'খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে,কাল কল্লে এঁড়ে কিনে। নিরাপদর তো এমনটাই হবার কথা ছিল। সারাটা জীবন দশটা-পাঁচটা চাকরি করে সবে রিটায়ার করেছিস এবার একটু থিতু হ,বেড়াতে যা ,আনন্দ কর তা না এ কোন ঘোড়া রোগে ধরল।' চরম বিরক্তি প্রকাশ পেল অজিত বাবুর কথায়। অনামিকা,পঁয়ত্রিশ বছর এ জি বেঙ্গলে চাকরি করে সদ্য অবসর নিয়েছেন,একটি দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। 'শুনেছিলাম বাহাত্তরে বুদ্ধিভ্রংশ হয়, নিরাপদ'দার তো বাহাত্তরে পৌঁছাতে ঢের দেরি'।
জীবন কৃষ্ণ মাঝি চাকরি কালে কাউকে সমীহ করে কথা বলেন নি। এখনও বলেন না। 'সবার কি আর সব বয়েসে আক্কেল হয়? নিরাপদ বরাবরই লেট রানিং। বুদ্ধিটা বরাবরই একটু খাটোর দিকেই'।
'লোভের কথাটা বললেনাতো জীবন'দা। লোভ না থাকলে এই বয়েসে এসে এই গাড্ডায় পড়ে?' আরেকজন অবসরপ্রাপ্ত ধরুন বাবুর টিপ্পনী। প্রাণতোষ ধরকে সবাই ধরুন বাবু বলে ডাকে। শ্যামলেন্দুই কথাটা প্রথম বলেছিল,' ধর ধর বলতে পারবো না,তুই-তোকারি শোনায়। সকলের পরম শ্রদ্ধেয় প্রাণতোষবাবুকে আমি ধরুন বাবু বলেই ডাকব।' সেই থেকে চলছে।
হন্তদন্ত হয়ে ক্লাব ঘরে ঢুকল অরণ্য ঘোষাল,' নিরাপদর কি হয়েছে জান কেউ? কেউ ঠিকঠাক কিছু বলতে পারছে না। নিরাপদর বৌ নাকি ক্ষেপে আগুন।' অনামিকা ঝাঁঝিয়ে ওঠে 'নিরাপদদার বৌ অতি ভালমানুষ,অন্য কেউ হলে মজা টের পেত নিরাপদদা। পঁয়ষট্টি বছর বয়েসে এসে ফের পঁচিশ হবার সখ। বৌটাকেও ফুঁসলে ছিল সঙ্গে নিয়ে যেতে। বুড়োর কি কথার ছিরি-বলে আমি হয়ে যাব পঁচিশের যুবক আর তুমি হয়ে যাবে পঞ্চদশী।'
অরণ্য প্রায় লাফিয়ে ওঠে,'তাই,তা কি ভাবে হবে সেটা? মন্ত্র পড়ে?'
'আজ্ঞে না। রীতিমত বৈজ্ঞানিক কায়দায়।'বলে অনামিকা। 'বিজ্ঞাপন দেখনি তোমরা?' ব্যাগ থেকে এক টুকর কাগজ বার করলেন তিনি,'এই দেখ'।
ছবির 'যৌবন' পুকুর নয়, বাস্তবের 'যৌবন' মেশিন
আশিতে আসিও না। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত এই ছবি হয়েছিল সুপারহিট। 'যৌবন' পুকুরে একবার ডুব দিলেই মৃত্যুশয্যায় চলে যাওয়া মানুষ হয়ে উঠবে ছোকরা। কিন্তু সেটা তো ছিল ছবি। কল্পনার জগত। কিন্তু বাস্তবেও যে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে তা কে জানত।
ইজরায়েল থেকে আনা বিশেষ টাইম মেশিনের মাধ্যমে ৬০ বছরের বৃদ্ধ হয়ে যাবে ২৫ বছরের যুবক। বিশেষ অক্সিজেন থেরাপির মাধ্যমে এই অসাধ্যসাধন করা হবে।
প্যাকেজ ১০ টা সেশনের প্রতি সেশনের জন্য খরচ পড়বে ৬ হাজার। আবার তিন বছরের জন্য প্রতি বছর ৯০ হাজার টাকা করে দিলে মিলবে অফুরন্ত যৌবন। বায়ুদূষণের জন্য মানুষ দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে পড়ছে। কিন্তু এই অক্সিজেন থেরাপির মাধ্যমে মাত্র ছয় মাসের ভিতরেই মিলবে যৌবন প্রাপ্তি।
'ছোকরা হওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে ফাঁদে পা দিল নিরাপদ। পদস্খলন হল ওর। বৌটা সমানে চেঁচিয়ে গেছে ,বুজরুকদের পাল্লায় যাতে না পড়ে-প্রাণপণ বাধা দিয়েছে,কিন্তু শেষরক্ষা হল না'। আফসোস ঝড়ে পড়ে অনামিকার গলায়।
'এই আপদ নিরাপদটা গেছে কোথায়? এই যে ঘোষাল,তোর তো আমাদের থেকে বয়েস কম। যা না খোঁজাখুজিকরে নিরাপদটাকে ধরে নিয়ে আয়। ওর মুখ থেকেই শুনি ব্যাপারটা কি।'
ঘোষাল বেরিয়ে গেল নিরাপদর খোঁজে। প্রায় সাথে সাথেই নবারুণ ঢুকল মিলি বৌদিকে সঙ্গে নিয়ে।
'এবারে শোন নিরাপদদার কীর্তি। বৌদির কাছেই শোন। একেবারে অসহ্য বললেও কম বলা হয়।'
মিলি বৌদি বসে আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে নিলেন। একটু দম নিয়ে পুরো ঘটনাটার সঙ্গে একরাশ অভিযোগ উগরে দিলেন। 'সারা জীবন কলেজে বায়োকেমিস্ট্রি পড়িয়ে এলো। সে কিনা রিটায়ারমেন্টের পরে একটা বুজরুকের পাল্লায় পড়ল এভাবে। বলে যৌবন ফিরিয়ে দেবে। বাজারে একটা লোক হ্যান্ডবিল বিলি করছিল। অনামিকার হাত দিয়ে পাঠিয়েছি। তোমরা পড়েছ নিশ্চয়। সেইটা পড়া ইস্তক উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল নিরাপদ। ল্যাপটপ খুলে বসে গেল পড়তে নাওয়া নেই খাওয়া নেই শুধু পড়েই চলেছে। হপ্তা খানেক চলল এই অবস্থা। তারপর একদিন সকালে কোথায় চলে গেল। ফির এলো ঘণ্টা দুয়েক পরে'।
☬
'তোমার আর আমার জন্য মোট একুশ লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিয়ে এলাম। চমৎকার ব্যবস্থা। পর পর কয়েকটা সেশন,তারপর বাৎসরিক কয়েকটা সেশন। চলবে তিন বছর ধরে। তিন বছর পর আমার বয়স হবে পঁচিশ আর তোমার পনের। নতুন করে আবার শুরু করব জীবন। গত জীবনের ভুলগুলো আর নয়। বহুদিনের শখ ছিল দেশ-বিদেশে ভ্রমণ। অপূর্ণ থাকবেনা আর'।
মিলি হতবাক। এত বছর এক সঙ্গে কাটিয়েছে মিলি,নিরাপদর মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে তার কোন রকম সন্দেহই হয় নি কোনদিন। আদ্যপ্রান্ত আন্তরিক এবং একনিষ্ঠ বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক অবসর গ্রহণের পরে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করার কথাও ভাবছিলেন। ইদানীং বাড়িতে তিনি শুধু পড়াশুনো করেই সময় কাটাতেন। সেদিন বাজার থেকে ফিরে আসার পরেই গণ্ডগোল শুরু হল।
অজিত বাবু অনেকক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন। বলে উঠলেন,'বাজার থেকেই অধঃপতনের সূত্রপাত বলছ?'
'অধঃপতনের সূত্রপাত কেন বলছেন, অধঃপতনের তো কিছু আমি দেখছি না।'-মিলি বৌদি প্রতিবাদ জানায়।
হাত তুলে মিলি বৌদিকে সমর্থন জানায় অনামিকা। 'কিছু একটা রহস্য আছে কোথাও। নিরাপদদার সঙ্গে কথা না বলে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ঘোষালটা গেল কোথায়?ঘন্টাখানেক তো হতে চলল।'
বলতে না বলতেই ঘোষাল ঢোকে। সঙ্গে নিরাপদ আর থানার ওসি কমল বাবু। ঘরের মধ্যে চাঞ্চল্যের আভাস পাওয়া গেল। পুলিশ আসবে আশা করেনি কেউই। ঘরের স্তব্ধ নীরবতা ভাঙল ঘোষালই। 'দুনিয়া ঘুরে শেষ পর্যন্ত নিরাপদদা কে পেলাম থানায়। নিজে যাননি,বড়বাবুই লোক পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে গেছেন।' 'হ্যাঁ,আমিই ডেকে এনেছি। আর বলবেন না। গোটা দুনিয়াটাই মনে হয় প্রতারকে ছেয়ে গেছে। আজ সকালেই কানপুরের পুলিশ কমিশনার অনিল কুমারের কাছ থেকে একটা ফোন পাই। বুড়োদের ছোকরা বানিয়ে দেওয়ার চমৎকার ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলেন উত্তরপ্রদেশের কানপুরের দম্পতি রাজীব কুমার দুবে ও রেশমি। শহরের কিদওয়াই নগর এলাকায় রীতিমতো খুলে ফেলেছিলেন থেরাপি সেন্টার। প্রতারণা ফাঁদে পা দিয়েছিলেন বহু বৃদ্ধ। দম্পতির প্রতিশ্রুতি ছিল ইজরায়েল থেকে আনা বিশেষ টাইম মেশিনের মাধ্যমে ৬০ বছরের বৃদ্ধ হয়ে যাবে ২৫ বছরের যুবক। এইভাবে হাতিয়ে নিয়েছিলেন প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। পুলিশের সন্দেহ অভিযোগ জমা হতেই বিদেশে গা ঢাকা দিয়েছেন ওই দম্পতি। ওদের অফিসে তল্লাশি চালিয়ে প্রচুর নথি উদ্ধার হয়েছে। সেখান থেকে জানা গেল ওদের জাল গোটা দেশে ছড়িয়ে আছে। সেই তালিকা থেকেই আমরা নিরাপদ বাবুর নামটি পাই'।
নিরাপদ বাবুর মুখে টু শব্দটি নেই। মাথা নিচু করে গোঁজ হয়ে বসে আছেন। ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন ছুটে যাচ্ছে তার দিকে। 'প্রতারকরা কজন,ছেলে না মেয়ে,বয়েস কেমন তাদের,বাংলায় কথা বলে না হিন্দি,'-এই রকম হাজারো প্রশ্ন।
উত্তর আসে কমল বাবুর কাছ থেকে। 'শুনলে অবাক হবেন প্রতারক মাত্র দুজন রাজীব দুবে ও রেশমি দুবে । স্বামী-স্ত্রী। বাকিটা অনলাইন। ইন ফ্যাক্ট, নিরাপদ বাবুর সাহায্য না পেলে আমরা জানতেও পারতাম না যে এই জাতীয় জালিয়াতির ব্যবসার বীজ বপন হয়েছে বিদেশের কিছু গবেষণাগারে। নিরাপদ বাবুর কাছেই শোনার জন্য অনুরোধ রাখছি।'
☬
সকলের সমবেত অনুরোধ আর দাবির অভিঘাতে নিরাপদ বাবুর মৌনিদশা বাধ্য হয়েই কেটে গেল। ইতিমধ্যেই সদা তৎপর ঘোষাল সামনের দোকান থেকে চায়ের ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। চায়ে হালকা করে চুমুক দিয়ে নিরাপদ বাবু বক্তৃতা শুরু করলেন।
'২০২২ এর ২৫সে অক্টোবর,অ্যানটোনিও রিগালাডো এমাআইটি টেকনোলজি রিভিউ পত্রিকায় একটি সাড়া জাগানো প্রবন্ধ লেখেন 'how scientists want to make you young again'. বিষয় বস্তুটি অবশ্যই চমকে দেবার মত। আমরা সকলেই রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছাপূরণ গল্পটি জানি। বাবা চাইছেন বালক হতে ছেলে চাইছে স্বাধীন হতে। তাদের নিজ নিজ মনস্কামনা পূর্ণ হল। গুরুদেব লিখছেন-
-সুশীল বিছানায় পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে সমস্ত দিন ধরিয়া কেবল মনে করিতে লাগিল যে, 'আহা, যদি কালই আমার বাবার মতো বয়স হয়, আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি, আমাকে কেউ বন্ধ করে রাখতে পারে না।'
তাহার বাপ সুবলবাবু বাহিরে একলা বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন যে, 'আমার বাপ মা আমাকে বড়ো বেশি আদর দিতেন বলেই তো আমার ভালোরকম পড়াশুনো কিছু হল না। আহা, আমার যদি সেই ছেলেবেলা ফিরে পাই, তা হলে আর কিছুতেই সময় নষ্ট না করে কেবল পড়াশুনো করে নিই।'
ইচ্ছা-ঠাকরুন সেই সময় ঘরের বাহির দিয়া যাইতেছিলেন। তিনি বাপের ও ছেলের মনের ইচ্ছা জানিতে পারিয়া ভাবিলেন, 'আচ্ছা ভালো, কিছুদিন ইহাদের ইচ্ছা পূর্ণ করিয়াই দেখা যাক।'
এই ভাবিয়া বাপকে গিয়া বলিলেন, 'তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হইবে। কাল হইতে তুমি তোমার ছেলের বয়স পাইবে।' ছেলেকে গিয়া বলিলেন, 'কাল হইতে তুমি তোমার বাপের বয়সী হইবে।' শুনিয়া দুইজনে ভারি খুশি হইয়া উঠিলেন।-
হ্যাঁ, ইচ্ছা-ঠাকরুন এক লহমায় বয়েস পাল্টে দিলেন। বিজ্ঞান বলছে এটা নিছক গল্প-কথা নয়,বিজ্ঞান সত্যিই পারে বয়েস পাল্টে দিতে। আমরা সবাই জানি ডলি নামের ভেড়াটির কথা। নব্বুইএর দশকে স্কটল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা একটি পূর্ণবয়স্ক ভেড়ার স্টেমসেলকে শৈশবত্ত্ব দান করেছিলেন ডলির জন্ম দিয়ে। এটাকে বলে ক্লোনিং। এই পদ্ধতিতে বৃদ্ধ কোষ ব্যবহার করে পৃথক একটি শিশুর জন্ম হচ্ছে। কিন্তু বৃদ্ধ দেহের বৃদ্ধ কোষকে যদি তারুন্যে পালটান যায় তবে বৃদ্ধ নিজেই ফিরে যাবে তারুন্যে। বছর পনের আগে জাপানের কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখিয়েছেন এটা সম্ভব। পরীক্ষাগারের সীমিত পরিসরে কিছু বৃদ্ধ কোষের ওপর পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এই সম্ভাবনার কথাটুকুই বলেছিলেন মাত্র। বর্তমান বিশ্বে বেশ কিছু ব্যবসায়ি গোষ্ঠী এই সম্ভাবনার কথাটুকুকে মূলধন করে এই জাতের গবেষণায় বিপুল পরিমাণে লগ্নি করতে উৎসাহ দেখালেন। গবেষণার সাইন বোর্ড টাঙিয়ে শুরু হল প্রতারনার ব্যবসা। রিচার্ড ক্লাউসনার ঝাঁপিয়ে পড়লেন যৌবন বেচার ব্যবসায়ে। লক্ষ-কোটি ডলারের জালিয়াতি ব্যবসা। ওষুধ খান ,ফেলে আসা যৌবন ফিরে পান। এই ছিল শ্লোগান।'
মিলি বৌদি বেশ চটেছেন বোঝা গেল,'তুমি জানতে ওটা জালি তাও ওর পেছনে ধাওয়া করলে?'
'আমার কিছু করার ছিলনা মিলি। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিজ্ঞানী আলফোনসো মার্টিনেজের অনুরোধ না রেখে পারলাম না। আলফোনসো কোনও সূত্রে খবর পেয়েছিল যে রিচার্ড ক্লাউসনারের প্রতারকেরা ভারতেও বাসা বেঁধেছে। ওদের একটু সাহায্য করলাম।'
'অতগুলো টাকা যে জলে গেল?'
বড় বাবু হাসতে হাসতে বললেন,'ওই টাকা ফেরত দেবার দায়িত্ব আমার'।
(এই গল্পের চিত্র সূত্র অন্তরজাল)