একজন বিজ্ঞানীর জীবনে অনেকগুলো বিষয় তাঁর মর্যাদা নির্ধারণ করতে পারে। অসামান্য অবদানের ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কারের কদর এখনও সবথেকে বেশি। পরের ধাপে কোন পুরস্কার জায়গা পাবে তা চিহ্নিত করা কঠিন তবে বিশ্বখ্যাত কিছু সোসাইটির ফেলো হওয়া নিঃসন্দেহে সম্মানের। এর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটি। যতই বলা হোক যে কাজটাই বড় কথা, উপযুক্ত সম্মানে ভূষিত না হলে পূর্ণতা আসে না সফল বিজ্ঞানীর জীবনে। চিকিৎসক ও চিকিৎসা-গবেষক উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনেও কথাটা সত্যি। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তাঁর অপ্রাপ্তির ক্ষেত্রগুলো, আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত না হওয়ার কষ্ট।
মনোনয়ন
১৯৪১ সালে রয়্যাল সোসাইটি যাঁদের ফেলো হিসাবে নির্বাচন করে তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী – হোমি জাহাঙ্গির ভাবা।১ এই বছরেরই ২৩ জুন সোসাইটিতে জমা পড়েছিল অন্য এক বিশিষ্ট ভারতীয়র মনোনয়ন, তিনি উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। এই কাজে একজন প্রস্তাবক এবং সমর্থক থাকতে হয়, ইংরেজিতে বলা হয় প্রোপোজার এবং সেকেণ্ডার। প্রথম ভূমিকা পালন করেছিলেন স্যার জন লায়োনেল সাইমনসেন এবং সমর্থক হন মেঘনাদ সাহা।২ সাইমনসেনের সঙ্গে ভারতের যোগ ছিল বিস্তৃত, বিবিধ ভূমিকায় তাঁকে পেয়েছে এই দেশ। মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি পড়াতে আসেন ১৯১০ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯১৪ সালে ইণ্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নেন তিনি। ১৯২৬ সাল অবধি এই প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন সাইমনসেন। দেরাদুনের ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অ্যাণ্ড কলেজের চীফ কেমিস্ট পদে তিনি ছিলেন ১৯১৯ থেকে ১৯২৫ অবধি। ব্যাঙ্গালোরের ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে অধ্যাপনা করেন ১৯২৫ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত। এর পর দেশে ফিরে গিয়ে লণ্ডনের গাইজ হসপিটালে কাজ করেন সাইমনসেন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৫২ – এই সময়টা তিনি কলোনিয়াল প্রোডাক্টস রিসার্চ কাউন্সিলের অধিকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। প্রকৃতিজাত পদার্থের রসায়ন ছিল সাইমনসেনের কাজের ক্ষেত্র। রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ তিনি লাভ করেন ১৯৩২ সালে।৩ মেঘনাদ সাহা রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হন ১৯২৭ সালে। অর্থাৎ সোসাইটির নিয়ম মেনে দু’জন ফেলোর সুপারিশ সহ পৌঁছল মনোনয়নপত্র। তবে একইসঙ্গে দেশী এবং বিদেশী আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী তাঁদের সমর্থনের স্বাক্ষর জুড়ে দিলেন মনোনয়নপত্রের সঙ্গে। ভারতীয়দের মধ্যে ছিলেন কে এস কৃষ্ণাণ (১৯৪০) এবং বীরবল সাহ্নি (১৯৩৬)। বিদেশিদের মধ্যে ছিলেন চিকিৎসক ও পরজীবী-বিশারদ জন উইলিয়াম ওয়াটসন স্টিফেন্স (১৯২০), রসায়নবিদ ফ্রেডেরিক জর্জ ডোনান (১৯১১), ভূতাত্ত্বিক লুই লে ফার্মর (১৯৩৪), সামরিক বিভাগের চিকিৎসক রবার্ট বেরেসফোর্ড সিম্যুর সিওয়েল (১৯৩৪), জন চার্লস গ্রান্ট লেডিংহাম (১৯২১), রসায়নবিদ চার্লস স্ট্যানলি গিবসন (১৯৩১)।৪ বন্ধনীতে প্রত্যেক বিজ্ঞানীর রয়্যাল সোসাইটিতে ফেলো হওয়ার সাল রয়েছে।৫ এঁদের মধ্যে ডোনান গিবসন ও লেডিংহাম সাধারণভাবে জ্ঞাত তথ্য থেকে বা ‘ফ্রম জেনারেল নলেজ’ সমর্থন করেছিলেন মনোনয়ন। ডোনান বাদে প্রত্যেক বিজ্ঞানীরই ভারতে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল, তাঁরা জানতেন এদেশের অবস্থা এবং চিকিৎসা-গবেষণার চিত্রটা। এই পুরো উদ্যোগটা নিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা। আগের বছর অর্থাৎ ১৯৪০ সালেও তিনি চেষ্টা করেছিলেন সময়সীমার মধ্যে মনোনয়নপত্র পাঠানোর কিন্তু সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে নি নানা কারণে।৬
অবদান
মনোনয়নপত্র পাঠানোর জন্য প্রার্থীর অবদান সম্পর্কে তথ্য দিয়ে লিখতে হয় উপযুক্ত পরিসরে। কীভাবে সেটা লেখা হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনার আগে স্পষ্ট করে জেনে নেওয়া যাক যে উপেন্দ্রনাথের অবদানের জায়গাটা কোথায়। এ নিয়ে তো কোনও দ্বিধা থাকতে পারে না যে কালাজ্বরের ওষুধ তৈরি করাই তাঁর সবথেকে বড় অবদান।তবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে কোনও কিছুই আচমকা ঘটে নি, প্রত্যেক আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের প্রেরণা এসেছে পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে। তাই এরলিক, রজার্স, নেপিয়ার প্রমুখদের কাজের ধারাটা অনুসরণ করতে হবে। ম্যালেরিয়া রোগ সারাতে ব্যবহৃত হয় কুইনাইন, কালাজ্বরের ক্ষেত্রেও কি ব্যবহার করা যায় না সেটা? অনেক চিকিৎসকই চেষ্টা করেছিলেন এই পথটা খতিয়ে দেখতে। ম্যালেরিয়ার পরজীবী ফ্যালসিপেরাম এবং কালাজ্বরের পরজীবী লিশম্যানিয়া ডোনোভানি, দুটোই হল প্রোটোজোয়া। সুতরাং একটা প্রোটোজোয়ার বিরুদ্ধে যা কার্যকর তা অন্য প্রোটোজোয়াকেও ঘায়েল করবে, এমন ভাবাটা বিজ্ঞানীর কাছে ভিত্তিহীন নয়। ১৯০৭ সালের মার্চে, ল্যান্সেটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে, কালাজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার শুরুতেই রোগীকে ভারী মাত্রায় কুইনাইন খাওয়ানোর কথা বলেন লেনার্ড রজার্স। তাঁর মতে, এতে রোগ সেরে না গেলেও জ্বরের তীব্রতা বা বারবার জ্বর ফিরে আসার ব্যাপারটা কমবে। তবে এই নিয়ে পরীক্ষার ফল উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন যে পঁচাত্তর শতাংশ ক্ষেত্রে এটা ব্যর্থ হয়েছে, সাফল্য কেবল বাকি অংশে। রজার্সের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যান ডাক্তার ম্যুইর, তিনি কুইনাইন সালফেটের আন্তঃপেশী (intramuscular) ইঞ্জেকশন দেওয়ার নিদান দেন স্বল্পমাত্রায়। এরই সঙ্গে ব্যথা কমাতে কোকেনের ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। কৃষ্ণনগরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন সরসী লাল সরকার ১৯১৫ সালে জানিয়েছিলেন যে মুখে কুইনাইন খাওয়ার তুলনায় স্বল্পমাত্রায় কুইনাইনের এই ইঞ্জেকশন দেওয়ার চিকিৎসা অনেক বেশি কার্যকর।৭ তবে কুইনাইন খুব বেশি সাফল্য এনে দেয় নি চিকিৎসকদের। ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ও আরও কয়েকজন চিকিৎসক প্রমাণ করে দেখান যে কুইনাইন ব্যবহারে উপকারের সম্ভাবনা সামান্য, ক্ষতির আশঙ্কা অনেকটাই। কালাজ্বরের চিকিৎসায় রক্তের শ্বেত কণিকার সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছিল এই কথা ভেবে যে রোগজীবাণু দমনের দায়িত্ব পালন করে এই কণিকা। সুতরাং শ্বেত কণিকা বাড়লে নাশ হতে পারে কালাজ্বরের পরজীবী। কেউ-কেউ রোগীর শরীরে পুষ্টির যোগান বাড়িয়ে আটকাতে চেয়েছিলেন রোগকে। পারদের ব্যবহার নিয়েও আগ্রহী ছিলেন অনেকে। তবে এর কোনওটাই তেমন কার্যকর হয়ে দেখা দেয় নি।৮
ওষুধ হিসাবে অ্যান্টিমনির ব্যবহার প্রচলিত বহু দিন ধরে। এ সম্পর্কে যে কাহিনী চালু আছে তার প্রধান চরিত্র পঞ্চদশ শতকের এক যাজক বেসিল ভ্যালেন্টাইন। তিনি অ্যান্টিমনির গুঁড়ো ছুঁড়ে ফেলেছিলেন জানালা দিয়ে, সেটা খেয়ে নিয়েছিল কিছু শুয়োর। সেগুলো এর পর বেশ মোটা হতে শুরু করে। তখন অ্যান্টিমনির গুণগান করে বেসিল একটা বই লেখেন যাতে তিনি বলেন যে গরু-ভেড়া-শুয়োর বিক্রি করার আগে কয়েকদিন আগে থেকে অ্যান্টিমনি খাওয়ালে সেগুলো বেশ মোটাসোটা হবে। এতে ভালো দাম পাবেন বিক্রেতা। বেসিল এও ভেবেছিলেন যে তাঁর গীর্জায় উপোস করে কৃশ হয়ে যাওয়া সাধুদের (monk) এই অ্যান্টিমনি খাওয়ালে কেমন হয়! কিন্তু খাওয়ানোর ফলে ক্ষতিই হল সাধুদের, ফলে জিনিসটা পরিচিতি পেল অ্যান্টি-মঙ্ক বা অ্যান্টি-মইন হিসাবে। সেটাই পরে হয়ে দাঁড়াল অ্যান্টিমনি।৯ আসলে এই ধাতু পঞ্চদশ শতকের অনেক আগে থেকেই ব্যবহৃত হত নানা কাজে, যার মধ্যে প্রসাধন ছিল অন্যতম। চোখের উপরের ও নীচের অংশে, রোমের উপর এই ধাতুর যৌগের প্রলেপ লাগিয়ে চোখের সৌন্দর্য বাড়াতেন মহিলা ও সম্ভবতঃ পুরুষরাও। সপ্তদশ শতকে রসায়নবিদ যোহান থোল্ড চিকিৎসায় অ্যান্টিমনির প্রয়োগ নিয়ে প্রথম বইটি লেখেন ‘বেসিল ভ্যালেন্টাইন’ ছদ্মনাম নিয়ে। তিনি সিফিলিস, অবসাদ, বুকের ব্যথা, প্লেগ এবং জ্বর হলে অ্যান্টিমনি ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এর ফলে বাড়তে থাকে এই ধাতুর ব্যবহার। কিন্তু এতে যে বিষক্রিয়া দেখা দেয় মানুষের শরীরে তা দেখে এটা পরে বাতিল করা হয় ইউরোপের অনেক জায়গায়। প্যারিসের ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিন নিষিদ্ধ করে এই ধাতুর ব্যবহার।কলকাতার মেডিকেল কলেজে চিকিৎসক এবং অধ্যাপক লেনার্ড রজার্স অ্যান্টিমনির প্রয়োগ করেন কালাজ্বরের চিকিৎসায়। তিনি বিশুদ্ধ পটাশিয়াম অ্যান্টিমনি টারট্রেট বা টার্টার এমেটিক তৈরি করে রোগীদের শিরার মধ্যে দিয়ে (intravenous) ইঞ্জেকশন দিয়ে সুফল পেলেন। বিংশ শতকে এর আগে বিশ্বের অন্যত্র এই যৌগ দিয়ে চিকিৎসা হয়েছিল বটে তবে রজার্স দাবি করেন যে গবেষণাপত্র বা প্রতিবেদন প্রকাশে কিছুটা দেরি করলেও তিনিই এই প্রয়োগের ব্যাপারে প্রথম।১১ ধাতব অ্যান্টিমনি এবং অ্যান্টিমনি অক্সাইড দিয়ে চিকিৎসা করে ভালো ফল পান নি তিনি, অবশেষে মনযোগ স্থির করলেন টার্টার এমেটিকের উপর। এতে যখন বিভিন্ন বয়সের বেশ কিছু রোগী পরপর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেল তখন নিজের উচ্ছ্বাস আটকে রাখতে পারেন নি রজার্স।১২ তবে কলকাতার আবহাওয়ায় টার্টার এমেটিক যে বিশুদ্ধ অবস্থায় রাখা দুষ্কর তা নিয়েও আক্ষেপ করেন তিনি। সদ্য তৈরি করা দ্রবণেও ঢুকে পড়ে জীবাণু আর তার ফলে বিষক্রিয়ায় মারা যেতে পারে রোগী – এ কথা তাঁরই উল্লেখ করা। উপেন্দ্রনাথ টার্টার এমেটিকের মধ্যে বদল আনলেন, প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণা করে পটাশিয়ামের জায়গায় ঢোকালেন সোডিয়াম, তৈরি হল সোডিয়াম অ্যান্টিমনাইল টারট্রেট। এই নতুন যৌগ দিয়ে চিকিৎসা করে অসমে অত্যন্ত ভালো ফল পাওয়ার ব্যাপারটা নিজের প্রতিবেদনে জানান সেখানকার ডিরেক্টর অফ পাবলিক হেলথ মেজর মুরিসন। এ ব্যাপারে আলোচনা করতে হলে অবশ্য এসে পড়বেন জার্মানির রসায়নবিদ এরলিক।১৩
রাসায়নিক ওষুধের সাহায্যে রোগ নিরাময়ে অসামান্য অবদান রেখে গিয়েছেন পল এরলিক (১৮৫৪-১৯১৫)। অসুখ সারাতে আর্সেনিকযুক্ত যৌগের কার্যকারিতা নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেন তিনি। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল অ্যামিনোফিনাইল আর্সেনিক অ্যাসিড, বাণিজ্যিক নাম অ্যাটক্সিল। বিষক্রিয়া অর্থাৎ টক্সিসিটি আর্সেনিক অ্যাসিডের থেকে কম বলে এরকম নাম দেওয়া হয়েছিল সেই সময়। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই তৈরি হচ্ছিল এই যৌগ, ১৯০৫ সালে এটা ব্যবহৃত হয় স্লিপিং সিকনেসের চিকিৎসায়। এই রোগ মাছি বাহিত প্রোটোজোয়ার কারণে হয় যেগুলোকে বলা হয় ট্রাইপ্যানোসম। রোগ সারাতে কড়া ডোজে দীর্ঘ দিন ধরে প্রয়োগ করতে হত অ্যাটক্সিল, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ক্ষতি হত চোখের স্নায়ুর। সহযোগী গবেষকের সঙ্গে মিলে অ্যাটক্সিলের প্রকৃত গঠন নির্ণয় করেন এরলিক, দেখা যায় যে এটা ফিনাইল আর্সেনিক অ্যাসিডের অ্যামিনো লবণ। এর ফলে চিকিৎসার প্রয়োজনে এই অ্যাসিডের আরও কার্যকরী লবণ বের করার পথ খুলে গেল। ১৯০৭ সালে এরলিক তৈরি করলেন আর্সফিনামিন। যৌগ নম্বর ৬০৬ নামেও পরিচিত ছিল এটা। এই ছিল মানুষের তৈরি প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক। কয়েক বছরের মধ্যেই এর ব্যবহার শুরু হল সিফিলিস রোগের চিকিৎসায়। এদিকে বিংশ শতকের শুরুতে (১৯০৫) আবিষ্কৃত হয় সিফিলিস রোগ ঘটানো ব্যাক্টিরিয়া (Treponema pallidum). এর সঙ্গে ট্রাইপ্যানোসোমের মিল দেখে উদ্ভাবকদের একজন এরলিককে অনুরোধ করলেন আর্সেনিকযুক্ত যৌগকে ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করতে। জাপানি গবেষক সাহাচিরো হাটা এবং এরলিক মিলে পরীক্ষা করে দেখলেন যে সিফিলিসের বিরুদ্ধে ভালো কাজ করছে যৌগ নম্বর ৬০৬। পরে জার্মানির হেক্সট কোম্পানি সালভারসন নাম দিয়ে এটা বাজারে আনে। নামের আক্ষরিক অর্থ – যে আর্সেনিক প্রাণ বাঁচায়।১৪
উপেন্দ্রনাথ অ্যাটক্সিলের মতই কিছু খুঁজছিলেন কিন্তু আর্সেনিকের বদলে অ্যান্টিমনি ব্যবহারে আগ্রহী ছিলেন তিনি। চিকিৎসক ম্যানসন দেখিয়েছিলেন যে কালাজ্বরের পরজীবীর সঙ্গে মিল রয়েছে ট্রাইপ্যানোসোমের। অন্যদিকে আর্সেনিক আর অ্যান্টিমনি পর্যায়-সারণিতে একই সারণিতে থাকার কারণে বৈশিষ্ট্যের মিল ছিল দুটোর মধ্যে। ফলে একটা মৌলের জায়গায় অন্য মৌল ব্যবহারে তাত্ত্বিক বাধা ছিল না। সত্যিই উপেন্দ্রনাথ তৈরি করে ফেললেন এমন যৌগ, নাম দেওয়া হল প্যারাষ্টিবিনিলিক অ্যাসিড। এই অ্যাসিডের সোডিয়াম বা পটাশিয়াম লবণ কালাজ্বরের রোগীর পেশীতে ইঞ্জেকশন করে ঢোকালে রোগের উপশম ভালোমত হলেও রোগীর দেহে শুরু হত মারাত্মক যন্ত্রণা। পরে অনেক ভেবেচিন্তে উপেন্দ্রনাথ বোঝেন যে সোডিয়াম বা পটাশিয়ামের জায়গায় ইউরিয়া ব্যবহার করলে স্নায়ু পীড়িত হবে না, কষ্টবোধ ঘটবেই না রোগীর দেহে। তখন প্যারাষ্টিবিনিলিক অ্যাসিডের সঙ্গে ইউরিয়ার মিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি তৈরি করলেন ইউরিয়া স্টিবামাইন। ক্যাম্বেল হাসপাতালে শুরু হল এই ওষুধের প্রয়োগ। সাফল্য আসতে শুরু করলে এর ব্যবহার শুরু করে দিলেন অন্য চিকিৎসকরাও।১৫ এই উদ্ভাবনের পাশাপাশি উপেন্দ্রনাথের অন্যান্য অবদানও উল্লেখযোগ্য। কালাজ্বর ছাড়াও ম্যালেরিয়া, ব্ল্যাকওয়াটার ফিভার, সেরিব্রোস্পাইনাল মেনিনজাইটিস, ফাইলেরিয়াসিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি রোগ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তিনি। ম্যালেরিয়ার বিশেষ একটা ধরণ যেখানে ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার তিন বা চার দিন পরে তার শরীরে জ্বর দেখা দেয়, সেটা কোয়ার্টান ফিভার নামে পরিচিত। কলকাতা ও ঢাকায় এই রোগের উপস্থিতি দেখেন উপেন্দ্রনাথ। তিনিই প্রথম শনাক্ত করেন রোগের এই ধরণকে। অন্যদিকে, ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে ভারতের প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্ক স্থাপন করেন উপেন্দ্রনাথ।১৬ এ সবই উল্লিখিত হয় মনোনয়নপত্রে।১৭
ফেলোশিপের লক্ষ্যে
মনোনয়ন পাঠিয়ে বসে থাকলে কোনও পুরস্কার বা ফেলোশিপ যে ধরা দেয় না তা বলাই বাহুল্য। প্রার্থীর যোগ্যতা সম্পর্কে অনুকূল মনোভাব গড়ে তুলতে উপযুক্ত পদাধিকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এক্ষেত্রে আবশ্যিক। মেঘনাদ সাহা এগিয়েছিলেন সেই পথেই।
রয়্যাল সোসাইটির ফেলো আর্চিবল্ড হিল সোসাইটির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৫ অবধি।১৮ ১৯৪৩ সালে একটা বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে ভারতে এলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজ সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে ভারতের বিজ্ঞানীদের কাজে লাগানোই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এই সময় মেঘনাদের কথা হল তাঁর সঙ্গে, উঠে এল উপেন্দ্রনাথের ফেলোশিপের প্রসঙ্গ। কিন্তু হিল খুব একটা অনুকূল মনোভাব দেখান নি প্রথমে। তাঁর মতে ইউরিয়া স্টিবামাইন তাক লাগানোর মত একটা জিনিস ঠিকই কিন্তু এর উদ্ভাবনে উপেন্দ্রনাথের ভূমিকা নগণ্য! প্রায় সব কাজই রসায়ন বিভাগের সহকারীরা করে দিয়েছেন বলে মনে হয়েছিল তাঁর। প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়ে, কত সামান্য রসদে, ছোট্ট একটা ঘরে কতশত বার পরীক্ষার পরে ইউরিয়া স্টিবামাইনের কার্যকারিতা নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন উপেন্দ্রনাথ তা ব্যাখ্যা করেন মেঘনাদ। হিল স্পষ্টতই প্রভাবিত হয়েছিলেন ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত লেনার্ড রজার্সের প্রবন্ধ পড়ে। সেখানে রজার্স উপেন্দ্রনাথের ওষুধের পেটেন্ট নেওয়া হয়েছে বলে ভুল উল্লেখ করেন। মেঘনাদ জানান যে ওষুধের পেটেন্ট কখনই নেওয়া হয় নি এবং এই ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার পরেও কোনওরকম উচ্চবাচ্য করেন নি রজার্স। রজার্সের এই ত্রুটি ইচ্ছাকৃত নাকি অনবধান বশতঃ তা নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়। বিলেতে গ্রে প্রমুখ যে উপেন্দ্রনাথের তৈরি ইউরিয়া স্টিবামাইনের কার্যকারিতা নিয়ে নিঃসন্দেহ হয়েছেন তাও হিলকে জানান মেঘনাদ। এর পরে হিল যে উপেন্দ্রনাথের কাজের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হন তা স্পষ্ট হয়ে যায়। রজার্সের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতে শুরু করে দেন একমাত্র হিল। তিনি এ ব্যাপারে বিশদে জানতে চান রসায়নবিদ সাইমনসেনের কাছে। মেঘনাদের অনুরোধে ইনিই ফেলোশিপের জন্য উপেন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাব করেছিলেন রয়্যাল সোসাইটির কাছে। এঁর কাছ থেকে যে উত্তর, যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল তা মিশ্র এবং একইসঙ্গে তা খুবই হতাশার। ১৯৪৪ সালের মে মাসে তিনি চিঠি দিয়ে হিলকে জানালেন, অ্যান্টিমনি দিয়ে কালাজ্বরের যে চিকিৎসা চালু ছিল তখন তা সন্তোষজনক নয় দেখে নিজেই কিছু একটা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন উপেন্দ্রনাথ। এরলিকের তৈরি আর্সেনিক যৌগের কার্যকারিতা প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। গবেষণার প্রক্রিয়ায় যে যৌগ তৈরি করলেন তিনি তা খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়। তবে আবিষ্কারের ব্যাপারটা তাঁর গবেষণার সুদক্ষ পরিচালনার জন্য ততটা ঘটে নি, বরং ঘটে গিয়েছিল ‘ভাগ্যচক্রে’! এখন অবশ্য এই যৌগের উপাদান সম্পর্কে সবাই জানে এবং উপেন্দ্রনাথের নির্দেশ অনুসরণ করলে প্রস্তুত করা যায় কার্যকর যৌগটা। এটা যে অত্যন্ত ভালো একটা আবিষ্কার তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। রজার্সের সমালোচনাকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করেছিলেন সাইমনসেন। ওষুধ বিক্রি করে যদি অর্থ রোজগার করে থাকেন উপেন্দ্রনাথ তবে তাতে দোষের কিছু নেই। এর পরেই অবশ্য বিস্ফোরক মন্তব্য করেন সাইমনসেন। নিজেই তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যাঁর নাম তাঁর সম্পর্কে বলেন, আমি মনে করি না যে রয়্যাল সোসাইটিতে ফেলো হিসাবে মনোনীত হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে উপেন্দ্রনাথের। ম্যালেরিয়া সারানোর ওষুধ নিয়ে যে কাজ তিনি পরবর্তীকালে করেছিলেন তা আসলে সম্পাদিত হয়েছে তাঁর সহকারীদের হাতে। এটা অত্যন্তই মামুলি এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনও অবদান হিসাবে গণ্য হতে পারে না। তিনি পরিষ্কার করে দেন যে কেবলমাত্র কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারকে ভিত্তি করেই ফেলোশিপের প্রস্তাব করেছিলেন তিনি। উপেন্দ্রনাথের লেখা বিপুল সংখ্যক গবেষণাপত্র, যেগুলোর বিষয় চিকিৎসাবিজ্ঞান (clinical papers), তা নিয়ে অন্যান্য যোগ্যতর ব্যক্তিরা মন্তব্য করতে পারেন। এ ব্যাপারে বিচার করার মত প্রশিক্ষণ নেই তাঁর। শেষে সাইমনসেন যা বলেন তা আরও তাৎপর্যপূর্ণ – উপেন্দ্রনাথের বয়স এখন উনসত্তর আর তিনি সম্ভবতঃ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন কোনও অবদান রাখতে পারবেন না!
মেঘনাদ এবং হিল, উভয়ের কাছেই সম্ভবতঃ অপ্রত্যাশিত ছিল ব্যাপারটা, মেঘনাদের কাছে হতাশাব্যঞ্জক তো নিশ্চয়ই। তাঁরা আরও পথ খুঁজতে লাগলেন যাতে উপেন্দ্রনাথের কাজ উপযুক্ত গুরুত্বে বিবেচিত হয়। রসায়নবিদ ডব্লিউ এইচ গ্রে পরীক্ষা করেছিলেন ইউরিয়া স্টিবামাইন নিয়ে। তাই তাঁর মত জানতে চাওয়া হল এবার। রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হেনরি ডেলকে ১৯৪৪ সালের ৯ নভেম্বর নিজের বক্তব্য জানালেন গ্রে। কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারে উপেন্দ্রনাথের কৃতিত্ব স্বীকার করে নিলেন তিনি কিন্তু সাইমনসেনের মতই বললেন যে আবিষ্কারটা ঘটে গিয়েছে ভাগ্যক্রমে! এছাড়াও গ্রে নির্দিষ্টভাবে নেচার জার্নালে প্রকাশিত উপেন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখার অধ্যে অসামঞ্জস্য তুলে ধরলেন এবং মনে করিয়ে দিলেন যে বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত ইউরিয়া স্টিবামাইন পরীক্ষা করার পরে তিনি দেখেছিলেন যে লেখার সঙ্গে মিলছে না পরীক্ষার ফলাফল। পরবর্তীকালে উপেন্দ্রনাথ স্বীকার করে নেন এই অসঙ্গতি। ম্যালেরিয়া নিয়ে উপেন্দ্রনাথের কাজ যে অসফল সেটাও উল্লেখ করেন তিনি। এই সব প্রতিবেদনের ফলশ্রুতিতে ১৯৪৫ সালে উপেন্দ্রনাথের মনোনয়ন সাসপেণ্ড করে রয়্যাল সোসাইটি। এর পরে কী হতে পারত তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে অবশ্যই তবে ১৯৪৬ সালে উপেন্দ্রনাথের মৃত্যু হওয়ায় অবান্তর হয়ে পড়ে ফেলোশিপের এই বিষয়টা।১৯
তথ্যসূত্রঃ
১। Rajesh Kochhar, India Fellows of the Royal Society, London (1841-2000), Current Science, Vol. 80, No. 6, 25 March 2001
২। Rajinder Singh, U. N. BRAHMACHARI’S SCIENTIFIC ACHIEVEMENTS AND NOMINATION FOR THE FELLOWSHIP OF THE ROYAL SOCIETY OF LONDON, Science and Culture, VOL. 80, NOS. 1–2
৩। John Simonsen, https://en.wikipedia.org/wiki/John_Simonsen, accessed on 04 February 2024
৪। পূর্বে উল্লিখিত (দ্রষ্টব্য ২)
৫। https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_fellows_of_the_Royal_Society
৬। পূর্বে উল্লিখিত (দ্রষ্টব্য ১)
৭। Sarasi Lal Sarkar, THE ACTION OF QUININE AND ARSENICAL PREPARATIONS IN KALA-AZAR, THE INDIAN MEDICAL GAZETTE, March, 1915, pp 92-94
৮। প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কালাজ্বরে চিকিৎসা বিভ্রাট, ভারতবর্ষ, ফাল্গুন ১৩৪৮, (সঙ্কলিত) পিনাকপাণি দত্ত, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রবন্ধসংগ্রহ, দে’জ পাবলিশিং, জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ২৬৩
৯। Antimony, Scientific American Magazine, Vol. 20, No. 24 (June 1869), p. 369 (accessed online on 14 February 2024)
১০। John Morley, Case Of Acute Poisoning By Tartar Emetic, The British Medical Journal, Vol. 2, No. 824 (Oct. 14, 1876), p. 492
১১। LEONARD ROGERS, CORRESPONDENCE, The British Medical Journal, July 1915
১২। Sir LEONARD ROGERS, FURTHER EXPERIENCE IN THE TARTAR EMETIC TREATMENT OF KALA-AZAR INCLUDING ITS USE IN YOUNG CHILDREN, THE INDIAN MEDICAL GAZETTE, July 1917
১৩। পূর্বে উল্লিখিত (দ্রষ্টব্য ৮)
১৪। Fèlix Boscha and Laia Rosich, The Contributions of Paul Ehrlich to Pharmacology: A Tribute on the Occasion of the Centenary of His Nobel Prize, Pharmacology. 2008 Oct; 82(3): 171–179, Published online 2008 Aug 5, accessed on 06 March 2024
১৫। পূর্বে উল্লিখিত (দ্রষ্টব্য ৮), পৃ ২৬৭-২৬৮
১৬। Anindita Joardar, Sir U. N. Brahmachari: A Forgotten Scientist, International Journal of Science and Research (IJSR), Volume 12 Issue 11, November 2023
১৭। পূর্বে উল্লিখিত (দ্রষ্টব্য ২)
১৮) Archibald V. Hill,
Biographical, https://www.nobelprize.org/prizes/medicine/1922/hill/biographical/, accessed on 07 March 2024
১৯। পূর্বে উল্লিখিত (দ্রষ্টব্য ২)
চিত্রসূত্র – ইন্টারনেট এবং তার সহায়তায় তৈরি চিত্র