পচা ভাদ্দরের গল্প

লেখক - ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়

                                                        

নিশিথ খুড়োর টিনের চালে একটানা জল পড়ে পড়ে বেশ সুন্দর আওয়াজ ওঠে। গত ক’টা দিন সারা দিন ধরে অঝোর ধারে বিষ্টি নেমেছে। পড়েছে, পড়ছে আর পড়েই যাচ্ছে। মাঝ রাত্তিরে ঘুম হঠাৎ ভেঙ্গে গেল টিনের চালায় জল পড়ার সুরে। খুড়োর রান্নাঘরের পাশে যে গুদোম ঘরটা আছে তার টিনের চালা। চালায় জল রোজই পড়ে। তবে এর ওপরে যে ছাদটা আছে তার থেকে ছাদে বেশি জল জমলে একটা পাইপ দিয়ে হুড় হুড় করে জল পড়তে থাকে টিনের চালায় আর তাই সুর ওঠে দারুন ভাবে।

জলধারার গান শুনতে শুনতে বাকি রাতটা বেশ ভালই লাগল। পরের দিন সকালে উঠেই দেখে ঝলমলে রোদ। বেশ ভাল লাগল। খুড়ো তো রিটায়ার্ড লোক। অফিস যাওয়ার বালাই নেই। কথায় বলে ষাট বছরের পর থেকে বয়েস আবার কমতে শুরু করে। বাইরে বেরিয়ে যেই দেখেছে নীল আকাশে সাদা তুলোর মত মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে অমনি রবিঠাকুরের ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী’ গানটা গাইতে লাগলেন। আর অমনি তিন বছরের ছোট্ট নাতনি এসে নাচতে লাগল হাত ঘুরিয়ে আর কোমর দুলিয়ে।

তিনি রিটায়ার্ড হলে কী হয় নাতনির তো ইস্কুল আছে। নাতনির মায়ের এক ধমকে নাতনির হাত ঘোরানো বন্ধ হয়ে গেল। আর আনন্দ সব মাটি হয়ে গেল নিশিথ খুড়োর। মেজাজ বিগড়ে এসে বসলেন ঘরে। এমন সময় একটা হাওয়া ঢুকল। দেওয়ালে টাঙান ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ে জানিয়ে দিল শ্রাবণ মাস শেষ। তার মানে ‘ঝর ঝর বাদর মুখর দিনে’ আর নেই। তার মানে?

ক্যালেন্ডারের পুরোন পাতা ঝোলা একেবারে দেখতে পারে না খুড়ো। খচাৎ করে শ্রাবণ লেখা পাতাটা ছিঁড়ে ফেলতেই পচাৎ করে কে একজন ধপ করে নেমে এল মাটিতে। পেছনে তাকিয়ে খুড়ো অবাক। কে এক সুন্দর চেহারার মানুষ গায়ের ঘামাচি মারছে।

--আরে কে তুমি?

--আমি পচা-

--লে হালুয়া পচাটা আবার কে? বলি তুমি যদি গোপাল ভাঁড়ের কেলে পচা হও তো জিজ্ঞেস করব এত সাদা হলে কী করে? তুমি হয়ত বলবে—

--সাদা ময়দা মেখে? আরে না না ময়দা মেখে নয়। সাদা মেঘ মেখে। আমি হলুম পচা ভাদর। ঝিনুক রেখেছ ঝিনুক?

--ঝিনুক কেন?

--ঘামাচি মারতে আবার জিজ্ঞেস করে কেন? পটাস পটাস করে ঘামাচি মারতে ভাল লাগে কিনা বল? সমুদ্দুরে বেড়াতে গিয়ে ঝিনুক কেনো নি কোনোদিন? তা দিয়ে সুখে ঘামচি মার নি কখনও?

নিশিথ খুড়ো তো কিছু বুঝতে পারছে না। তাই বলল। পচা তার সাদা দাঁত বের করে হেসে বলল, পরে বুঝবে। গরিবের কথা বাসি হলে মিষ্টি হয় জানো তো?

