কোটি কোটি মণিমাণিক্য সোনা প্লাটিনাম এর মত দুর্মূল্য পদার্থের নুড়ি পাথরের উপর ভাসতে ভাসতে হাঁটছে থমাস। একটু আগে মহাকাশের অবাক করা এই ‘শূন্য’ দেশের এক অন্তরিক্ষ বা স্পেস স্টেশনে তাকে নামিয়ে দিয়ে পৃথিবী ফিরে গেছে নাসার মহাকাশযান। পৃথিবী থেকে মাত্র ৭০০ আলোকবর্ষ দূরে (এক আলোকবর্ষ অর্থাৎ ,আলোর গতিবেগে ছুটলে এক বছরে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করা যায়) মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশ গঙ্গা ছায়াপথে অবস্থান এই অদ্ভুত দেশের।
সৌজন্যে – অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটারস
আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মিথসনিয়ান সেন্টার এর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নজরে প্রথম ধরা পড়েছে এক অদ্ভুত ‘শূন্য’ আকারের দেশ যার অবস্থান পারসিয়াস আর টরাস নক্ষত্র পুঞ্জের জৈব অণুর জমাট বাঁধা গ্যাসের কুণ্ডলীর মাঝামাঝি। তাই এর বৈজ্ঞানিক নাম পার-টাউ সেল। পার-টাউ সেলের বায়োলজি বা মাইক্রোগ্রেভিটি সংক্রান্ত নানান রকম অনুসন্ধানে থমাস এর আগমন এখানে।
কয়েক দিন পর্যবেক্ষণের পর স্পেস সেন্টার এর গবেষণাগারের কম্পিউটার থেকে থমাস বার্তা পাঠাল---
-জমাট বাঁধা অন্ধকার ও খাঁ খাঁ করা নৈঃশব্দ্যের মধ্যে এক কোটি বা তার বেশি সময় ধরে পার-টাউ সেল টিকে আছে। কিন্তু কোন জাগতিক নিয়মে এই মুলুক চলছে,তা এখনো বুঝতে পারছি না!
সঙ্গে সঙ্গে স্মিথসনিয়ান সেন্টার এর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উত্তর এল
-আর একটু বিশদে বল।
-পার-টাউ সেল নিখাদ এক গোলকের মত শূন্য দেশ। একে দৈত্যকার এক বুদবুদ বলা যেতে পারে। এর ব্যাস মোটামুটি ৫০০ আলোকবর্ষ। এখানে নেই বিন্দু মাত্র আলো। নেই একচিলতে কণা। তাই কণাদের মধ্যে নেই কোন ধাক্কাধাক্কি। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শুধু রাশি রাশি মণিমাণিক্য সোনা প্লাটিনাম এর মত দুর্মূল্য পদার্থ।
-আর দৈত্যকার বুদবুদের পরিধির বাইরে?
-জমাট বাঁধা অত্যন্ত ঘন গ্যাসের মেঘের কুণ্ডলী । মেঘের কুণ্ডলীর মাঝে অসংখ্য তারা। তারাগুলো ভাঙছে আবার নতুন নক্ষত্র জন্ম নিচ্ছে ।
-তার মানে সুপারনোভা?
এ আই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) থমাস সুপারনোভা শব্দটার অর্থ বুঝতে পারল না। তার মাথার নীল আলো দপদপ করে উঠলো। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাড়াতাড়ি লিখলেন
-মহাকাশে যখন তারার মৃত্যু হয় তখন ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হয় যাকে সুপারনোভা বলা হয়। এই বিস্ফোরণ এর কারণে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি হয় । বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সর্বোচ্চ মহাকর্ষীয় বলের অধিকারী এই ব্ল্যাক হোল।
পার-টাউ সেলে থমাসের নিয়োগের কয়েকদিন পর তার নিয়োগকর্তা প্রোফেসর কার্লসন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর রোবোটিক প্রয়োগশালায় ছাত্রদের বোঝাচ্ছেন---
-অধুনা পৃথিবীর একপ্রান্তে বসে মহাবিশ্বের আরেক প্রান্তে জটিলতম কাজ সফল ভাবে সারা যায় থমাসের মত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। প্রচুর মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হতে হতে রোবট প্রায় জলজ্যান্ত মানুষের মত হয়ে উঠেছে। অত্যন্ত মেধাবী কর্মী হিসাবে থমাস কে তৈরি করা হলেও তার স্থিতির সীমা নির্ণয় করা যায়নি। কতদূর অব্দি তার বুদ্ধির দৌড় তা পরীক্ষার বিষয়। তাই মাঝে মাঝে সুপারনোভার মত অনেক কিছুর অর্থ বুঝতে তাকে বেগ পেতে হয়।
- মানুষের সাথে থমাসের পার্থক্য তো থাকবেই স্যার!----এক ছাত্রের বক্তব্য।
-অবশ্যই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সবকিছু মেরুপ্রবন। হয় হ্যাঁ নয় না। মাঝামাঝি কিছু হয় না। অন্যদিকে মানুষের হ্যাঁ না র মাঝের দ্বিধা দ্বন্দ্ব সারাজীবন থাকে। কোন কোন বিষয়ে মানুষ তো জীবনভর জানতে পারেনা কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক!
-আর?
-পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকেনা ওদের----- এই যাকে আমরা বলি প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। যদি চ্যাটজিপিটি কে জিজ্ঞাসা করা হয় ‘ভবিষ্যতে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে চলে যাবে?’ হয়ত তখন সে জানিয়ে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। কারণ এর উত্তর মানুষ সেই যন্ত্রের প্রোগ্রামিং এ লিখে দেয় নি । আসলে পৃথিবীতে রাজত্ব করতে হলে যন্ত্রকে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকলে চলবে না।
-তাহলে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই!
-আলবাত আছে। থমাসের মত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যারা গড়ছেন তাঁরা নিশ্চিত নন যে এরা কোথায় গিয়ে থামবে। আর যন্ত্র সবকিছু পূর্ব নির্ধারণ মেনে চলবে এমনটাও সত্যি নয়, আচমকা বিস্ময়কর ভাবে সৃষ্টি বা ধ্বংসের কারণ ঘটাতে পারে যাকে আটকানোর ব্যাবস্থা মানুষ করে নি। তাছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্বয়ং কারো ক্ষতি না করলেও মানুষ তাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করে বিশ্বের ক্ষতির কারণ করে তুলতে পারে। ফলস্বরূপ শাস্তির কোপ সরাসরি মানুষের ঘাড়ে পড়ে না। এই যেমন আজকাল যন্ত্রের সাহায্যে ক্ষতিকারক প্রসঙ্গ ডিজিটাল মাধ্যমে ভাইরাল করে সমাজ কে অশান্ত করা হচ্ছে।
-এখন উপায়?
- মনুষ্যত্বের স্খলন দেখলে প্রায়শ্চিত্তের উপায় ভাবতে হবে আমাদের এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে গঠন মূলক কাজে লাগানোর আদর্শ সঞ্চারিত করতে হবে।
ক্লাস শেষ করে নিজের অফিসে এসে প্রোফেসর কার্লসন দেখলেন
কম্পিউটার এ থমাস এর মেসেজ এসেছে। লিখেছে -------
“গবেষণাগারে পাওয়া ডেটা থেকে বলা যায় এক কোটি বছর বা তার আগে এক বা অনেক বিস্ফোরণ (সুপারনোভা) ঘটেছিলো পার-টাউ সেল এর কেন্দ্রস্থলে। তার ফলে যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছিল তা আভ্যন্তরীণ বায়ু বা গ্যাস কে ঠেলে বার করে দেয় এই মুলুকের ত্রিসীমানার বাইরে। বৈজ্ঞানিকরা অনুমান করেন যে, ঠেলে বার করে দেওয়া গ্যাসের কুণ্ডলী থেকে জন্ম পারসিয়াস ও টরাস নক্ষত্রপুঞ্জর। এই দুই নক্ষত্রপুঞ্জর মাঝখানে রয়ে গেছে বায়ু বা গ্যাস শূন্য এক দৈত্যাকার বুদ্বুদ, পার-টাউ সেল। অনেক দুর্মূল্য মনি মাণিক্য ও ধাতুর সম্ভার নিয়ে এক কোটি বছর বা তার অনেক বেশি, ঘুটঘুটে অন্ধকার আর শ্মশানের নিস্তব্ধতা নিয়ে টিকে আছে এই মুলুক।“
ম্যাসেজটা পড়ে প্রোফেসর কার্লসন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। থমাস একেবারে সঠিক পথে এগোচ্ছে । আগামী দিনে ঐ স্পেস স্টেশন মডিউলে থমাস দের মত যন্ত্রের দ্বারা এমন প্রযুক্তির ব্যাবহার করতে হবে যা অক্সিজেন প্রস্তুতির পাশাপাশি কার্বন- ডাই –অক্সাইড নির্গমনে সক্ষম হবে। সঙ্গে ন্যূনতম আপেক্ষিক আর্দ্রতা বজায় রাখতে পারলেই মানুষ গবেষণার কাজে পা রাখতে পারবে পার-টাউ সেলে।
যে স্থান বা কাজ মানুষের অসাধ্য সেখানে যন্ত্রমানব কে গঠনমূলক কাজে ব্যাবহার করতে পারছে বিজ্ঞান। এভাবে নিজের ক্ষমতাকে ছাপিয়ে যেতে একমাত্র মানুষই পারে।
চিত্রসূত্র – ইন্টারনেট