১৯৫৯ মার্চের এক সন্ধায় চৈনিক সৈনিকদের চোখে ধুলো দিয়ে অল্প কিছু খাম দেহরক্ষীর সাথে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৪তম দালাই লামা অন্তর্ধান হয়েছিলেন তাঁর তিব্বতের খাম প্রদেশের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ থেকে। লোকালয়ের বাইরে অপেক্ষা করছিলো আরো কয়েকজন দেহরক্ষী, স্বাধীন তিব্বতের কিছু রাজপরিষদ ও দালাই লামার নিকটতম পরিবার। সবাইকে সাথে নিয়ে তিনি হিমালায়ের অত্যন্ত দুর্গম গিরিখাত দিয়ে রওয়ানা দেন ভারতবর্ষের দিকে। ততক্ষণে চীন সরকারের নজরবন্দী দালাই লামার অন্তর্ধানের কথা জানাজানি হয়ে গেছে। তাঁর খোঁজে চৈনিক সৈন্যরা পাগল কুকুরের মত চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু পার্বত্য এলাকায় মার্চের শীতের ঘন কুয়াশায় তাঁদের গতিবিধির হদিস পায় নি কেউ। ইতিহাসে এ এক অতি স্মরণীয় অন্তর্ধান। ১৫ দিন পথে অনেক বাধা বিপত্তি পার করে তাঁরা ভারতবর্ষের সীমান্তে প্রবেশ করেন। তিব্বতি সংস্কৃতির ধরোহর দালাই লামা কে অরুণাচল প্রদেশ এ প্রবেশ করিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল তাঁর দেহরক্ষী দল। এতক্ষণে হয়ত অকথ্য নির্যাতন শুরু হয়েছে খাম প্রদেশ এর জনসাধারণের উপর তাদের পলায়ন তথ্যের সন্ধানে। দালাই লামার ভারতে আসা সম্ভব হয়েছে শুধু মাত্র এই অতি বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদের আর মাতৃভূমির জন্য নিবেদিত প্রাণ তিব্বতের জনসাধারণের সহায়তায়। এমনিতে পার্বত্য খাম যোদ্ধারা বন জঙ্গল পর্বতের আড়াল থেকে গুপ্ত যুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী কিন্তু এবারের লড়াই পরাক্রমশালী চীনের সাথে। উদ্বিগ্ন দেহরক্ষীর দল দেশে ফেরার অনুমতি চাইলো ধর্মগুরুর কাছে। ভারত সীমান্তে দাড়িয়ে তিনি সজল চোখে বিদায় জানালেন প্রিয় যোদ্ধাদের। হয়ত এ জীবনে আর দেখা হবে না এদের কারো সাথে। তিব্বত ফেরার পথে চীন সৈনিকদের চোখে ধুলো দিতে এরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেল । কিছু লোক ঘোড়ার পিঠে আর কিছু পায়ে হেঁটে, বিভিন্ন পথে নানান বেশে। তাদের মধ্যে একটি দল তিব্বতি লামার পোশাকে বিশেষ উদ্দেশে রওয়ানা হল মঙ্গোলিয়ার দিকে।
লামার বেশে তিন দেহরক্ষীর দলটি দ্রুত হাঁটছে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম গোবি মরুভূমির মধ্য দিয়ে, আপাতত গন্তব্য মঙ্গোলিয়া। আজ ভোরের আলো ফোটার অনেক আগেই তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। লোকজন জেগে ওঠার আগে যত টা পথ পার হওয়া যায়। এমনিতেই এদিকে জনসংখ্যা অত্যন্ত কম। কিন্তু চৈনিক সৈন্যদের চর চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেইরকম কারো চোখে পড়ে গেলে মুশকিল । মাঝে মাঝে মরুভূমির এদিক ওদিক ছড়ানো মঙ্গোল উপজাতিদের ছোট ছোট ডেরায় খানিকটা বিশ্রাম ও কিছু খাদ্য জোটে তার পর আবার পথ চলা। সেই কোন সকালে একটু ছাতু পেটে পড়েছে। পথে আর কোন খাদ্য জুটবে কি না জানা নেই। আপাতত মঙ্গোলিয়র উদ্দেশে শুধু হাঁটা আর হাঁটা। সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। প্রবল ঠাণ্ডায় পা আর চলে না। তুষারপাতের পূর্বাভাষ বুঝে দলের প্রবীণ যোদ্ধা বলে উঠলো----
-এবার তো কোথাও আশ্রয় নিতে হবে!
-কিন্তু চারিদিকে তো ধু ধু বালি ছাড়া আর তো কিছু চোখে পড়ছে না! আরেক জনের উত্তর
-তাহলে ঐ বালির ঢিপির উপর চড়ে দেখা যাক চারিদিক ভাল করে, যদি মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া যায়, তৃতীয় জনের উক্তি।
-বেশ চলো তাহলে-----------
ততক্ষণে হাল্কা তুষারপাত শুরু হয়ে গিয়েছে। দুজন তরুন দ্রুত পা চালালো ঢিপির দিকে। ঢিপির উপর চড়তে চড়তে তারা লক্ষ্য করলো বালির উপর তরঙ্গের মত কিছু আঁকাবাঁকা দাগ উপরের দিকে চলে গেছে। সাপ জাতীয় কোন সরীসৃপ এর চিহ্ন ভেবে তারা আর এগোবে কি না ভাবছে, হঠাত ধুলোবালির প্রচণ্ড ঝাপটা মারতে মারতে দুজনকে ঘিরে ধরল প্রায় দু ফুট মাপের বীভৎস দেখতে ধুসর সাদা রঙের একদল সরীসৃপ। এদের কারো মাথা বা পা নেই, সবাই প্রায় লেজের উপর ভর করে খাড়া হয়ে দুলছে।
আত্মরক্ষার তাগিদে যোদ্ধা দুজন ততক্ষণে বার করেছে তাদের গুপ্ত অস্ত্র। অস্ত্র ব্যাবহার করার আগেই সাপের মত দুলতে থাকা সরীসৃপ গুলো আচমকা বিদ্যুৎ বেগে দুজন লামার দিকে থুতুর মত ছেটাতে লাগল তরল সোনালী হলুদ বিষ। সেই সময় সরীসৃপ গুলোর শরীরের রঙ রক্তবর্ণ হয়ে গেছিলো। এরপর লেজের ঝাপটায় ওঠা প্রচণ্ড বালির ঝড় ঢেকে দিল ঢিপির আশপাশ। ধুলোর ঝড়ে চোখে কিছু দেখা না গেলেও ঢিপির নীচে অপেক্ষায় থাকা বয়স্ক যোদ্ধার কানে এলো সঙ্গীদের মর্মন্তুদ আর্তনাদ। আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে, সঙ্গীদের বাঁচানোর তাগিদে চীৎকার করে লোক ডাকতে ডাকতে একসময় অনাহারে অনিদ্রায় অবসন্ন দেহ লুটিয়ে পরল বালিয়াড়িতে।
জ্ঞানহীন অবস্থায় তাকে খুঁজে পেয়েছিলো স্থানীয় উপজাতিদের দল। পুরো শরীরটাই বরফে ঢাকা পড়ে গেছিলো। শুধু সঙ্গের ঝোলা টা বরফের উপর খানিকটা বেরিয়ে ছিল। তা দেখে বরফ খুঁড়ে তাকে উদ্ধার করে যাযাবরের দল। কয়েক দিন প্রচণ্ড জ্বরে অচৈতন্য থেকে উপজাতিদের সেবা শুশ্রূষায় ধীরেধীরে সে উঠে বসে। শরীরে একটু বল পেতেই যাযাবরদের সাথে বাইরে বেরতে শুরু করে সাথীদের খোঁজে। একদিন হাঁটতে হাঁটতে দূরে আঙ্গুল দেখিয়ে দলের সর্দার বলে উঠলো----
-এইখানে পড়ে ছিলে তুমি ।
-আর বাকিরা?
-না আর কাউকে দেখি নি
-ওঁদের মৃতদেহ ও নয়?
-না, এদিকটায় আমরা প্রতিদিন ঘোরাফেরা করি, তেমন কিছু থাকলে নিশ্চয় চোখে পড়ত।
সেই সন্ধায়, আগুনের চারিদিকে বসা উপজাতিদের কাছে মাথা পা বিহীন দানবের মত ভয়ংকর সরীসৃপদের কবলে পড়া তাঁর সাথীদের কথা জানালো সে। শুনে সবাই সমস্বরে ওলগোই খোরখোই (Olgoi-Khorkhoi) বলে মাথা নাড়তে শুরু করল।
-তুমি ভাগ্যবান তাই ওলগোই খোরখোই এর কবল থেকে বেঁচে ফিরেছ, সর্দার বলে উঠলো।
-ওলগোই খোরখোই?
-ঐ দানব সরীসৃপ এর নাম। এরা বালিয়াড়ির অনেক গভীরে চলাচল করে। এদের চলাচলের জন্য বালির উপর তরঙ্গের মত দাগ দেখা যায়, যা তোমরা বালির ঢিপির কাছে দেখেছিলে। এদের মাথা বা পা নেই। বুকে ভর করে বালির তলায় নিঃশব্দে ঘোরাঘুরি করে। শুধু মাত্র খিদে পেলে বালির উপর উঠে আসে।
-এরা শিকার এর সন্ধান পায় কি করে?
-বালির উপর হওয়া কম্পন থেকে। যেখানে বার বার ছন্দ অনুযায়ী মাটি কাঁপে, যেমন কারো পায়ে হাঁটার স্পন্দন, সেখানে ওরা শিকারের সন্ধানে ছুটে যায়। এদের শরীরেই বিষ লেগে থাকে। ছুঁলেই মৃত্যু। সংস্পর্শে না গিয়েও এরা দূর থেকে বিদ্যুৎ কণার মত বিষ ছিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে শিকার কে। কিন্তু খিদে না পেলে এর কোন প্রাণীকে হত্যা করে করে না।
বর্ণনা শুনতে শুনতে কানে ভেসে এল সেই সোনালি হলুদ তরল বিষের স্পর্শে সঙ্গীদের মৃত্যু আর্তনাদ!
যাযাবরের দল তাকে মঙ্গোলিয়ার সীমান্তে পোঁছে দিয়ে ফিরে গেছে। এদিকে চীন সম্পূর্ণ তিব্বত দখল করে নিয়েছে। তাদের অত্যাচারে তিব্বতিরা বিধ্বস্ত। কিন্তু সান্ত্বনা এই যে, দালাই লামা সম্পূর্ণ নিরাপদ। তাঁকে পূর্ণ মর্যাদার সাথে ভারতবর্ষ গ্রহণ করেছে। খাম যোদ্ধারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য গুপ্ত যুদ্ধে প্রাণ দিচ্ছে। দেশ জুড়ে প্রচণ্ড অরাজকতার মধ্যেও সেই প্রবীণ যোদ্ধার স্বপ্নে জাগরণে প্রায় হানা দেয় সেই ভয়ঙ্কর মৃত্যু পোকার দল (death worm or sand worm) যাকে স্থানীয় লোক ওলগোই খোরখোই বলে। এরা সাধারনত গোবী মরুভূমির পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিকে থাকে। খিদে পেলে যে প্রাণী কে সামনে পায় তাকেই খায়-------পোকা মাকড় মানুষ থেকে উট পর্যন্ত। তবে এই ভয়ংকর প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে অনেক প্রশ্ন এবং অনেক গল্প আছে। কারো এদের স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা হয় নি। কারণ এরা বালির গভীরে চলাফেরা করে এবং খিদে না পেলে শিকারের সন্ধান করে না। যারা ওদের চোখে দেখেছে তারা কেউ বেঁচে ফিরে আসে নি। তাই মৃত্যু পোকা নিয়ে সত্য মিথ্যা মেশানো নানান গল্প আজও ঘুরে বেড়ায় গোবি মরুভুমির আশেপাশে।
(এই গল্পের সমস্ত চিত্র সূত্র অন্তরজাল)