পচাৎ করে চলে গেল সে। যেন পিছলে গেল। আর ঠিক এমন ভাবেই পিছলে গেল ক্যালেন্ডারে লেখা আর কয়েকটা দিন। সারাদিনে বেশ কয়েকবার প্রবল বৃষ্টি, কড় কড় করে বজ্রপাত আবার তার কিছুক্ষণ পরেই চড়া রোদ্দুর। পার্থক্য শুধু একটাই। সূর্য একটু দক্ষিণে হেলে গেছে আর রোদের রঙ হয়েছে খানিক সোনালী।

পাখার হাওয়াতেও গায়ের ঘাম কিছুতেই শুকোয় না। নাতনিকে ডেকে নিশিথ খুড়ো বলল, আন তো রে তোর খেলনার কৌটো থেকে দুটো ঝিনুকের খোলা।

নাতনি দৌড়ে দৌড়ে ঝিনুকের খোলা এনে হাজির। খুশিতে ডগমগ হয়ে দাদুকে প্রশ্ন, কেন দাদু তুমি কি এখন পুতুল খেলবে?

--না রে মা আমি এই ঘামাচিগুলো এখন পট পট করে মারব।

নাতনির  বদলে তার মা এসে হাজির একটা পাউডারের কৌটো নিয়ে। হেসে বলল, দাঁড়ান বাবা এই ঘামাচি যাবে এই নাইসিল দিলে। বসেই তো আছেন। একটু একটু করে লাগিয়ে নিন।

সবাই যে যার কাজে চলে গেল। ঝিনুক দিয়ে ঘামাচি মেরে পাউডার লাগাতে লাগাতে নিশিথ খুড়ো শুধু ভাবতে লাগল, এ কী কষ্ট রে বাবা।

কোথা থেকে পচাৎ করে লাফিয়ে হাজির সেই পচা। সাদা মেঘের মত দাঁত বার করে বলল, দেখলে তো আমার কথা কেমন ফলে গেল। এখন আর পাখার হাওয়াতেও স্বস্তি পাচ্ছ না। হা হা হা হা—

বলে হাসতে হাসতে মহা আনন্দে পচা চলে গেল। পচা যাবার পর নিশিথ খুড়ো মনে মনে ভাবতে লাগল, সত্যিই তো এমন কেন হয়। এই পচা ভাদ্দরে এত গুমোট কেন হয়। হাওয়াতেও ঘাম কেন শুকোয় না?

তার সেই মনে মনে বলা কথাগুলো শুনে ফেলল তার নাতনির মা মানে খুড়োর বৌমা। বৌমা আবার বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট। নিশিথ খুড়ো ছেলের জন্যে মেয়ে মানে পাত্রি দেখতে যাওয়ার সময় খুড়োর ছেলে বেঁকে বসেছিল সে নাকি বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট ছাড়া বিয়ে করবে না। নিশিথ খুড়ো একাউন্টেন্সির লোক। ব্যাংকে কাজ করত। ছেলেকে প্রশ্ন করল, কেন রে খোকা? ইকোনোমিক্সের এম এ এমন সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে পাচ্ছি আর তুই কিনা সায়েন্স সায়েন্স বলে বাচ্চাদের মত বায়না করছিস? সায়েন্স কি খায় নাকি গায়ে মাখে?

-করছি কি আর সাধে? বাবা তুমি বোঝ না চিরকাল ব্যাংকে হিসেব নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাথায় টাক করে ফেললে। আমি নিজে তো হিস্ট্রির লেকচারার। সে আমার ন্যাক ছিল হিস্ট্রিতে তাই। কিন্তু বাবা বাড়িতে একজন সায়েন্সের লোক থাকা খুব দরকার। তুমি জান কিনা জানি না তবে। আজকাল বিজ্ঞান জানা লোক বাড়িতে থাকলে চলে না। তাছাড়া আমার ছেলেমেয়ে হলে তাকে একদম ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানে জ্ঞান দিয়ে জীবন যাত্রার হাল বোঝাবে কে শুনি? আমার সায়েন্সের মেয়েই চাই।

তাই এসেছে সুগতা। বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট হয়ে মাস্টার করার সময়েই বিয়ে।

সুগতা এসে বলল। বাবা ভাদ্রমাসে এটাই হয়। যতই পাখার হাওয়া খাও গরম কমে না। ঘাম শুকোয় না। প্যাচ প্যাচ করতে থাকে গা-টা।

অবাক হয়ে নিশিথ খুড়ো ভাবতে লাগল, সত্যি তো এটা তো পচাও বলেছিল।  

--কেন বৌমা? কেন এমন হয়?

--বলছি ভাল করে শুনুন বাবা। আসলে গরমে আমাদের শরীরে ঘাম হয় আর বাতাসে সেই ঘাম শুকিয়ে যায় আর জল যখন বাষ্প হয় তখন সে আমাদের শরীর থেকে অনেক তাপ টেনে নিয়ে চলে যায়। আমাদের শরীর ঠান্ডা হয়।

--হ্যাঁ আমিও তো তাই জানতুম। সব কালেই তো হয়। কিন্তু—

আমার যেন পচাৎ করে লাফিয়ে পড়ল সেই পচা ভাদ্দর। বলল, কিন্তু এই পচা ভাদ্দরে এটা হওয়ার জো নেই। এটা যে আমার কাল। আমার দখলে। হা হা হা হা—

মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল নিশিথ খুড়োর। ইচ্ছে হল, ধর বেটাকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দে। বৌমার কাছ থেকে একটু বিজ্ঞানের গল্প শুনতে দেবে না। তাকালো বৌমার দিকে। কিন্তু মনে হল সুগতার সেদিকে খেয়াল নেই। যেন পচা ভাদ্দর এসেছে সামনে এটা তার খেয়ালেই নেই।

বৌমা বলেই চলল, কিন্তু বিশেষ এই ভাদ্দর মাসে কেন এটা হয় সেটা জানতে হবে আগে। ভাদ্র মাসে কিন্তু দিন জুড়ে বৃষ্টি হয় না বাবা। যখন বৃষ্টি হয় তখন কিন্তু প্রচুর মানে হেবি শাওয়ার। আর পরক্ষণেই চড়া রোদ। এই চড়া রোদে সেই জল বাষ্প হয়ে যায়। জল প্রচুর আর বাষ্পও প্রচুর।

--তার মানে এখন বাতাসে সর্বদাই প্রচুর বাষ্প এটা বলছ?

--হ্যাঁ বাবা প্রচুর বাষ্প।

--তা তাতে আর কী অসুবিধে শুনি?

--অসুবিধে নয় বলছেন কী? বাতাসের যদি এত বেশি বাষ্প মিশে থাকে তবে সে আর বাড়তি বাষ্প টানবে কী করে বলুন বাবা? ভেবে দেখুন আপনার পেট যদি ভর্তি থাকে তো আপনি আর খাবেন কী করে?

অনেকক্ষণ ভাবল কথাটা নিয়ে নিশিথ খুড়ো। ভেবে দেখল কথাটা তো ঠিক। বলল, বুঝেছি সেই কারণেই বর্ষাকালে বা শরৎকালে কাপড় শুকোতে দেরি হয়। তাই না?

-আপনি ঠিক ধরেছেন বাবা। তবে বর্ষাকালে সর্বদা জল পড়ে বটে কিন্তু সূর্যের তাপ অত থাকে না বলে জলীয় বাষ্প শরৎকালের মত বেশি হয় না।

কোথা থেকে পচ করে লাফিয়ে আবার নামল সেই পচা ভাদ্দর। হা হা হা করে হেসে বলল, বুঝলে তবে এই ভাদ্দর মাসে এত গুমোট হওয়ার কারণ।

নিশিথ খুড়ো কিছু বলার আগেই নাতনি দাদুর কোলে ধপ করে বসে পড়ে বলল, আমার মা বুঝিয়েছে আর দাদু না বুঝে পারে?

                                               

 

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb