অদৃশ্য মারনাস্ত্র

লেখক - শংকর ঘটক

                                

  ১

ব্রিটেন সিকিউরিটি সার্ভিসের প্রধান ডেম এলিজা অন্তরের যাবতীয় উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রেখে শুধু সাবধান বাণীটুকু উচ্চারণ করলেন। “এখন বিশ্বজুড়ে যে ভাইরাসের প্রবল প্রতাপ চলছে তার পেছনে কোনও মানুষের হাত নেই সেটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে ।” ম্যাডাম এলিজার বক্তব্য, “মানুষ যবে এই পৃথিবীতে এসেছে তার বহু আগেই এসেছে ভাইরাস। ভাইরাস যদি এতটাই আক্রমণাত্মক প্রকৃতির হত তাহলে মানুষের এত শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব হত কি?”

“একদম ঠিক। সমর্থন করলেন পল, পল করনিস।” বললেন “নিউইয়র্কের স্কুল অফ মেডিসিনের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক পাওলো মিতা কে এক সাংবাদিক সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন ‘ডি এন এ’র মধ্যে গুঁজে থাকা ভাইরাসগুলো আমাদের বন্ধু না শত্রু?”

মুচকি হেসে উত্তর দিয়ে ছিলেন মিতা, “আমি এদের বলি ফ্রেনেমিস, একাধারে ফ্রেন্ড আবার এনিমিও। কোন একটি মানুষের একটি জীবনকাল যদি ধর, অগুন্তিবার ভাইরাসের যন্ত্রণা দায়ক সংক্রমণের কথা যদি ভাব, ভাইরাস আমাদের পরম শত্রু। অন্যদিকে যদি সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে যাও, শিম্পাঞ্জি থেকে আজকের মানুষ ছাড়িয়ে লক্ষ বছর এগিয়ে যাও, ভাইরাস বিবর্তনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। বদলে যাওয়া প্রাকৃতিক পরিবেশে সুস্থভাবে বাঁচার জন্য প্রাণীদের তৈরি করে ভাইরাস, জিনোমের আণবিক বিন্যাসটুকু পাল্টে দিয়ে। ভাইরাস তখন আমাদের পরম বন্ধু।”     

পিস রিসার্চ ইন্স্টিটুটের আলেকজান্ডার কেলে, ফ্র্যাঙ্কফুট থেকে ভিয়েনা এসেছেন এই বিশেষ আলোচনা সভায় যোগ দিতে। তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট। “ভাইরাস প্রাকৃতিক উপাদান। সে তার নিজের প্রয়োজন মাফিক কর্মপদ্ধতি ঠিক করে নেয়। মানুষের এখানে নাক গলানই উচিত নয়।”

ম্যাডাম এলিজা ডান হাতটা সামান্য তুলে আলেকজান্ডার কেলেকে থামিয়ে দেন। “বিষয়টা কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ আকার নিয়েছে ডক্টর কেলে। চারদিক দেখে শুনে মনে হচ্ছে বিশ্বের কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও মারাত্মক খেলা চলছে। সেই খেলার সঙ্গে অবশ্যই জড়িয়ে আছে এক গুচ্ছ ক্ষমতাধর বিজ্ঞানী। আর, তাদের অর্থ যোগাচ্ছে ধনবান কোন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি।”

“আপনার কি ধারণা কিছু রাষ্ট্রেরও সমর্থন সহযোগিতা আছে সেই কাজে?” প্রশ্ন করেন পল করনিস।

“কিছুই জানা নেই। তা ছাড়া নেহাত সন্দেহের বশে কোনও আলটপকা মন্তব্য করাটাও সমীচীন নয়।” জবাব দেন এলিজা।

জোসেফ মেঙ্গেলে, বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী, তীব্র প্রতিবাদ করলেন। “পর্যাপ্ত অনুসন্ধান আর তথ্য সংগ্রহ ছাড়াই এই জাতীয় সন্দেহের আবহ সৃষ্টি কি অদৌ অভিপ্রেত? এতে কি আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবেনা?”

“১৯৯০ সালের ২২ মার্চ, বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের একটি অ্যাপার্টমেন্টে বিজ্ঞানী জেরাল্ড ভিন্সেন্ট বুলের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়। কানাডার নাগরিক, বিশ্বের প্রথম সারির অস্ত্র-বিজ্ঞানী নিহত হলেন ব্রাসেলসে, খুনি ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। কিছু হয়েছে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায়? সকলেই যেন অন্ধ আর বধির?” শ্লেষ ঝরল এলিজার কণ্ঠে।

চোদ্দ-পনের জন প্রথম সারির বিজ্ঞানী একত্রিত হয়েছেন একটি আলোচনা চক্রে। কোভিডের বিশ্বজোড়া মারণলীলার প্রেক্ষাপটেই এই আলোচনা সভার আয়োজন করেছে একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ‘নেটওয়ার্ক অফ ইন্টারন্যাশনাল সাইন্স একাডেমী’। শুধু কোভিড নয়,বিশ্ব স্বাস্থ্য  সংস্থার পরিসংখ্যানের ওপর চোখ বোলালে আঁতকে উঠতে হয়। অন্তত: শখানেক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাইরাস ঘটিত অসুখে জনজীবন জেরবার। বলিভিয়ার প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ইভান গুজ-ম্যান জোরের সঙ্গে নিজের স্থির বিশ্বাসের কথা জানালেন।

“আমার পরিচিতরা জানেন-রাখঢাক করে কথা বলা আমার ধাতে সয়না। অনেক দিন ধরেই একটা বিষয় আমায় ভাবাচ্ছে। গভীর ভাবেই ভাবাচ্ছে। গত আট দশ বছর ধরে কিছু কিছু প্রাণী বিলুপ্তির পথে। বেশ দ্রুত হারেই। সম্পূর্ণ তালিকা দেখাচ্ছি না শ্রোতাদের ধৈর্যচ্যুতির কথা ভেবে। একটি বৈশিষ্ঠর কথাই শুধু উল্লেখ করব। বিলুপ্তির পথে এই সব প্রাণীদের বেশির ভাগেরই আস্তানা বিশ্বের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশের জঙ্গল।”

“আপনি কি কিছু সন্দেহ করছেন?”-প্রশ্ন করেন মালয়েশিয়ার বিজ্ঞানী বেটি সিম কিম লি।

“অবশ্যই। আপনাদের দেশের কথাই ধরুন, ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ার বিস্তীর্ণ ঘন-বর্ষণ-বনাঞ্চল জুড়ে ছিল ওরাংওটাঙদের বিচরণ ক্ষেত্র। হঠাৎ করেই তাদের সংখ্যা কমতে আরম্ভ করল। বর্তমানে বোর্নিও আর সুমাত্রার কিছু অঞ্চলে গুটিকয়েক ওরাংওটাং দেখতে পাওয়া যায়। বাকিরা সব গেল কোথায়?”

“আপনি কি বলতে চান মানুষ ধরে ধরে তাদের মেরে ফেলেছে”-গর্জে ওঠেন জোসেফ মেঙ্গেলে –“যত সব অবাস্তব কল্পকাহিনী।”

“ধরে ধরে মারতে যাবে কেন যখন বিকল্প ব্যবস্থাই রয়েছে। এখন “গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ কথাটা বেশ   চালু হয়েছে। ওয়েপন অফ মাস ডেসট্রাকসন। তারও অনেক হ্যাপা। গোটা বিশ্বের চোখের সামনে স্তূপীকৃত মৃতদেহ ভালো দেখায় না। অসুখে মারা-গেলে সে ভয় নেই। কোভিডের সময় দেখেছি। অতএব-”

“কি বলতে চাইছেন আপনি?” গুজ-ম্যানের কথা শেষ হবার আগেই হুঙ্কার দেন মেঙ্গেলে। “কোভিড মানুষের সৃষ্টি?”

নিকোলাই বার্নস্টেইন চুপচাপ বসেছিলেন এতক্ষণ। “হতেও তো পারে। কত অপরাধই তো মানুষ করে। এটা করতে অসুবিধা কোথায়?”

“কোন উদ্দেশে করবে। কারণটা কি?” মেঙ্গেলে বলেন। “বিনা উদ্দেশে খুন খারাপি সুস্থ মস্তিষ্কের কাজ হতে পারেনা।”

এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না ভারতের একমাত্র প্রতিনিধি ভাইরোলজিস্ট অনুসন্ধান বসু- “১৯৯৫ সালে টোকিওর পাতাল রেলে মার্স গ্যাস ব্যবহার করে হামলা অথবা ২০০১ সালে নিউইয়র্ক আর ওয়াশিংটনে অ্যান্থ্রাক্স ভাইরাস ছড়ান। কেন? কি তার উদ্দেশ্য ছিল? কেউ জানে না। মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণী।”

“এই আলোচনার শেষ নেই”- ডেম এলিজা বলেন, “আমরা এবার সরাসরি চলে যাব মূল বিষয়টি নিয়ে আলোচনায়। মারণাস্ত্র নির্মাণ বিরোধী একটি সংস্থা ‘নেটওয়ার্ক অফ ইন্টারন্যাশনাল সাইন্স একাডেমী’র কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওদের বক্তব্য অনুযায়ী বাছাই করা মানুষ কে হত্যা করা যায় এমন একটি অস্ত্র তৈরি হতে চলেছে। অনতিবিলম্বে এই কাজটি বন্ধ না করলে সামগ্রিক ভাবে মানব সমাজ অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সন্মুখীন হবে।”

“একটু ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে? অন্তত: উদাহরণ?”

“হাতের কাছেই উদাহরণ আছে। ইভান গুজ-ম্যান এক্ষুনি যে উদাহরণটি সামনে আনলেন। ওরাংওটাঙদের দ্রুত কমতে থাকার ঘটনা। বিশেষ ধরনের ভাইরাস মিলিত হবার জন্য বিশেষ ধরনের ডিএনএ খোঁজে। যদি বিশেষ ভাবে সংশ্লেষিত ভাইরাস জায়গা মত ছড়িয়ে দেওয়া যায় তবে নির্বাচিত প্রজাতির প্রাণহানি হতেই পারে।”

“আপনারা বিশ্ব পরিবেশ নিয়ে গত তিন দিন আলোচনা করেছেন। আপনাদের মূল্যবান উপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে এই আলোচনা সভা। সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”

ঘটনাটা কাকতালীয় না ও হতে পারে। আকস্মিক ভাবে ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ার ওরাংওটাঙদের ব্যাপক সংখ্যা হ্রাসের ঠিক পরে পরেই অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয় বিশেষ একটি জনগোষ্ঠী। এটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার অবকাশ না দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অনুন্নত অঞ্চলেই এই জাতের ঘটনা ঘটতে দেখা গেল। তফাৎটা ছিল আক্রমণকারী ভাইরাসের শ্রেণীচরিত্র। করোনা ভাইরাস,অ্যাডেনোভাইরাস,কোক্সাকিয়েভাইরাস অথবা অন্য কিছু। ঘটনাটি প্রথম লক্ষ করেন অনুসন্ধান বসুর মাস্টার মশাই,অধ্যাপক জীবন সামন্ত। অনুসন্ধান পি এইচ ডি করেছেন অধ্যাপক সামন্তর তত্বাবধানে। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন অনুসন্ধানকে।

“একটা সিরিজ অফ ঘটনা ঘটে চলেছে তুমি কি খেয়াল করেছ? ভাইরাস কোন নতুন কিছু নয় কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় একই সময় নানা ধরনের ভাইরাসের মারাত্মক সংক্রমণ ভাবাচ্ছে না? আবার পৃথিবীর মানচিত্রে করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা চিন্হিত করলে দেখবে অঞ্চল বিশেষে তার লক্ষ্যণীয় তারতম্য ঘটছে।”

“স্যার, তাহলে কি এটা বলা যায় যে জনগোষ্ঠীর জিনের গঠনের তারতম্য আর করোনা সংক্রমণের তীব্রতা সম্পর্ক যুক্ত?”

“অবশ্যই। অনেক বিশ্লেষণের পর আমি একরকম নিশ্চিত। একটু খেয়াল করলেই দেখবে ভারতীয় উপমহাদেশ অথবা আফ্রিকা, জনসংখ্যার শতকরা হিসেবে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ইউরোপ-অ্যামেরিকার তুলনায় অনেক কম। জিন ঘটিত তারতম্যের জন্যই এরকমটা ঘটছে বলে আমার অনুমান। আসলে কি জান, হলডেন সাহেব সেই ১৯৪৯ সালেই বলে গিয়েছেন যে প্রাণ সৃষ্টি, তার রক্ষণাবেক্ষণ আর বিবর্তনে ভাইরাসের ভূমিকাই মুখ্য।”

“স্যার, বর্তমানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে ভাইরাস সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে সেটা কি প্রাকৃতিক ভাবেই ঘটছে না কি কেউ ঘটাচ্ছে”?

“আমার ধারনা এটা প্রাকৃতিক ভাবে ঘটছে না, কোন গোষ্ঠীর পরিকল্পিত প্রয়াস এটা। প্রাকৃতিক সংক্রমণের প্যাটার্নটা এখানে অনুপস্থিত।”

“গোষ্ঠীর লাভ”?

“এটাই তো মানুষের চরম চিন্তার দৈন। গত শতাব্দীতে ইহুদিদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষে যে ভয়াবহতার সৃষ্টি হয়েছিল তার কি কোন ব্যাখ্যা আছে? এই সমস্ত কার্যকলাপের সুস্থ কোন ব্যাখ্যা থাকেনা।”

“তার মানে স্যার আপনার ধারনা পরিকল্পিত ভাবে নির্বাচিত মানবগোষ্ঠীকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার ঘৃণিত প্রয়াস।”

“ঠিক তাই। এখন চলছে গবেষণা। তারই ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি, অন্তত সেটাই আমার ধারনা। যে জন্য তোমায় ডেকেছি, তুমি ব্রিটেন সিকিউরিটি সার্ভিসের প্রধান ডেম এলিজার সঙ্গে যোগাযোগ কর। ও এখন হায়দ্রাবাদে এসেছে একটা কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করতে। সোজা চলে যাও। আমার সন্দেহের কথা এলিজাকে জানাও। যথা সম্ভব গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। আমার কথা বললে এলিজা গুরুত্ব দেবে।”

অনুসন্ধান বেরোতে যাচ্ছে এমন সময় পিছু ডাকলেন অধ্যাপক সামন্ত। “উইকিপিডিয়া থেকে প্রিন্ট নিয়েছি। এলিজাকে দেখাতে পারো। কাজে লাগলেও লাগতে পারে।”

একটা কাগজের টুকরো অনুসন্ধানের হাতে দিলেন স্যার।

 অনুসন্ধান চোখ বোলায়।

ড. ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলা (ইংরেজি: Dr. Josef Mengele — জার্মান উচ্চারণ: ইয়োসেফ্ ম্যাঙ্গেলা) (১৬ মার্চ ১৯১১ – ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯) একজন জার্মান সামরিক কর্মকর্তা এবং নাৎসি বন্দী শিবির অশ্চভিট্জ-বিরকেনুর একজন চিকিৎসক। তিনি জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্বে এবং ফ্রাংকফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঔষধ শাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি মূলত পরিচিত একজন নাৎসি চিকিৎসক হিসেবে, যেখানে তার দায়িত্ব ছিল আগত বন্দীদের বাছাই করা যে কাদেরকে হত্যা করা হবে আর কাদেরকে দাস হিসেবে খাটানো হবে। এছাড়া বন্দীদের ওপর বিভিন্ন রকম পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তার কর্মস্থলে তিনি "অ্যাঞ্জেল অফ ডেথ" বা "বিউটিফুল ডেভিল" নামে পরিচিত ছিলেন।

অনুসন্ধান সরাসরি যোগাযোগ করল এলিজার সঙ্গে। একটা ভিডিও আলোচনার সময়টা ঠিক করে নিলো দুজনে। স্যারের কথা বলতেই খুশিতে ডগমগ। অনুসন্ধানের কিছু কাজ ছিল। স্যার বলেছেন হায়দ্রাবাদ চলে যেতে। স্যারের ধারনা মুখোমুখি বসে কথা না বললে আলোচনায় গভীরতা আসেনা। অনুসন্ধান হায়দ্রাবাদের একটা এয়ার টিকিট কিনে ফেলল। আরও কয়েকটা টুকিটাকি কাজ সারতে সারতে ভিডিও কলের সময় এসে গেল।                                     এলিজার সঙ্গে অনুসন্ধানের এই প্রথম সাক্ষাত। এলিজাকে দেখে মনে হয় অনুসন্ধানেরই বয়সী। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রথম কিছুক্ষণ স্যারকে নিয়েই আলোচনা হল। এলিজা স্যারের গুণমুগ্ধ।

মূল প্রসঙ্গে যেতে-না-যেতেই এলিজা গম্ভীর হয়ে গেল।

“বোস, এটা নিয়ে আর আলোচনা কোরোনা। কাল তো তুমি হায়দ্রাবাদ আসছো, সন্ধ্যে ছটায় আমার হোটেলে চলে এসো” ।

হঠাৎ এলিজার সিরিয়াস হয়ে যাবার কারণটি বোঝা গেল পরের দিন হোটেলের ঘরে। আলোচনা শুরুর আগে কি একটা যন্ত্র দিয়ে টয়লেট সমেত গোটা ঘরের তল্লাসি নিল এলিজা। তারপর ঠাণ্ডা হয়ে বসে স্মিতহাসি মুখে নিয়ে অনুসন্ধানকে বলল, “এবার বল। আমাকে এতটা সাবধান হতে হচ্ছে কারণ আমার ওপর একটা দলের সতর্ক দৃষ্টি।”

অনুসন্ধান স্যারের কথা গুলো হুবহু এলিজাকে জানাল। সব শেষে স্যারের দেওয়া চিরকুটটা, যার কোন অর্থ অনুসন্ধান বোঝেনি, এলিজার হাতে দিল।

এতক্ষণ স্যারের বলা কথাগুলোর বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া এলিজার চোখে মুখে ছিলনা। চিরকুটটা হাতে পেয়ে সেই মেয়ে চেয়ার ছেড়ে স্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠল “স্যারকে আমার শত কোটি প্রণাম জানাবে। আমি সত্যিই অবাক। ঘটনা স্থল থেকে অত দূরে নিজের ঘরে বসেই যে সত্যটা উনি দেখলেন অত কাছে বসেও আমরা সেটা কেউ দেখতে পেলাম না। আর শোনো,হাতে বেশি সময় নেই। আরও ক্ষতি হবার আগেই কিছু একটা করতে হবে। তুমি তৈরি হও আমার সঙ্গে যাবার জন্য। এমব্যাসিকে বলে ভিসার ব্যবস্থা আমি করে দেব। টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা কোরোনা,সেই দায়িত্ব আমার সংস্থার।” মিষ্টি হেসে এলিজা বলে “আমার সঙ্গে যেতে আপত্তি নেই তো?”

লাজুক মুখে নীরবে হাসল অনুসন্ধান বসু। “আমরা কোথায় যাব?”

“প্রথমে লন্ডন তারপর সেখান থেকে কোথায় যাব সেটা ঠিক হবে পরে। স্যারের অনুমান ঠিক হলে পরের গন্তব্য রাভেনসব্রুক, জার্মানির একটা গ্রাম। হিটলারের অন্যতম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছিল সেখানে।”

রাভেনসব্রুক, জার্মানির একটা গ্রাম। চূড়ান্ত অবহেলায় পড়ে আছে একটা বড়োসড়ো বাড়ি। চারদিকে আগাছার জঙ্গল। এলিজা আর অনুসন্ধান, দুজনেরই কানে তারহীন হেডফোন, মুখের সামনে ছোট্ট স্পিকার। মাথা থেকে পা পর্যন্ত মোটা পোষাকে ঢাকা। অনেকটা নভোচারী ঢঙে। তফাৎ শুধু ওজনে। এদের পোষাক তুলোর তৈরি, অত্যন্ত হালকা।

“বাড়িটা কি খালি? ভেতরে তো লোকজন আছে বলে মনে হচ্ছে না” ফিসফিস করে বলল অনুসন্ধান।

“এদের বিশ্বাস কোরোনা। ভয়ঙ্কর মানুষ এরা। ১৯৪৩ সালে, রাশিয়ার আক্রমণে, এ বাড়ির জঘন্য জৈব অস্ত্র সংক্রান্ত গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। এর পরের ঘটনা বিশ্বসুদ্ধ লোক জানে। হিটলারের পতন।” এলিজা থামে। “এখানেই গবেষণা করতেন ড. ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলা যার কথা মনে করিয়ে দিলেন প্রফেসর সামন্ত। প্রফেসর সামন্তর সঙ্কেত অনুসরণ করেই ব্রিটেন সিকিউরিটি সার্ভিসের গোয়েন্দারা এই বাড়িটি চিহ্নিত করতে পেরেছে। ওরা এটাও জেনেছে যে এই বাড়িতে কোন একটি অজ্ঞাত বিষয়ের ওপর গবেষণা হয়।”

“আর কিছু জানতে পারোনি? কি বিষয়ের গবেষণা, কারাইবা গবেষক, কিছু জেনেছ?”

“কিভাবে জানব? এই অঞ্চলটা জার্মান, আমরা ব্রিটিশ, আইনত আমরা এখানে তদন্ত করতেই পারিনা। তবুও সাহস করে তোমাকে নিয়ে একরকম তদন্ত করতেই যাচ্ছি। কিন্তু সাবধান, ওরা বিপজ্জনক এবং নৃশংস।”

“স্যারের সঙ্গে আমার যা কথা হয়েছে ওরা ভাইরাস নিয়েই কাজ করে।”

“ঠিক। আমাদের প্রাথমিক তদন্তেও সেরকমটাই অনুমান”

কথা বলতে বলতে দুজনেই বাড়িটার কাছাকাছি চলে এসেছে। গোটা বাড়ি অন্ধকার। নির্জন নিঃশব্দ পরিবেশ। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। সাহসে ভর করে অনুসন্ধান দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। “এলিজা, ভেতরে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অগুনতি লাল আলো। যেন সারি সারি যন্ত্র চলছে।”

“দেখি দেখি”, অনুসন্ধানকে ঠেলে সরিয়ে এলিজা চোখ রাখে দরজার ফাটলে “ও মাই গড, এতগুলো ইনক্যুবেটর। কাদের টার্গেট করেছে কে জানে?”

“এবার কি করণীয়?”

“করণীয় একটাই। ভাইরাস খতম করতে হবে এক্ষুণি। স্যারের কথামত একটা কেমিক্যাল তুমি নিয়ে এসেছ বলেছিলে। সঙ্গের লোকজন আমাদের পেছনেই আছে। তুমি তোমার কেমিক্যাল আমায় দাও। বাকি কাজটা ওরাই করবে। এবার মনে হয় ল্যাটিন অ্যামেরিকার কোন অঞ্চলকে টার্গেট করার ইচ্ছে ছিল।”

অনুসন্ধান, বড় পলিমার প্যাকেটে ভরা ট্রাইটন এক্স এর দ্রবণ এলিজার হাতে তুলে দিল। “ইনক্যুবেটারের ভেতরে স্প্রে করার আগে নিজেদের ভিজিয়ে নিতে বলবে। যে কোনো ভাইরাস এই তরলে সম্পূর্ণ দ্রবীভূত হয়ে যায় তাই ভয়ের কিছু নেই।”

এলিজার অনুরোধে ভাইরোলজিস্ট অনুসন্ধান বসু ভাইরাসের বিচিত্র আচরণ নিয়ে বক্তব্য রাখলেন।

 “পরিবেশ এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবার জন্য ভাইরাস অতিদ্রুত তার রূপ পাল্টায়। উদ্দেশ্য  জীব কোষের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য নিজেকে উপযুক্ত করা। জীব কোষ অন্যদিকে নিজেকে পরিবর্তিত করে এমন ভাবে যাতে ভাইরাসের পরিবর্তন বিফলে যায়। এই দ্বন্দ্ব প্রকৃতির নিজস্ব ছন্দ। এর ফলে অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে ভাইরাসকে বাধার সন্মুখীন হতে হচ্ছে। এই নিজেকে পাল্টে ফেলার প্রক্রিয়া বা বিবর্তনে জীব কোষ খানিকটা দুর্বল। ভাইরাসের বিবর্তনের গতি জীব কোষের থেকে অনেকটাই বেশি। অতএব,এই প্রতিযোগিতায় জীব কোষের পরাজয় নিশ্চিত।এই নিশ্চিত পরাজয় এড়ানোর জন্য জীব কোষ বহুরূপতার আশ্রয় নেয়। মানুষের ক্ষেত্রে বহুরূপের নানান রূপ রক্তর গ্রুপ(A,AB,B,O এবং Rh +,-), প্রজাতি,ভৌগলিক অবস্থান জনিত পার্থক্য ইত্যাদি। এর ফলে স্পষ্টতই ভাইরাস সঠিক দেহ কোষ নির্বাচন করতে বাধা পায়।ফলে সংক্রমণের গতি শ্লথ হয়ে যায়। কোভিড-১৯ সংক্রমণের সময় রক্তের গ্রুপের সঙ্গে সংক্রমণের হারের সম্পর্কটি নজরে এসেছে। দেখা গেছে যে, যে সমস্ত মানুষের রক্তের  গ্রুপ A,AB,B তাদের কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার O গ্রুপের থেকে বেশি।অর্থাৎ কোভিড-১৯ ভাইরাসের মিলনের জন্য যে ধরনের জীব কোষ দরকার তা A,AB,B গ্রুপের রক্ত বহনকারীর দেহে বেশি পাওয়া যায়। আরও জানা গেছে যে Rh(+) হলে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। হলডেন বলছেন, “অধিকাংশ প্রজাতি রোগ প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে জিনগত বৈচিত্র্য বহন করে। ভাইরাসের অতি দ্রুত বিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা-দিতে অপারগ বলেই জীব-কোষকে জিনগত বৈচিত্র্য সৃষ্টির কৌশল অবলম্বন করতে হয়। প্রজাতির নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই এই লুকোচুরি খেলা।”

“ঠিক এখানেই লুকিয়ে আছে ভাইরাস মারণাস্ত্রর আসল চাবি কাঠি।” বললেন এলিজা। “এত বিপুল জনসংখ্যা,এখানে বেছে বেছে নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠীকে হত্যা করা প্রায় অসম্ভব। মনে পরে হিটলারের ইহুদি নিধন কান্ড। সেরকম পদ্ধতি আজ অচল। ভাইরাসের পছন্দের নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে বিশেষ ধরনের ভাইরাস সংশ্লেষণ করে জনবসতিতে ছড়িয়ে দিলে সেই ভাইরাস শুধু নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকেই সংক্রমিত করবে সকলকে নয়। অন্যান্য প্রাণী থেকে শুরু করে কিছু কিছু জনগোষ্ঠীর ওপরেও পরীক্ষা চালান হয়। অধ্যাপক অনুসন্ধান বসুকে অসংখ্য ধন্যবাদ তাঁর অসামান্য তদন্তের জন্য যা অতিবড় গোয়েন্দাকেও হার-মানায়।

এই প্রসঙ্গে একটি জরুরী ঘোষণা করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করব। ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলের সুযোগ্য পুত্র জোসেফ মেঙ্গেলের রাভেনসব্রুকের গবেষণাগারটি জার্মান সরকার সম্ভবত বাজেয়াপ্ত করেছে। আমরা পরিকল্পিত ভাবেই জোসেফ মেঙ্গেলের অনুপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি করে নিয়েছি।”   

এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিলেন জোসেফ মেঙ্গেলে। রুদ্রমূর্তিতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। “আপনাদের চরম শাস্তি পেতে হবে। এখানে যারা উপস্থিত আছেন তাদের সকলকেই ভাইরাসের সংক্রমণে মরতে হবে।”

“এরকম যে কিছু একটা হতে পারে সেটা আমাদের হিসেবের মধ্যেই ছিল। আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই আপনার ভাইরাস পূর্ণ স্প্রে গানটি পুলিশ ইতিমধ্যেই পাল্টে দিয়েছে। আর আপনার আসল স্প্রে গানটি পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে। আসল স্প্রে গানটি আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।”

এলিজা বসলেন। সভাগৃহে প্রবেশ করল পুলিশ।

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb