ওরা সবাই গনিতজ্ঞ

লেখক - দ্য ম্যথমেটিসিয়ানস – আর্থার ফেল্ডম্যান

 

অনুবাদ: রুদ্র দেব বর্মন



সবুজ, গাঢ় সবুজ, ফিকে সবুজ, আর সম্ভবত আরও যত রকমের সবুজ হতে পারে সেই সমস্ত সবুজের মধ্যে বেনীআসহকলা’র সব কটা রঙের ফুলের বাহার চারদিকে। বিশাল এলাকা জুড়ে এই বাগান। সবাই মিলে তখন ওরা সেই বাগানে। গাছে গাছে পাখির দল ডাকছে। উড়ে যাচ্ছে। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি, মৌমাছি, আরও বিভিন্ন পতঙ্গের দল। ফুলের সৌরভে চারদিক ম’-ম’ করছে।

জুঁই ছুটে বেড়াচ্ছিল চারদিকে। জিনিয়া ভট্ট তার ন’বছরের মেয়েকে আটকালেন। “জুঁই, জুঁই, আর হুটোপাটি করতে হবেনা। এখানে এসে বসো, তাহলে বাবা তোমাকে একটা গল্প শোনাবে।”

গল্পের নাম নিতেই জুঁই দৌড়ে চলে এল। পা ঝুলিয়ে হ্যামকে বসে বাবার দিকে ঝুঁকে পড়ল। “সত্যি গল্প না বানানো গল্প, বাবা?”

“আমি তোমাকে এখন যে গল্পটা বলব সেটা একদম সত্যি গল্প। এই ঘটনা ঠিক এই রকম ভাবেই তখন ঘটেছিল”, জুঁই-এর গোলাপী টোপা টোপা গাল টিপে একটু আদর করে নিলেন সত্যেন ভট্ট। “মন দিয়ে শোনো এবার: যে ঘটনার কথা বলে শুরু করছি সে সব ঘটেছিল অনেক, অনেক দিন আগে। তা ধরো, আজ থেকে ঠিক দু’হাজার এগারো বছর আগে। সে সময় পৃথিবীতে যে ধরনের ক্যালেন্ডার চালু ছিল সেই হিসেবে সেটা ছিল উনিশশো পঁচাশি। সেই বছরই এই গল্পের শুরু। তুমি সিরিয়াস নক্ষত্রের নাম শুনেছ তো? ওটাকে তখনকার মানুষ কেউ লুব্দ্ধক, তো কেউ আবার কুকুর-পাগল-করা নক্ষত্র বলেও উল্লেখ করত।”

“কেন, বাবা? একটা নক্ষত্র অত দূর থেকে কীভাবে কুকুর-দের পাগল করবে?”

“আসলে হয়েছে কি, আরও অনেক প্রাচীন কালে যখন মানব সভ্যতা সবে উন্নত হতে শুরু করেছে তখন পৃথিবীতে রোম বলে একটা দেশ ছিল। সেখানকার মানুষেরা মনে করত যে এই নক্ষত্রের তাপের প্রভাবেই গ্রীষ্মকালে কুকুর পাগলা হয়ে যায়। সেটাই লোককথা হিসেবে চলে আসছিল। তো, সেই উনিশশো পঁচাশি সালে সেই কুকুর-পাগল-করা নক্ষত্র - সিরিয়াসের প্রাণীদের মধ্যে কোনও এক প্রজাতি পৃথিবী আক্রমণ করে বসল।”

“ও বাবা, তাই নাকি? ঐ প্রাণীরা দেখতে কেমন ছিল বাবা?”

“প্রায় মানুষের মতই বলতে পারো। মোটামুটি সব দিক থেকেই প্রায় একরকম বলা যেতে পারে। তাদেরও সবার দুটো করে হাত আর দুটো করে পা ছিল। এমনকি তাদের শরীরের বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোও ছিল আকারে প্রকারে সব মোটামুটি পৃথিবীর মানুষদের মতই।”

“সেই নক্ষত্র-জীব আর পৃথিবীর মানুষের মধ্যে কী কোনওই পার্থক্য ছিল না, বাবা?”

“ছিল তো! নবাগতদের প্রত্যেকের কাঁধের কাছে ছিল সবুজ পালকে ঢাকা এক জোড়া করে পাখনা আর ছিল লম্বা লম্বা বেগুনী রঙের লেজ।”

“ওরা ক’জন এসেছিল, বাবা?

“ঠিকঠাক হিসেব হচ্ছে তিরিশ লক্ষ একচল্লিশ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আর তিন জন প্রাপ্তবয়স্কা নারী। এই সাইরাসিয়ানরা পৃথিবীতে প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল সার্ডিনিয়া দ্বীপে। আর আবির্ভাবের মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে তারা গোটা পৃথিবীটারই মালিক হয়ে গিয়েছিল।”

“কীভাবে? পৃথিবীর বাসিন্দারা কোনও বাধা দেয়নি? কোনও লড়াই করে নি, বাবা?

“হ্যাঁ, তা আবার করেনি! করেছিল তো। আক্রমণকারী আগন্তুক জীবদের বিরুদ্ধে মানুষ জান-প্রাণ বাজী রেখে, তাদের যাবতীয় গোলা-বারুদ, বোমা, অতিকায় পরমাণু বোমা আর গ্যাসীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তুমুল যুদ্ধ করেছিল।”

“ওগুলো সব কী জিনিষ বাবা?”

“তুমি অস্ত্রশস্ত্র কাকে বলে জানো না জুঁই? ওঃ হো! তাই তো। আমারই দোষ, ওসব জিনিস তো দুনিয়া থেকে বহু দিন হল হারিয়ে গিয়েছে। ওসব তো কেউ এখন আর ব্যবহার করেই না। তবে তখন ওগুলোর খুব চল ছিল – তখনকার মানুষ ঐ সব গোলা-বারুদ, বোমা-টোমা এই সব গুলোকেই বলতো ‘অস্ত্রশস্ত্র’। আর এই সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মানুষেরা নিজেদের মধ্যেই যত সংঘাত সংঘর্ষ মারামারি খুনোখুনি করত তখনকার সেই সব দিনে।”

“ও ...  মানে, এখন যেমন মাঝে মাঝে বিভিন্ন আদর্শ কিংবা ধারণার মধ্যে সংঘাত হয়ে থাকে সেই রকম কিছু, নাকি একদম অন্যরকম কিছু ছিল সেটা?”

“না, না, আজকালকার মতো এরকম অহিংস সংঘাত নয়। বরং যেমন বললাম, সেই যুগের লড়াই গুলো হত গোলা-বারুদ আর বোমা দিয়ে। সে সব ছিল ভয়ংকর হিংস্র ব্যাপার-স্যাপার। তবে মানুষের দূর্ভাগ্য ঐ সব গোলা-বারুদ আর বোমা জাতীয় অস্ত্রশস্ত্রের বিন্দুমাত্র ক্ষমতা ছিল না আগন্তুক হানাদারদের কোনও ক্ষতি করে। আসলে ঐ ধরনের অস্ত্রশস্ত্রের পক্ষে আগন্তুকরা ছিল অনাক্রম্য।”

“‘অনাক্রম্য’ মানে কী বাবা?”

“কোনও কিছুর বিরুদ্ধে সুরক্ষিত থাকা – দেখা গেল গোলা-বারুদ, বোমা বা ঐ রকম কোনও অস্ত্র হানাদারদের কোনও ক্ষতি করতে পারছে না। অবিশ্যি পারার কথাও ছিল না। সে যা হোক, না পেরে তখন মানুষ আগন্তুক নাক্ষত্রিক হানাদারদের উপরে প্রয়োগ করল জীবাণু আর ব্যাকটেরিয়া।”

“সেগুলো আবার কী জিনিস?”

“খুব ছোট্ট ছোট্ট, খালি চোখে দেখা যায় না এমন সব পোকা বলে আপাতত ধরে নাও। মানুষ নানান চেষ্টা করল হানাদারদের শরীরে সেগুলো ইনজেকশন করে ঢুকিয়ে দেওয়ার। উদ্দেশ্য ছিল যাতে হানাদাররা অসুস্থ হয়ে মারা যায়। কিন্তু সেবারও দেখা গেল নাক্ষত্রিকদের উপর মোটেও কোনও প্রভাব পোকাগুলো ফেলতে পারল না।”

“বুঝে গেছি বাবা। তার মানে মানুষের সব অস্ত্রই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। আর সেই আগন্তুক প্রজাতি তখন গোটা পৃথিবী দখল করে নিল। তাই তো? তারপর কী হল সেটা বল।” জুঁই দেখা যাচ্ছে অধৈর্য হয়ে উঠেছে।

“একটা জিনিষ খেয়াল রেখো জুঁই, যে এই নবাগত নাক্ষত্রিক জীবেরা কিন্তু পৃথিবীর অধিবাসী যে কোনও মানুষের চেয়ে অনেক অনেক বেশি বুদ্ধিমান। তাছাড়াও সব থেকে বড় কথা হচ্ছে যে, এই আক্রমণকারী জীবেরা ছিল এই নক্ষত্র জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ।”

“কোন নক্ষত্র জগতের বাবা? আর গনিতজ্ঞ মানেই বা কী?”

“নক্ষত্র জগত বলতে আমাদের এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। আর গণিতজ্ঞ বলা হয় তাদের, যারা হিসেব-নিকেস, পরিমাণ আর পরিমাপ বিষয়ে দূর্দান্ত বিশেষজ্ঞ একজন তো হবেনই তার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই হবেন সংখ্যার জাদুকর।”

“ও!, তো বাবা, এই হানাদার গনিতজ্ঞেরা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর সবাইকেই তারপর মেরে ফেলল?”

“না, না। সবাইকে না। তবে যাদের মেরে ফেলা হল তাদের সংখ্যা অনেক বিশাল। আর যাদের মারা হল না , তাদের আসলে দাস বানিয়ে রেখে দেওয়া হল। মানুষ যেভাবে গরু ঘোড়া জাতীয় প্রানীদের খামার বানিয়ে তাদের এতকাল ব্যবহার করে এসেছিল, এই নবাগতরাও তেমনি মানুষকে দাস বানিয়ে ব্যবহার করতে শুরু করে দিল। শক্ত-পোক্তদের মানুষ গুলোকে শ্রমিক হিসেবে আর বাকিদের খামারে জমিয়ে রেখেছিল খাবার হিসেবে। যখন যেমন প্রয়োজনে জবাই করে খেলেই হল!”

“কী ভয়ংকর! হ্যাঁ বাবা, ঐ নক্ষত্র-জীবেরা নিজেদের মধ্যে কী ভাষায় কথা বলত?”

“ভাষা? সেটা তো ছিল খুবই সহজ সরল। কিন্তু মানুষ সেটা কিছুতেই ঠিকঠাক শিখে উঠতে পারল না। উলটো দিকে, আগন্তুক হানাদাররা যেহেতু ছিল অনেক বেশি বুদ্ধিমান, তাই পৃথিবীর যাবতীয় ভাষা তারা খুব তাড়াতাড়ি দারুণ ভাবে আয়ত্ত করে নিল।”

“বাবা, মানুষরা এই হানাদারদের কী বলে উল্লেখ করত?”

“অদ্ভুত একটা শব্দ-বন্ধ তৈরি করেছিল মানুষেরা ঐ গ্রহান্তরের জীবদের জন্য। ‘ফের্তান’ বা ‘ফেরে-তান’। আধা ফেরেশতা, আধা শয়তান।”

“তো এই ফের্তানরা যখন বেঁচে থাকা মানুষদের সব দাস বানিয়ে ফেলল, তখন পৃথিবীর মানুষরা কোনও ঝামেলা করল না? সবাই চুপচাপ নাক্ষত্রিকদের দাসত্ব মেনে নিয়ে শান্ত হয়ে বসে রইল?”

“না, না। যদিও তাৎক্ষণিক ভাবে কিছুদিনের জন্য মনে হয়েছিল সবাই বোধহয় ব্যাপারটা ভবিতব্য বলে মেনেই নিয়েছে। তবে ঘটনা সেটা ছিল না। ভেতরে ভেতরে ছাইচাপা একটা আগুন জ্বলছিলই। শুধু বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। গ্রহান্তরের জীবেরা তাই ধরে নিয়েছিল যে সবাই বোধহয় সব কিছু মেনে নিয়েছে। তারপর, হঠাৎ একদিন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হল। দুঃসাহসী একদল মানুষ মাও জিয়াং নামে একজনের নেতৃত্বে দাসত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে তাকলামাকানের গভীরে পালিয়ে গেল। এই মাও জিয়াং নামের মানুষটি ছিলেন তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাইকো-হিস্ট্রিয়ান।”

“’সাইকো-হিস্ট্রিয়ান’ মানে কী বাবা?”

’সাইকো-হিস্ট্রিয়ান হচ্ছে এমন একজন মানুষ যিনি সাইকো-হিস্ট্রি বিষয়ে কাজ করেন। তুমি হয়তো এবার জিজ্ঞেস করবে সাইকো-হিস্ট্রি কী? আগেই বলে রাখি, এটা হল মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস আর সেই সম্পর্কিত সামাজিক বিজ্ঞান আর মানবিকতার একটা সংমিশ্রণ। এটা ইতিহাসের “কেন” অংশ পরীক্ষা করে, বিশেষ করে ইতিহাসের ‘বিবৃত’ উদ্দেশ্য আর প্রাণী জগতের বাস্তব আচরণের মধ্যে যা কিছু পার্থক্য হয় বা হতে পারে, সেই সব কিছু পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের সাহায্যে নির্ণয় করে, আর সেই সঙ্গে তার বিভিন্ন সম্ভাব্য সমাধান গাণিতিক পদ্ধতিতে নির্ধারণ করে।”

“আচ্ছা, তার মানে মাও জিয়াং নামের মানুষটা তাহলে অনেক উঁচু দরের মানুষ ছিলেন, তাই না বাবা?”

“হ্যাঁ, জুঁই। উনি সেই সময়কার পৃথিবীর সম্ভবত সবচেয়ে বড় মাপের মানুষ ছিলেন। বহু গভীর চিন্তাভাবনার পর শেষ পর্যন্ত ফের্তানদের কবল থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার একটা উপযুক্ত উপায় তিনি খুঁজে বের করেছিলেন।”

“সেটা কী ছিল, বাবা?”

“পরিসংখ্যান আর সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে সাইকোহিস্ট্রির তত্ত্ব আর বিশ্লেষণী শক্তি ব্যবহার করে তিনি একটা নিখুঁত পদ্ধতি খুঁজে বের করেছিলেন, সভ্যতার ইতিহাসে যেটাকে পরে বলা হয়েছে মাও-হিউজ আর সারাভাই পদ্ধতি। অদ্ভুত এবং অসম্ভব মৌলিক একটা পদ্ধতি। যা ব্যবহার করে ফের্তান-দের ‘অনুপ্রাণিত’ করা হয়েছিল। ‘অনুপ্রাণিত’ ফের্তান-দের সিরিয়াস্তানি মানসিকতায় মানবিক আবেগের বুজকুড়ি কাটতে শুরু হয়ে গিয়েছিল।”

“‘অনুপ্রাণিত’ করে? তার মানে কী? কীভাবে সেটা করা হয়েছিল? ”

“বললাম না যে সে এক অতি চমৎকার পদ্ধতি। যত রকমের সামাজিক মাধ্যম আর তথ্য আদান-প্রদানের আন্তর্জাল সেই সময়ে চালু ছিল, তাদের সব গুলোতে অসংখ্য ফেক আইডি তৈরি আর আরো অসংখ্য আসল আইডি হ্যাকিং করে সেই গুলোতে অর্ধ-সত্য আর দৃষ্টিনন্দন মিথ্যের বানানো গল্পের ঝড় এমন ভাবে মাও জিয়াং আর তার দলবল তুলে দিয়েছিল যে অনায়াসেই ফের্তান-দের গরিষ্ঠ অংশ তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে মানবিক আবেগগ্রস্ত হয়ে পড়তে শুরু করে।”

জিনিয়া বাধা দিলেন। “সত্যেন, এসব তোমার কী রকম ব্যাখ্যা? এ সব তো বাচ্চাদের মাথার উপর দিয়ে চলে যাবে। জুঁই তো নিশ্চিত কিছুই বুঝতে পারছে না, তাই না জুঁই?”

জুঁই কিন্তু ঠিকই বুঝতে পেরেছে। গল্পের স্রোতে বাধা পড়তে একটু যেন বিরক্ত। বাবাকে সমর্থন করে বলে ওঠে, “না, মাম্মা, আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। তুমি বাবাকে বলতে বাধা দিওনা।”

সত্যেন জুঁইকে কোলে তুলে নিলেন। জুঁই-এর গোলাপী ফোলা ফোলা টুপলু গাল দুটোতে চকাস চকাস করে দুটো হাম্পা দিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, “তো এইভাবে ফের্তান-দের অনুপ্রাণিত করে তাদের মনের ভেতর যতোরকমের মানবিক আবেগ আছে যেমন ধরো, প্রেম, ভালোবাসা, ঘৃণা, উচ্চাকাঙ্খা, ঈর্ষা, বিদ্বেষ, হিংসা, হতাশা, আশা, ভয়, লজ্জা ইত্যাদি ইত্যাদি, সব গুলো মাও আর তার দলবল ঢুকিয়ে দিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফের্তানদের আচার আচরণে দেখা গেল আমূল একটা পরিবর্তন। কয়েকদিনের মধ্যেই ফের্তান-রা ঠিক মানুষদের মতোই ব্যবহার করতে শুরু করল, আর মাত্র দশ দিনের মাথায় ফের্তান সমাজে শুরু হয়ে গেল এক ভয়ানক আভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ। সেই গৃহযুদ্ধের নবাগত ফের্তান-দের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।”

“তার মানে ফের্তান-রা সবাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করেই খতম হয়ে গিয়েছিল?”

“সবাই না। তবে অনেকেই। হয়তো একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত, যদি না ঠিক সেই সময়ে জ়ালিবার বলে ফের্তান-দের একজন সন্ন্যাসী প্রচারক আবির্ভূত হতেন। সেই নিশ্চিত ধ্বংসের সময়ে তিনি যখন ফের্তানদের উদ্দেশ্যে সমগ্র ফের্তান-ভ্রাতৃত্বের ডাক দিলেন তখন সেই ডাকে আভ্যন্তরীণ হানাহানিতে বীতশ্রদ্ধ ফের্তানরা দলদলে তার ছত্রচ্ছায়ায় জড়ো হয়ে ধর্মান্তরিত হতে শুরু করেছিল। ইতিহাস পুরোটা লেখে না। তবে এইটুকু লেখা আছে যে ফের্তানরা এইভাবে যেদিন থেকে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বন্ধ করল, সেই দিন থেকে পার্থিবরা আরও বেশি বেশি সংখ্যায় দাসত্ব শৃঙ্খলায় আবদ্ধ হতে শুরু করল।”

“এম্মা! যেভাবে সব বরবাদ হয়ে গেল তাতে তো গ্রীনল্যান্ডে লুকিয়ে থাকা মাও আর তার দলবল নিশ্চয়ই খুব দুঃখ পেয়ে ছিল। তাই না, বাবা?”

“সাময়িক ভাবে তো বটেই। তবে তারপরেই মাও তার তুরুপের তাসটা আস্তিনের ভেতর থেকে বের করে আনল।”

“তুরুপের তাস? সেটা আবার কী বাবা?”

“হুম, মাও তার হাতের টেক্কা খানা বোধহয় এইরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা হিসেব করেই আস্তিনে লুকিয়ে রেখেছিল। যদি সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় তবে শেষ মুহূর্তে একটা চরম আঘাত হানার জন্য সেটাই ছিল তার শেষ অস্ত্র।”

“আচ্ছা। বাবা, আমি মনে হয় বুঝতে পেরে গেছি। মানে সব পরিকল্পনা গড়বড় হয়ে গেলেও যাতে মাও ঐ শেষ চালেই কিস্তি মাত করতে পারেন, তাই তো? মাও কী চাল চেলে ছিলেন , বাবা?”

“এটাও মাওয়ের আরো একটা অদ্ভুত মৌলিক চাল। মাও ফের্তানদের মধ্যে নতুন এক অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে দিলেন। আর অনুপ্রাণিত ফের্তান-রা তখন আক্রান্ত হল নস্টালজিয়ায়!”

“নস্টালজিয়া কী, বাবা?”

“এমনিতে খুব সাধারণ একটা অনুভূতি। পুরোটাই স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন জীবদের অতীতের স্মৃতি নিয়ে খেলা। প্রধানত বাড়ির বা অতীতের কোনও সুখ স্মৃতি নিয়ে আকুলতা।”

“তাই?”, জুঁই যেন কিছু ভাবছে। “বাবা, ঐ মাও নামের মানুষটা তো তারমানে সত্যিই দারুণ বুদ্ধিমান ছিলেন, তাই না? তার এই এক চালে সমস্ত ফের্তান-দের মধ্যে নিজস্ব নক্ষত্র লোকে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে জেগে উঠেছিল, তাই না?”

“ঠিক ধরেছ তুমি জুঁই। তুমিও তো দেখছি  দারুণ বুদ্ধিমান! একদম ঠিক ধরেছে। ঐ এক চালে সমস্ত ফের্তান-রা, তাদের বিশাল সেনাবাহিনী সহ, তাদের দুর্দান্ত সবুজ ডানা ঝাপটিয়ে মধ্য ভারতের বিন্ধ্য পর্বতের চ্যাটালো চূড়ায় একদিন একত্রিত হল। আর, তারপর, দলনেতার একটি মাত্র সংকেতে, তারা সেখান থেকে সোজা উড়ে গিয়েছিল তাদের মাতৃ নক্ষত্রের দিকে। তখন পৃথিবীর সমস্ত মানুষেরা বিজয়গৌরবে দু হাত তুলে লাফাচ্ছে, মুক্তির উল্লাসে নাচছে, গাইছে।”

“ও বাবা, তাহলে সব ফের্তান-রা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল?”

“উঁহু, সবাই না। থেকে গিয়েছিল দুটি বাচ্চা ফের্তান। একটা ছেলে বাচ্চা, আর একটা মেয়ে বাচ্চা। ওদের তখন বয়স মাত্র দু’বছর। ওরা দুটিতেই জন্ম গ্রহণ করেছিল এই পৃথিবীর মাটিতে। ওরাও ওদের দলের সঙ্গে বিন্ধ্য পর্বতের চূড়া থেকে তাদের ছোট্ট ছোট্ট দু’জোড়া ডানা ঝাপটিয়ে উড়ান শুরু করেছিল। কিন্তু পৃথিবীর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের উপরের সীমানায় পৌঁছেই ওরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে লেজ ঘুরিয়ে নেমে আবার এসেছিল এই পৃথিবীর বুকে। আসলে ওদের দুজনের জন্মই তো এই পৃথিবীর বুকে। এটাই তো তাদের মাতৃগ্রহ। তাদের নাম ছিল জিজ্জো আর জিজ্জা।”

“ও মা! তাই নাকি? তো সেই জিজ্জো আর জিজ্জার তারপর কী হল, বাবা?”

“হুম! কী আর হবে! সব ফের্তান-দের মতই ওরাও ছিল দুর্দান্ত গনিতজ্ঞ। সংখ্যা রহস্য ওরাও ভালোই জানত। সংখ্যা বৃদ্ধির রহস্য-ও। সুতরাং ওরা গুনোত্তর প্রগতিতে বেড়ে চলল!”

“ওহ, বাবা,” জুঁই খিলখিল করে হেসে উঠল, যেন খুব আনন্দ পেয়েছে এমন ভাবে উত্তেজিত হয়ে তার সবুজ কচি ডানা দুটো ঝাপটাতে শুরু করল। “এটা সত্যিই খুব সুন্দর একটা সত্যি গল্প, বাবা!”

সূচিপত্র

কল্পবিজ্ঞান

গল্পবিজ্ঞান

বিজ্ঞান নিবন্ধ

পোড়োদের পাতা


Copyright © 2011. www.scientiphilia.com emPowered by dweb