আজকের দিনে বিজ্ঞান-গবেষণার জগতে নারী-পুরুষ সমানভাবেই যোগ দিচ্ছেন । তবু যেন মনে হয় মহিলা বিজ্ঞানীদের জীবনে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হয়, সম্মুখীন হতে হয় অনেক বেশি বাধা-বিপত্তির। তার মধ্যেও তাঁরা তাঁদের মনীষা, অধ্যবসায়, পরিশ্রমের মাধ্যমে অনেক সময় সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যান।
গত বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে এরকমই একজন মহিলা বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রসায়ন ও মেডিসিন বিভাগে। যদিও তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কারটি এক পুরুষ বিজ্ঞানীর সঙ্গে যৌথভাবে, তবুও, তাঁর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এই নোবেলজয়ী মহিলা বিজ্ঞানীর নাম ক্যাটালিন কারিকো।
ক্যাটালিনের জন্ম ১৯৫৫ সালের ১৭ জানুয়ারি হাঙ্গেরিতে খুব সাধারণ একটি পরিবারে। তিনি একজন হাঙ্গেরিয়ান- আমেরিকান মানুষ। প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সময় থেকেই তিনি পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো ছিলেন এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেতেন।
১৯৭৮ সালে তিনি বি.এস.এস. সি ডিগ্রি পান ও ১৯৮২ সালে প্রাণরসায়ন বিষয়ে পি.এইচ.ডি করেন হাঙ্গেরির সেজেড্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর তিনি হাঙ্গেরির ইন্সটিটিউট অফ বায়োকেমিস্ট্রি , বায়োলজিক্যাল রিসার্চ সেন্টারে তাঁর পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৮৫ সালে তাঁর গবেষণাগারে রিসার্চ গ্রান্ট বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি তাঁর স্বামী ও কন্যাসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন।
১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত তিনি ফিলাডেলফিয়ার টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট -ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কাজ করেন। একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কারিকো অংশ নেন যাতে এডস্, বিভিন্ন রক্তসম্পর্কিত অসুখ ইত্যাদি রোগীদের ডাবল্ স্ট্রান্ডেড ডি.এন. এ . দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছিল। সেইসময় এটি একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য গবেষণাকাজ ছিল, কারণ তখনও পর্যন্ত ডাবল্ স্ট্রান্ডেড ডি.এন.এ. দ্বারা 'ইন্টারফেরন ইন্ডাকশন' এর মলিকিউলার কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে কিছু জানা ছিল না।
১৯৮৮ সালে কারিকো জনস্ হপকিন্স হাসপাতালে কাজ করতে শুরু করেন, কিন্তু কিছু আইনগত কারণে ওই চাকরিটি তিনি করতে পারেন নি। টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ে যিনি তাঁর কাজের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন, তাঁর অসহযোগিতার ফলে তাঁর অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ পেতেও অসুবিধ হতে থাকে। পরে অনেক প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা তিনি ১৯৮৮ থেকে '৮৯ সাল অবধি মেরিল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সিগন্যাল প্রোটীন ইন্টারফেরন' নিয়ে কাজ করেন। ১৯৮৯ সালে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এলিয়ট বামাথান - এর সঙ্গে মেসেঞ্জার আর. এন. এ . (mRNA) নিয়ে গবেষণা করেন।
১৯৯০ সালে একজন অস্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে ( পেনসিলভানিয়ার পেরেলমান স্কুল অফ মেডিসিন) তাঁর গবেষণা প্রকল্প জমা দেন, বিষয় ছিল mRNA নির্ভর জিন-থেরাপি। কিন্তু এখানেও গবেষণার জন্য অর্থমঞ্জুর হল না। বারবার তাঁর প্রকল্পগুলি বাতিল হতে থাকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি স্থায়ী অধ্যাপক পদ পেলেন না। ১৯৯৫ সালে তাঁর 'ডিমোশন' হল।
১৯৯৭ সালে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন অধ্যাপক ড্রিউ ভাইসম্যান। তাঁর বিষয় 'ইমিউনোলজি'। তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে কারিকো গবেষণাকাজ করার সুযোগ পেলেন। ইমিউনোলজি ও বায়োকেমিস্ট্রিতে তাঁদের যৌথ গবেষণা খুবই কার্যকরী হল এবং সাফল্য আসতে লাগল। ২০০৫ সাল থেকে শুরু করা গবেষণার ফলে দেখা গেল কৃত্রিম mRNA 'highly inflammatory ' হলেও tRNA কিন্তু 'non-inflammatory ' ।
কারিকো ও ভাইসম্যান তাঁদের গবেষণায় দেখালন যে , mRNAর কোনো নির্দিষ্ট নিউক্লিওসাইডে পরিবর্তনের ফলে 'Immune response' হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। (এখানে তাঁরা Uridine কে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন Pseudouridine দ্বারা। ) তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে লেখা গবেষণাপত্র Nature ও Science এর মতো জার্নালে প্রকাশের জন্য মনোনীত হল না। পরে Immunity নামক জার্নালে ওই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। আরও দীর্ঘ গবেষণা তাঁরা চালাতে থাকেন যার বিস্তারিত বিবরণ থেকে বিরত থাকছি। পরে এই দুই বিজ্ঞানী যৌথভাবে একটি কোম্পানী তৈরি করেন, যার নাম RNARx এবং গবেষণালব্ধ আবিষ্কারগুলির পেটেন্ট নেন।
২০০৬ সাল থেকে তিনি প্রাণরসায়নবিদ ইয়ান ম্যাকলাচলানের সঙ্গে কাজ শুরু করেন।
২০২০ সালে কারিকো ও ভাইসম্যানের আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে Covid-19 এর প্রতিষেধক তৈরি করে BioNTech এবং Pfizer। Modernaও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। mRNA নির্ভর প্রতিষেধক খুবই সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছিল। ক্যানসার, কার্ডিওভাসক্যুলার অসুখ এবং অন্যান্য বিপাকক্রিয়াজনিত অসুখের চিকিৎসায় mRNA অত্যন্ত সফলভাবে প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে।
কারিকো ১৩০ টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর গবেষণার জন্য। ২০২৩ সালে কারিকো ও ভাইসম্যান যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান 'Physiology and Medicine ' বিভাগে বিজ্ঞান গবেষণায় তাঁদের অবদানের জন্য।ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি স্ত্রী ও মা হিসেবে একজন সফল মানুষ। তাঁর কন্যা সুসান ফ্রান্সিয়া অলিম্পিকে দুবার সোনা জিতেছেন।
তাঁর আত্মজীবনী 'Breaking Through: My Life in Science' প্রকাশিত হয়েছে ক্রাউন পাবলিশিং গ্রুপ থেকে, তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির কয়েকদিন পরেই। তাঁর জীবনকথা পরবর্তী প্রজন্মের মহিলা বিজ্ঞানীদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
চিত্রসূত্র – ইন্টারনেট