টুটুল একজন বড়সড় কোন মানুষ। পঞ্চম শ্রেণীর পড়ুয়া এগারো বছরের দিগন্ত ঘোষের ডাকনাম টুটুল। ঠাকুরমা যাঁকে টুটুল ডাকতো ঠামা বলে, তিনি আদর করে টুটুলকে টুটুল বাবু বলে ডাকতেন। টুটুলের ভারি ভাব ছিল ঠামার সঙ্গে। ঠামা আত্রেয়ী ঘোষ ছিলেন একটি সরকারি কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক। দশ বছর আগে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আত্রেয়ী দেবীর সারাদিনের অনেকটা সময় কাটতো নাতির সঙ্গে। সকাল দশটার আগেই অফিসে বেরিয়ে যেতেন ছেলে ও বৌমা। তারপর বারোটার সময় সকালের স্কুলের শেষে টুটুল বাড়ি ফেরার পর টুটুলের বেশী সময়ই কাটতো ঠামার সঙ্গে। ভালো ভালো খাবার ছাড়াও অঙ্ক শেখাতেন নানা রকমের খেলার মাধ্যমে মজা করতে করতে। এছাড়াও গল্প বলতেন হরেকরকমের। বিজ্ঞানের অবাক করা গল্প থেকে রামায়ণ মহাভারতের কথা। আর বলতো নিজের স্কুল আর ছোটবেলার নানা মজার গল্প। তবে টুটুলের সবচেয়ে ভালো লাগতো কল্পনার জগতে নিয়ে যাওয়ার অপূর্ব সব রূপকথার গল্প। টুটুল যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ত, তখন ঠামাকে ছাত্রী করে বসিয়ে স্যার হয়ে স্কেল হাতে পড়িয়েছে।  নাতি নাতনিদের মধ্যে ঠামার সবচেয়ে প্রিয় ছিল টুটুলই। কাকা পিসিরা বলতো, “ মা টুটুলের যত গল্প করে, অন্য নাতি নাতনিদেরতো বটেই, আমাদের কথাই কখনও তেমন ভাবে কাউকে বলতে শুনি নি। এমনকি পড়াশোনায় অত ভালো দাদার কথাও না।” ঠামার অবশ্য এ নিয়ে কোন সংকোচ ছিল না।

 টুটুলের সবচেয়ে প্রিয় বেস্ট ফ্রেন্ড সেই ঠামা একদিন হঠাৎ চলে গেলেন অমৃতলোকে। জগৎটা আচমকাই শূন্য হয়ে গেল টুটুলের। রোজদিন স্কুল থেকে ফিরে আসার পর খুব খালি লাগতো। আদর করে খাইয়ে দেবার কেউ নেই, ঘুমের আগে চুলে আর হাতে পায়ে সুড়সুড়ি দেওয়ার কেউ নেই, হরেকরকম মজার আর রূপকথার গল্প বলার কেউ নেই, মজা করতে করতে অংক আর বিজ্ঞান শেখানোরও কেউ নেই। দাদু, মা, বাবা আর বাড়ির অন্যরা চেষ্টা করে, কিন্তু ঠামার ব্যাপারটাই ছিল আলাদা। সব কিছুর মধ্যেই ছিল এক অদ্ভুত ভালবাসার পরশ। যদিও টুটুল একেবারে ছোট্ট টি নেই, কিন্তু বাবা তবু প্রায়ই ভোলাবার জন্য বলতো ঠামা অনেক দূরে আকাশে চলে গেছে। টুটুল কথাটা বিশ্বাস না করলেও সেই থেকে মাঝে মাঝে আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে টুটুল ভাবতো যদি সত্যিই এমনটা হত, তাহলে আকাশের কোথায় থাকতো ঠামা। বাড়িতে রান্না করে যে মালতী মাসি সে এবং আরও কেউ কেউ বলে, “ একা একা বাইরে আকাশ দেখতে যেও না টুটুল, ঠামা মরে গেছে তো ভয় পাবে।”  টুটুল বুঝে পায় না তার সবচেয়ে প্রিয় ঠামা খামোকা কেন তাকে ভয় দেখাবে! টুটুল ভয় পায় না কিছুতেই, কেননা টুটুল জানে ঠামা তার পাশে পাশেই আছে।

টুটুল বাবুর বয়ান -  

আজই ঘটলো সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা। বিকেলে কমপ্লেক্সের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলার পরে মাঠের পাশের চেয়ারে বসে ক্লান্তিতে গা টা একটু এলাতেই মনে হল পাশে কে যেন এসে বসলো। তারপর জিজ্ঞাসা করলো, “ কি টুটুল বাবু ক্লান্ত লাগছে?”
“আরে, এ তো ঠামা।”
“ ঠামা, বাবা বলল তুমি না কি আকাশে তারার দেশে চলে গেছো? আমাকেও নিয়ে চলো না সেখানে। ”
“ যাবে তুমি সেখানে? আমি ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু টিকিট পাবো কোথায়?” ঠামা বলল, “আমি হলাম তোমার টিকিট।” এই বলে ঠামা দুবার হাততালি দিলো। সঙ্গে সঙ্গে হাজির পক্ষীরাজ ঘোড়ার আদলে তৈরি এক ছোট্ট মহাকাশযান। ঠামা আবার তিনবার হাতাতালি দিতেই কোথা থেকে ঠামার হাতে এসে গেল স্পেস স্যুট। আমাকে স্পেস স্যুট পরিয়ে ঠা মা  নিজেও পরে নিলেন তা। তারপর আমরা মহাকাশযানে উঠতেই ঠা মা গুনে গুনে ছবার হাততালি দিতেই হুস করে যান উঠে গেলো আকাশে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ ঠামা, আমরা কি এখন রাজকুমারের মত সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে অচিন দেশে যাবো?”
“ না বাবু, সে সময় তো আমরা অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি।এখন সবাই ইচ্ছে করলেই সাত সমুদ্র পেরিয়ে যেতে পারে উড়োজাহাজে। তাই এতে এখন আর কোন মজা নেই। এখন আমরা যাবো আধুনিক রূপকথার অচিন দেশ অনন্ত আকাশে। ভয় পেও না কিন্তু। আমি সবসময় আছি তোমার সঙ্গে।”                                                                                                     

 কিছুক্ষণ চলার পরে দেখলাম দূরে একটি সাদা গোলা আর বাকি চারপাশে শুধুই ঘন অন্ধকার। ঠামা বলল ঐ সাদা গোলাটি নাকি সূর্য যার আলোকে আমাদের পৃথিবী আলোয় আলোময়। অথচ এখানের চারপাশের ঘন অন্ধকারকে কিন্তু সূর্যের আলো দূর করতে পারে নি। আরো কিছুক্ষণ চলার পরে হারিয়ে গেলো সাদা গোলাটাও। এখন শুধুই অন্ধকার। এমন মিশমিশে কালো অন্ধকার কখনও দেখি নি আমি। ঠামা পাশে থাকলেও গা শিরশির করে একটু ভয় করতে লাগলো। ঠামা বুঝতে পেরে বলল, “ ভয় পেয়ো না টুটুল বাবু। মহাকাশ এমনই কালো অন্ধকার। কেন জানো?” টুটুল মাথা নেড়ে না বললে, ঠামা বলল, মহাকাশ প্রায় একটি শূন্য জায়গা, মহাকশের আয়তনের তুলনায় সেখানে অন্য যেসব কণারা আছে তার সংখ্যা অনেক কম এবং সেগুলি পরস্পরের থেকে অনেক দূরে থাকায় আকাশে যে তারারা আছে তাদের থেকে কোন আলো বিচ্ছুরিত হয়ে আমাদের চোখে পৌঁছাতে পারে না, তাই মহাকাশের চারপাশ এমন কালো।” কথাটা শোনার পর ভয় চলে গেল আমার। জিজ্ঞাসা করলাম, “তবে আমরা যে আকাশে যে অনেক তারা,গ্রহ,চাঁদকে দেখি!” ঠামা হেসে বলল, “ তারা সবাই এই মহাকাশেই আছে, তবে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মাইল দূরে দূরে। একজনের থেকে আরেকজনের মাঝের জায়গাগুলো আমাদের কাছে শূন্য মনে হলেও এসব জায়গা কিন্তু পুরোপুরি শূন্য নয়, তাই আমি একে প্রায় শূন্য বলেছি।” অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তা হলে কি ঠামা ওখানে অদৃশ্য দুষ্টু দানোরা থাকে!” “তা তুমি তাদের অদৃশ্য দুষ্টু দানোও বলতে পারো। এই দানোরা হল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম গ্যাস, মহাজাগতিক ধুলিকণা, বিভিন্ন তারাদের থেকে আসা খুব ক্ষুদ্র আয়নিত কণা, তারাদের থেকে আসা আলো, মহাজাগতিক রশ্মি, বিগ ব্যাং নামের এক বড় দৈত্যের ফেলে যাওয়া বিকিরণ, অভিকর্ষ, বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বক ক্ষেত্র আর নিউট্রিনো নামের একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র কণা।” আমি বললাম, “ চলো না ঠামা, আমরা এই মহাকাশযান থেকে নেমে এই সব দানোদের দেখে আসি।” “ না বাবু, তোমাকে তো আগেই বলেছি এরা সব অদৃশ্য দানো। তা ছাড়া এমন ভাবে মহাকাশে যাওয়া যায় না। মহাকাশ ভীষন ঠান্ডা। এর তাপমাত্রা মাইনাস ৪৫৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট। ওখানে গেলেই ঠান্ডায় জমে গিয়ে একেবারে অক্কা। তা ছাড়া মহাকাশে তো অক্সিজেন প্রায় নেই বললেই চলে। আর তুমি তো জানো, অক্সিজেন ছাড়া মানুষ, পাখি, জীবজন্তু কিছুই বাঁচতে পারে না।” আমি বললাম, “ ঠিক আছে তবে যাবার দরকার নেই। আচ্ছা, ঠামা, এই মহাকাশে আমরা ছাড়া এখন অন্য কোন মানুষ আছে?” “হ্যাঁ বাবু, এই মহাকাশে এখন মোটমাট ১১ জন নভশ্চর আছে, বলল ঠামা।” আমি বললাম, ভয় পেও না, আমি যাচ্ছি না। কিন্তু মনে কর, আমি যদি এই যানের বাইরে গিয়ে চিৎকার করে ওদের ডাকি, শুনতে পাবে ওরা? ঠামা ওঁর পেটেন্ট গালে টোল ফেলা  মিষ্টি হাসিটা হেসে বলল, “ না বাবু তুমি যতই চেঁচিয়ে ডাকো না কেন ওরা শুনতে পাবে না। ওরা তোমার খুব কাছে থাকলেও শুনতে পাবে না। মহাকাশে তো কোন শব্দ যাতায়ত করতে পারে না।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন ঠামা, তুমি যখন আমায় গল্প বলতে কিংবা আমি তোমার সঙ্গে চোর পুলিশ খেলতাম তখন টুটুল বাবু কোথায় বলে হাঁক পারলে .., তখন তো আমি লুকিয়ে থেকেও দূর থেকে শুনতে পেতাম তোমার কথা। পৃথিবী তো এই মহাবিশ্বেরই অঙ্গ তাহলে মহাকাশে কেন শব্দরা চলাফেরা করতে পারবে না?”

 “ পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল আছে। এই বায়ুতে যে ছোট ছোট অণু আছে কেউ কথা বললে সেই অণুগুলির কম্পন হয় আর এই কম্পনের মাধ্যমেই শব্দ পৌঁছে যায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। মহাকাশে তো বায়ু মণ্ডলই নেই, তবে শব্দ এখানে যাবে কি করে, বললো ঠামা।” আমি মজা পেয়ে বললাম, “ তাহলে তো পৃথিবীতে শব্দদূষন করে মানুষদের জ্বালাচ্ছে যারা তাদের  মহাকাশে ছেড়ে দিলে ওদের শব্দ হবে জব্দ।” ঠামা কিছু বলল না শুধু হাসল। ঠামা বলল, “ এবার যে ফিরতে হবে টুটুল বাবু। না হলে বাড়ির সবাই যে চিন্তা করবে।” আমি বললাম, “ কেন ঠামা এখনই তো এলাম।”   উত্তরে ঠামা বলল, “ তুমি ঠিকই বলেছ বাবু। আমরা মহাকাশে মাত্র ০.০০২৬ সেকেন্ড থেকেছি। কিন্তু এখানের ০.০০২৬ সেকেন্ড যে পৃথিবীর ১ ঘণ্টা। এতক্ষণে তোমাদের ওখানে এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। তাই আমাদের এখন যেতে হবে।” মহাকাশ ভ্রমণ সেদিনকার মত শেষ করে রওনা দিলাম আমরা বাড়ির দিকে। হঠাৎ দেখি আলোর ছটা নিয়ে একটা ধূমকেতু এগিয়ে আসছে আমাদের ছোট্ট পক্ষীরাজ মহাকাশযানের দিকে। আমি ভয় পেয়ে ঠামাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে দেখি ঠামাকে কিছুতেই জাপটে ধরতে পারছি না। আমি ভয়ে ঠামা ঠামা করে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে দেখি অনেকে আমায় নাড়া দিচ্ছে। তাকিয়ে দেখি আমার খেলার বন্ধুরা সব আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সকলে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো – “কিরে, ঠামা ঠামা করে চেঁচাচ্ছিলি কেন? “

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম,“ও, কিছু না ।”

আসলে সত্যিটা বললেই তো ওরা মা বাবা কে বলে দেবে। আর তা হলে মা বাবা ভয়ের চোটে আমায় ভূতে পেয়েছে ভেবে আমার মাঠে আসাই বন্ধ করে দেবে। তোমরাও মা বাবাকে আমার এই যাওয়ার ব্যাপারটা বোলো না যেন!

                

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb