সূচিতে ফিরুন

হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা

লেখক - ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়
img

-তারপর তো হ্যামেলিনের বাঁশিওলা এল। বাঁশিতে দিল ফুঁ। সুর উঠল। অন্য এক সুর। যে সুর দিয়ে রাজ্যের সব ইঁদুর তাড়িয়েছিল তার থেকে অন্য রকম। রাজ্যের সব বাড়ির সব বাচ্চারা চঞ্চল হয়ে উঠল যে যেখানে ছিল। তারা লাফাতে লাফাতে বাইরে বেরিয়ে এল আর বাঁশিওলার পেছন পেছন চলতে শুরু করল। দেখতে দেখতে তারা রাজ্যের সীমা পার করে চলে গেল বাঁশিওলার পিছু পিছু। রাজ্যটা শিশুশূন্য হয়ে গেল। এইভাবে বাঁশিওলা কথা না রাখার শাস্তি দিল রাজাকে। রাজ্যে সব সাবালকেরা রয়ে গেল বটে তবে রইল না একটা শিশুও। কিন্তু শিশুরাই যে রাজ্যের ভবিষ্যৎ। এবার এই লোকেরা মারা গেলে রাজ্যটা যে শ্মশান হয়ে যাবে।

দাদুর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে শুনছিল তনুশ্রী। দাদু থামতে বলল, বাঁশির সুরে এত যাদু থাকতে পারে দাদু? প্রথম সুরে রাজ্যের সব ইঁদুরকে মোহিত করে রাজ্যছাড়া করল আবার পরে সব শিশু আর কচিকাঁচাদের?

-থাকবে না কেন দিদিভাই? সুর যে মস্ত বড় যাদুকর। সে যে মানুষকে সম্মোহিত করে রাখে। সে যে সম্মোহন বিদ্যা জানে।

-সম্মোহন বিদ্যা? সেটা আবার কী?

-যে বিদ্যা মানুষকে এমন কায়দা শেখায় যে তার প্রয়োগে মানুষকে একেবারে মোহিত করে রাখে। একবারে নিজের বশে করে নেয়। সে যা বলবে আমরা তাই করতে বাধ্য হই।

তনুশ্রী বলল, এ যাদু বাজে। এ যাদু পচা। আই ডোন্ট লাইক এনচান্টমেন্ট।

সদানন্দবাবু সামান্য হেসে বললেন, তা হোক। কিন্তু সুরের যাদু খুব ভালো। তুমি গান শোনো না? কিংবা বাজনা?

তনুশ্রী সদানন্দবাবুর মেয়ের মেয়ে মানে নাতনি। সোদপুরে থাকে। মাঝে মাঝে মাঝে দাদুর বাড়ি মানকুন্ডুতে আসে। সে খুব সুন্দর গান গায়। আবার একটা বাজনা শেখে। গান-বাজনা খুব ভালোবাসে। মাঝে মাঝে আবার দাদুর কাছে গানের ব্যাপারে কিছু জানতে চায়। জানতে চায় কথাটা তেমন ঠিক নয়। দাদু তো বিজ্ঞানের লোক আর গানের কিছু বোঝেন না। এটাই ধারণা নাতনির। তাই সে নিজে যা জানে সেটা দাদু জানে কিনা সেটা যাচাই করে নিতে চায়।

-দাদু তুমি বল তো রাগ কী?

দাদু হেসে বলে, এই আমার সুন্দরী নাতনি আমার কথা না শুনলে যা হয়।

-দূর সে তো মনের ভাব প্রকাশ। আমি বলছি গানের রাগের কথা গো। গান বাজনা এসব তো তুমি ভালবাস নাকি?

দাদু বলেন, দিদিভাই আমি তো গানের লোক নই। বিগ গানের লোক। তাই গানের ব্যাপারে কী আর বলতে পারি?

-আরে সে আবার কি হয় নাকি? যে ভালোবাসে সে কিছুই বলতে পারে না?

দাদু বললেন, প্রায়ই নাকি তোমাকে তোমার দাদু-ঠাম্মার কাছে রেখে দিয়ে বাবা মা সিনেমা দেখতে যায়? এটা কিন্তু তুমি বলেছ? আর বলেছ তারা খুব সিনেমা দেখতে ভালোবাসে?

-হ্যাঁ তা বলেছি। কিন্তু তার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক দাদু?

-তার মানে তোমার বাবা মা সিনেমা দেখতে খুব ভালবাসে আর দেখে। তবু তারা কি সিনেমার ব্যাপারে সব বলতে পারে?

তনুশ্রী চুপ করে কী সব ভাবছিল। তারপর বলল, বুঝেছি দাদু। তুমি রাগের ব্যাপারে কিছু জানো না। কিন্তু তুমি তো অনেক পড়াশোনা করেছ তুমি কী জানো গো? গানের ব্যাপারে কিছু না জানতে পার বিগ গানের ব্যাপারেই বল।

-বেশ আমি না হয় গান আর বিজ্ঞান একসঙ্গে দুটো নিয়েই কিছু বলি?

-গান আর বিজ্ঞান? সে আবার কী? দুটো তো দুরকম জিনিস।

দাদু আবার হাসল, আমি পদার্থবিদ্যার লোক। মানে গানের ব্যাপারে অপদার্থ বলতে পারিস। কিন্তু তা হলেও একটা দারুন জিনিস বলতে পারি আর সেটা তোদের গান বাজনার ব্যাপারেই।

খুব উৎসাহিত নাতনি। বলল, বল দাদু বল। তোমাদের পদার্থবিদ্যায় গান ঢুকে গেল কী করে? গান-বাজনা সেও কি বিজ্ঞানের বিষয় হতে পারে? সে তো শিল্পের ব্যাপার। যারা গান করে, বাজনা বাজায় তাদের তাই তো বলে সঙ্গীত শিল্পী, যন্ত্রশিল্পী এইসব।

-বিজ্ঞান তো ঢুকে যায় নি দিদিভাই? সে তো ঢুকেই আছে। বিজ্ঞান হল সত্য যা ছাড়া কি আমরা চলতে পারি বল?

তনুশ্রী এবার আপত্তিতে জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে বলল, আপত্তি আপত্তি দাদু আপত্তি। এই যে আয়নায় প্রতিবিম্ব পড়ে আমরা তা দেখি। কিন্তু সেগুলো তো মিথ্যে। বিজ্ঞান বলেছে এগুলো মিথ্যে। কিন্তু আয়না তো বিজ্ঞানের সৃষ্টি।

-তা বলেছে বটে তবে আয়না তো আবার বিজ্ঞানই তৈরি করেছে। একটা মিথ্যে জিনিস তৈরি করল বিজ্ঞান আর তুমি বলছ সে নাকি সব সত্যি বলে?

-আহা আয়নার প্রতিবিম্ব যে মিথ্যে সেটা আয়না না তৈরি করে লোককে বোঝানো যাবে কেমন করে বল? আর একটা বড় সত্যি যে আছে দিদিভাই?

-সেটা কী?

-আয়না তৈরি নাহলে দূরবীন হত কী করে? আকাশের গ্রহতারা নিয়ে অজানা সত্যিগুলো আমাদের কাছে প্রকাশ হত কী করে? আমরা তো সেই মান্ধাতা আমলের ধারণা নিয়ে থাকতুম যে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। কিন্তু আসলে কি তাই?

চুপ করে ভাবছিল তনুশ্রী। হয়ত দাদুর কথাগুলোই।

দাদু বলেই চললেন, তারপর ধর অণুবীক্ষণ যন্ত্র? কত ছোট ছোট জিনিস যেমন ভাইরাস ব্যাক্টিরিয়া যা আমারা দেখতে পাই না সেগুলো এই যন্ত্রে দেখতে পাই। আমরা আমাদের শরীরের রোগ নির্ণয়ে সেগুলো ব্যবহার করতে পারি বল?

-আরে হ্যাঁ ঠিক বলেছ তো দাদু। বিজ্ঞান না থাকলে আমরা তো কিছুই জানতাম না। জানতে পারতাম না আমাদের চারপাশে সে আকাশেই হোক বা মাটির ওপরে বা নিচে। বিজ্ঞান সত্য প্রকাশ করে আবার মিথ্যেটাকেও দেখিয়ে দেয় যে এটা মিথ্যে। তাছাড়া কত যন্ত্র বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে। এগুলো মানুষের কাজে লাগে।

দাদু এবার খুব উৎসাহিত। বললেন, যন্ত্র কিন্তু নতুন কিছু দেয়। যেমন রেলগাড়ি, প্লেন, আমাদের বাড়ির দরকার কত যন্ত্র আবার ধর কম্পিউটার এইসব। আবার এমন কি তুমি যে বাজনা বাজাও সেই যন্ত্রটাও তাই নয়?

প্রবল আপত্তি তনুশ্রীর, আরে না না বাদ্যযন্ত্র তো প্রস্তুত করে মিস্ত্রিরা। বাদ্যযন্ত্র কি ল্যাবরেটরিতে হয় নাকি দাদু?

-তা বটে। দাদু ভাবলেন একটু। তারপর বললেন, আচ্ছা তোমার সেতারের তার যদি এলোমেলো লাগানো হয় মানে তারগুলো সোজা সোজা না লাগিয়ে যদি কোণাকুনি লাগানো হয় কিংবা একটা সরু আর একটা মোটা? কিংবা ধর তারগুলোর মধ্যেকার ফাঁক যদি কোনটা কম কোনোটা বেশি হয়?

তনুশ্রী বলল, সে তো দোকানে গেলে ঠিক করে দেবে।

দাদুর চোখে চকচক করছে হাসি, সে কেমন করে দেবে?

তনুশ্রী এবার রেগে গিয়ে বলল, সে আমি কী করে জানব?

দাদু খুব ঠান্ডা মাথায় বলল, না তুই জানবি না। জানবে তোর মিস্ত্রি। কিন্তু মিস্ত্রি কী করে জানবে এবার সেটাই হল আসল কথা। তুই হয়ত বলবি মিস্ত্রি বই পড়ে জেনেছে তখন আমি বলব বইটা কে লিখেছে? যে জানে সেই তো লেখে।

তনুশ্রী আবার ভাবতে বসল। তারপর বলল, তা অবশ্য ঠিক বলেছ দাদু। তাহলে তুমি কী বলছ?

দাদু বলল, তুই তো জানিস শব্দ কম্পনে উৎপন্ন হয়। তুই উঠোনে টাঙ্গানো একটা দুই দিকে বাঁধা তারের মাঝখানে ছেড়ে দিলে সে কাঁপতে থাকে। কিন্তু শব্দ হয় না। আবার সেতার গীটার বা একতারাতেও তারের বিশেষ জায়গায় টোকা দিলে সুর তৈরি হয়।

তনুশ্রী বলল, সুর জিনিসটা তবে কী দাদু?

-ভাল প্রশ্ন। আমরা জানি কম্পনে শব্দ হয়। প্রতি সেকেন্ডে যতবার কোনও বস্তু কাঁপে তাকে বলে সেই বস্তুর কম্পাঙ্ক। আমরা চারপাশে যা শুনি পাখির ডাক, লোকের কথাবার্তা, হাওয়ার শব্দ গাড়ির আওয়াজ দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ, গান বাজনা সব কিছুর মধ্যে অনেক আর নানাবিধ কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট্ শব্দ থাকে। আমরা যে কথা বলি মানে যাকে স্বর বলি তাতে অনেক কম্পাঙ্কের শব্দ থাকলেও গানে সাধারণত একটি সুরের উপস্থিতি থাকে তাই সুর এত মিষ্টি হয়। মানুষের কথার থেকে মানুষের গাওয়া গান তাই অনেক বেশি মিষ্টি।

তনুশ্রী প্রশ্ন করে ফেলল, দাদু গান সুন্দর আবার দেখি বাজনা আরও সুন্দর। তা গানে সুর থাকে বাজনায় কী থাকে গো?

দাদু আর মুখে কিছু বলল না, একটা গান গেয়ে শোনালো। খালি গলায় মানে বাজনা ছাড়া।

গান থামতে অনুশ্রী মুগ্ধ হয়ে বলল, কী সুন্দর!

দাদু এবারও মুখে কিছু বলল না। চালিয়ে দিল একটা রেকর্ডার। যে গান তিনি মুখে গেয়েছিলেন সেটাই শোনা গেল গীটারে।

-দাদু তোমার গাওয়া গানটাই তো, তনুশ্রী চেঁচিয়ে উঠল, কিন্তু যেন আরও সুন্দর।

দাদু বললেন, দেখ দিদিভাই। গান আর বাজনা দুটোই কিন্তু একই সুরে মানে একই কম্পাংকের সুরে। কিন্তু গান গেয়েছি আমার গলার স্বরতন্ত্রী বা ভোকাল কর্ড কাঁপিয়ে আর বাজনায় কেঁপেছে তার তারগুলো। তবু গান আর বাজনার থেকে বাজনা তোমার বেশি ভালো লাগল। এই যে পার্থক্য এটা হল সুর উৎপত্তির স্থানের পার্থক্যের জন্যে।

দাদু এবার আবার সেই গানটাই বাজালো বাজনার সঙ্গে। জিজ্ঞেস করল, আগের খালি গলায় গাওয়ার চেয়ে আরও স্পষ্ট আর সুন্দর শোনাচ্ছে না? তনুশ্রী বিভোর হয়ে বলল, ঠিক তো। গান আর বাজনা মিলে বেশি সুন্দর হয় কী করে?

দাদু বলল, তার আগে একটা উদাহরণ দিই। ধর মা তোমাকে একটা বালতি জল বাইরের কল থেকে রান্নাঘরে রেখে আসতে বলছে। তুমি এক হাতে রেখে আসতে গিয়ে দেখলে সেটা বড্ড ভারি। তখন তুমি কী করবে?

-তখন দুহাতে ধরব।

-তার মানে এক হাতের চেয়ে দুই হাতে জোর বেশ তাই তো?

-হ্যাঁ বটেই তো।

-দেখ গান বাজছে একটা সুর তরঙ্গে। আবার বাজনাও বাজছে একই সুর তরঙ্গে। এই দুটো যখন একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে তখন ব্যাপারটা এক হাত থেকে দুই হাতে ধরার মত হয়ে গেল নাকি?

-তার মানে বলছ আরও জোরের শোনাবে?

-হ্যাঁ। কারণ এ ক্ষেত্রে গানের কম্পাঙ্ক আর বাজনার কম্পাঙ্ক জুড়ে গিয়ে বিরাট একটা কম্পাঙ্ক তৈরি হবে আর গান ভালো শোনাবে।

এবার দাদু করল কি একটা খালি গলায় গান আর একটা অন্য গানের বাজনা একসঙ্গে চালাল।

-এ মা কী বিচ্ছিরি।

-তাই তো হবে গো। গান বাজছে যে সুরতরঙ্গে আর বাজনা বাজে অন্য তরঙ্গে। তোমার জলের বালতি এক হাতে ধরলে আর একজন সেই বালতি আরও জোরে ধরে তোমরা একসঙ্গে নিয়ে যেতে লাগলে। তবে কী হবে?

-আমার যেতে আরও কষ্ট হবে। বালতির জল ছলাত ছলাত করে পড়তে থাকবে। আমরা দুজনেই এলোমেলো হাঁটব।

-ঠিক ঠিক একেবারে ঠিক। তোমাদের তাল ঠিক থাকবে না। চলার ছন্দ ঠিক থাকবে না। তাই গানের এক দশা হবে। এই যে দুটো একই কম্পাংকের সুর একসঙ্গে মিশে যাওয়া একে বলে অনুরণন। অনুরণন সঙ্গীতকে শুধু যে বাড়িয়ে তোলে তা নয় আরও শ্রুতিমধুর করে তোলে। আচ্ছা দিদিভাই তুমি তো মৌলিক সুর জানো?

-হ্যাঁ এই তো সা রে গা মা পা ধা নি।

-ঠিক। গানগুলি এই মৌলিক সুর সাজিয়ে সাজিয়েই হয়। এক একটি মৌলিক সুর কিন্তু এক একটি একক কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট শব্দ। কিন্তু এই সা থেকে নি পর্যন্ত সুরগুলির কম্পাঙ্ক প্রত্যেকের আলাদা। এবং ক্রমে নিচু থেকে উঁচুতে যায়। যারা রেওয়াজ করে তারা প্রত্যেকেই জানে।

-সুর তো বটেই তাছাড়া আছে আবার রাগবিস্তার-

দাদু বাধা দিয়ে বলল, দিদিভাই এটা কিন্তু সঙ্গীত শিক্ষার ক্লাস নয়। সে তোমাদের গানের দিদিমণিরাই ভালো জানবেন। আমি এসব তেমন ভালো জানিও না আর আলোচনাও করতে চাই না। আমি শুধু গান বা সঙ্গীতের মধ্যে যেটুকু বিজ্ঞান আছে সেইটুকুই আলোচনা করব।

-বিজ্ঞান?

-হ্যাঁ শব্দবিজ্ঞান। পদার্থবিদ্যা বা পদার্থবিজ্ঞান।

-বেশ বল।

-শব্দবিজ্ঞান বলছে দুইপ্রান্তে বাঁধা তারের এক একটা দৈর্ঘের জন্যে এক এক কম্পাংকের শব্দ তৈরি হয়।

-আমি বুঝেছি আমি বুঝেছি, চেঁচিয়ে উঠল তনুশ্রী, সেই জন্যেই সেতার গীটারের এক একটা তারে এক একটা সুর ওঠে। কারণ একটাই তার মাঝে বাঁধুনি দিয়ে দৈর্ঘ ভাগ করে রেখেছে।

-হ্যাঁ এটাই হল তারের যন্ত্রের মূল নীতি বলতে পারো। আচ্ছা দিদিভাই তারের শক্ত বাঁধুনিটাই যদি সুর তৈরির পক্ষে যথেষ্ঠ হয় তবে বেকার ঐ বড় বড় বাক্সগুলো ঘাড়ে করে বওয়া কেন? কোনওটায় আছে বড় লাউয়ের খোলা, কোনটায় নারকেলের মালা আবার কোনওটায় বা হালকা প্লাই দিয়ে তৈরি খোল? এই ধর সেতার, গীতার, একতারা, বীণা ইত্যাদি ইত্যাদি। ধর লাউয়ের ঐ বড় খোলাটা বাদ দিলে যন্ত্রটা তো খুব ছোট হয়ে যায় আর বয়ে নিয়ে যেতে বেশ সুবিধে হয়? এবার তনুশ্রী পড়ে গেল যেন ধাঁধায়। অনেক সময় লেগে গেল তার ভাবতে। তারপর বলল, না দাদু হল না। তুমি বলে দাও বরং। তবে মনে হচ্ছে-

-কী মনে হচ্ছে?

-ঐ যে বললে না অনু অনু না কী যেন-

-অনুরণন। একজ্যাক্টলি। ঠিক ধরেছ। আসলে শুধু তার আঙুল দিয়ে টেনে যে শন্দ হবে তা কিন্তু খুব ক্ষীণ মানে খুব দুর্বল। তাই এর একটা জবরদস্ত সহকারি চাই। অনুরণন হচ্ছে এর সেই সহকারি। এই যে সব লাউ নারকেলের খোলা বা প্লাইয়ের বাক্স দেখছ এতে থাকে কিন্তু বাতাস ভরা। এই বাতাস একেবারে আবদ্ধ নয় আবার একবারে খোলামেলাও নয়। যন্ত্রের তারগুলো যখন কাঁপে তখন এই বাক্সগুলোর ভেতরের বাতাস বা বায়ুস্তম্ভও কাঁপে। তার আর বায়ুস্তম্ভ একই সঙ্গে একই কম্পাংকে কাঁপে বলে তৈরি হয় অনুরণন আর তা শব্দ বা সুরকে বাড়িয়ে তোলে অনেক গুণ।

তনুশ্রী বলল, সেই জন্যে হাঁড়ির ভেতর মুখ নিয়ে কথা বললে সিংহের গর্জন শোনা যায় দাদু?

কথটা বলে সে হাসল।

দাদুও হাসল, কথাটা ঠিক তাই। হাঁড়ির ভেতর কথা বললে ভেতরের বাতাস কাঁপতে কাঁপতে এগোতে এগোতে হাঁড়ির বাইরে চলে যেতে চায়। কিন্তু হাঁড়ি বাধা দেয়। তাই সেই শব্দ আবার ফিরে এসে নিজেকেই ধাক্কা মারে। আর এই ধাক্কাধাক্কি চলতেই থাকে। তখন সব কম্পাংক মিলে গিয়ে তৈরি হয় একেবারে সিংহের গর্জন।

বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে বসে থেকে তনুশ্রী বলল, আচ্ছা দাদু এই যে একই গান যদি সেতার, গীটার, হারমোনিয়াম, বেহালায় বাজে তবে কেমন যেন আলাদা আলাদা মনে হয়। কেন এমন হয় গো?

-হ্যাঁ এর পেছনেও আছে সে বিজ্ঞানের কারসাজি। আসলে শব্দের কিছু আলাদা আলাদা গুণ আছে। শব্দ প্রতি সেকেন্ডে কত বার কাঁপে সেটা তার কম্পাঙ্ক। শব্দ কত জোরে আমাদের কানে ধাক্কা মারে সেটা তার প্রাবল্য। তেমনই শব্দ মানে একই কম্পাঙ্ক আর প্রাবল্যের শব্দ কোথা থেকে উৎপন্ন হল সেটাকে তার জাতি বা গুণ বলে। একই কম্পাংকে কোথাও বৃষ্টির জল পড়ছে আবার সেই একই কম্পাংকে হয়ত একটা বাজি ফাটছে শুনতে কিন্তু আলাদা লাগবে। ধর একই সুর সা সেতারে বাজছে আবার গীটারে বাজছে তবু তাদের আলাদা করে চেনা যাবে এই গুণ বা জাতির জন্যে। মানুষের কানে তার ভিন্ন ভাবে ঢুকে মস্তিষ্কে ভিন্ন অনুভূতি আনবে।

দাদুর বলা শেষ হল। প্রায় মিনিট দুয়েক একেবারে স্তব্ধ হয়ে থেকে তনুশ্রী বলল, দাদু আমরা আর্টসের ছেলেমেয়েই হই বা বিজ্ঞানের, আমরা গান করি সুর, লয়, তাল আর রাগ নিয়ে। কিন্তু এই সঙ্গীতের পেছনে এত বড় একটা বিজ্ঞান আছে কেউ তো বলে নি। আর বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতেও এত বিজ্ঞান লাগে! দাদু খুব প্রীত হয়ে বললেন, বিজ্ঞান ছাড়া আর কে জ্ঞান দেবে বল ভাই?

(এই গল্পের সমস্ত চিত্র সূত্র অন্তরজাল)