সূচিতে ফিরুন

পোকাটি কি শুধুই ধ্বংসাত্মক

লেখক - ড.সৌমিত্র চৌধুরী
img

ধ্বংসাত্মক তো বটেই। পোকাটাকে দেখে ভয়ে শিউড়ে ওঠে মানুষ। ভয় পাবারই কথা। দল বেঁধে থাকে। ছোট্ট ধারাল দাঁত তাদের। বই খাতা বাঁশের খুঁটি কাঠের আসবার খেয়ে সাফ করে দেয়। এমনকি একতলার ঢালাই মেঝে ফুরেও উঠে আসে উপরে। দোতলা তিনতলার দেওয়াল, মেঝেতে। কাঠের দরজা জানালা খেয়ে ফেলে। সেই দুষ্ট কীট -- উঁই পোকা। ইংরাজিতে টারমাইট। হোয়াইট অ্যান্ট (white ant) নামেও পরিচয়।

নামের সঙ্গে ‘অ্যান্ট’ থাকলেও উই পোকা পিঁপড়ে পরিবারের নয়। টারমিডি (Termitidae) পরিবারের, আইসপটেরা (Isoptera) বর্গের। পোকার সামনের আর পেছনের পাখনার আকার এক রকমের। তাই এমন নাম, আইসপটেরা। [আইসোস (Isos) গ্রীক ভাষায় একই রকম, আর ptera মানে পাখনা]। পিঁপড়ে বা অ্যান্ট ফোর্মিসিডা (Formicidae) পরিবারের, ফরমিকা (Formica) বর্গের। ‘ফরমিকা’ শব্দ থেকেই নাম পেয়েছে এক বিষাক্ত রাসায়নিক, ফরমিক অ্যাসিড। পিঁপড়ের বিষে থাকে। ছোট্ট একটা লাল পিঁপড়ে কামড়ালেও ফরমিক অ্যাসিড বিষের জ্বলন টের পাই।

পিঁপড়ে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির (species)। তার মধ্যে টারমিডি (Termitidae) পরিবারের সদস্য ২১০০। এই পরিবারের সদস্য উই। বহু যুগ আগের পোকা। ডায়নাসোর ম্যামোথের প্রাচীন জগত, সেখানেও ছিল উই। কোটি বছর আগে যখন বিশাল প্রাণীরা পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াত, ইউরোপ এশিয়া ভুখন্ডের বড় অংশ বরফের তলায়, সেই পৃথিবীতে ঘটেছিল উই পোকার আবির্ভাব। দীর্ঘ কালের বিবর্তনে ছোট হয়েছে পোকাটির আকার।

উই টিকে আছে, বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। কারণ এরা খুব পরিশ্রমী। শৃঙ্খলা পরায়ন। দল বেঁধে থাকে। সংগঠিত সমাজবদ্ধ। প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।

টারমিডি পরিবারের ছোট্ট সদস্য, মানে উঁই পোকার আক্রমণে দিশেহারা মানুষ। বই পত্র, কাগজ কাঠ ফার্নিচার খেয়ে ফেলে। সেগুলোকে কুচি কুচি করে। ছোট টুকরো দিয়ে নিজের বাসা বানায়। সেই বাসাকে বলি অ্যান্ট হিল, উঁই ঢিবি। রকমারি উই ঢিবির গড়ন। ভিন্ন ভিন্ন স্ট্রাকচার। কোথাও দেখতে গম্বুজ, কোথাও গির্জা। কখনও ব্যাঙের ছাতার মতো, কখনও আবার কনিক্যাল, মানে মোচার গড়ন। আন্টারটিকা মহাদেশ বাদে পৃথিবীর সব দেশের মাঠে ময়দানে জঙ্গলে দেখতে পাওয়া যায়। তবে খুব শীতের দেশে অ্যান্ট হিল দেখা যায় না কারণ অতি ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় উই টিকতে পারে না।

উইএর ঢিবি, লেখকের ক্যামেরায়। স্থান ব্যানারহাট জঙ্গল, ব্যাঙ্গালোর।

এখনকার পৃথিবীতে বহু প্রাচীন উই ঢিবির সন্ধান মিলেছে। ব্রাজিলে চার হাজার বছর আগের, আফ্রিকায় ৩৪০০০ বছর আগের উই ঢিবি খুঁজে পেয়েছেন অনুসন্ধানকারীরা।

ঝড় বাদল জলে রোদের প্রবল তাপেও টিকে থাকে উই ঢিবি। কী দিয়ে তৈরি? গবেষণার তথ্য জানান দিয়েছে, প্রধানত বিভিন্ন ধাতুর অক্সাইড দিয়ে তৈরি। সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম, আয়রন, টাইটেনিয়ামের অক্সাইড।

ভারি জিনিষ তো বইতে পারে না ছোট্ট পোকা। তাই কোনো পাথরের টুকরো পাওয়া যায় না তাদের আবাসে। বাসস্থান বানায় গুড়ো গুড়ো ধাতু, বালি, ধুলো, মাটি, গাছের ডাল পাতা (twig) দিয়ে। সেই বাসায় দল বেঁধে বাস করে তারা। কোনো পল্লীতে সদস্য একশ, আবার কোনো বড় ঢিবিতে থাকে কয়েক লক্ষ কীট। উই পোকার যে ঢিবি দেখি, মাটির নিচে অনেক গভীর অবধি (২, ৩ মিটার) তার বি>স্তার। ঢিবির মধ্যে অসংখ্য কুঠুরি, অনেক টানেল। কুঠুরিতে কোন্‌ দল কোথায় থাকবে, তার জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয় উই বাহিনীর রাজা-রানী। উই-এর বাসস্থানে থাকে রাজা রানী, আর অনেক অনেক শ্রমিক, সৈনিক। কুঠুরিতে খুব যত্নে মজুত করা থাকে ডিম, যেগুলো ফুটে বাচ্চা হয়। কুঠুরিতে থাকে খাদ্য। শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় বেঁচে থাকবার রসদ। আর আশ্চর্য কথা! তাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকে ভিতরে। প্রচণ্ড গরম কিংবা শীত থেকে বাঁচবার ব্যবস্থা। কুঠুরির তাপমাত্রা পরিকল্পিত ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ভিন্ন ঘরের ভিন্ন তাপমাত্রা। কেমন করে করে? আলোচনা হবে সে নিয়ে।

অস্ট্রেলিয়ার উই ঢিবি (সূত্র অন্তরজাল)

তার আগে উইদের নিয়ে অন্য কিছু কথা। এদের শরীরের কাঠামো তৈরি হয় কাইটিন (chitin) নামের প্রোটিন দিয়ে। কাইটিন দিয়েই তৈরি চিংড়ি, অন্য কীট-পতঙ্গের শরীর। বেশীরভাগ উই পোকা অন্ধ। কিছু প্রজাতির চোখ আছে কিন্তু দৃষ্টি কমজোরি। উই-দলে সন্তান উৎপাদনের কাজ করে রাজা আর রানী। অসংখ্য ডিম পারে একটি রানী। দিনে চল্লিশ হাজারেরও বেশি। রানীকে তাই প্রচুর খাবার খেতে হয়। খাবার জোগান দেয় সৈন্য বাহিনী। রানী বাঁচেও অনেক দিন, দশ থেকে পঞ্চাশ বছর।

উই পোকার দলে রাজ-রানী বাদে বাকী সদস্যরা শ্রমিক আর সৈনিক। সৈন্যরা যুদ্ধ করে, বাসস্থান পাহারা দেয়। খাবার জোগান দেয়। ডিমগুলির যত্ন নেওয়াও তাদের কাজ। আর এরা সদা তৎপর। শত্রু আক্রমণ করলেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লড়ে যায়, যতক্ষণ থাকে প্রাণ।

শ্রমিক উইপোকাদের সারাক্ষণ শুধু কাজ আর কাজ। নতুন ঘর তৈরি, টানেল বানানো, খাদ্য-ভান্ডার পাহারা দেওয়া। উই-ঢিবি তৈরির যাবতীয় কাজ তাদের। কেমন করে পায় এত শক্তি? আলচনা হবে পরে। তার আগে অন্য কথা। উই পোকার যে ঢিবি দেখতে পাই তার সব গুলোতেই যে উই থাকে, তা কিন্তু নয়। কাজ মিটে গেলে, রানী মরে গেলে ওরা বাসস্থান ছেড়ে অন্য কোথাও কলোনি বানায়। কেমন করে বুঝবো, কোনটা মৃত? যে ঢিবিতে অজস্র ফুটো, সেটি মৃত। অর্থাৎ তার ভিতর উই পোকা থাকে না।

উই পোকা মারতে বিষাক্ত রাসায়নিক (পেস্টিসাইড) তৈরি হয়েছে। প্রয়োগ হচ্ছে ঘর গৃহস্থালিতে, চাষের মাঠে। কিন্তু বাস্তুতন্ত্রে পোকাটিরও আছে বিশেষ গুরুত্ব। বহু উপকার করে উই পোকা। প্রাকৃতিক পরিবেশ অর্থাৎ ইকো সিষ্টেমকে ঠিক রাখতে অপরিহার্য। মৃত গাছের ডালপালা, পশু দেহ ইত্যাদির পচনে সাহায্য করে। এগুলোই মাটিকে উর্বর করে। বনভূমি সৃজনে তাই উইয়ের বড় ভূমিকা।

প্যাঙ্গোলিন নামের প্রাণীটির খাদ্য উই পোকা। তাই যে জংগলে প্যাঙ্গোলিনর বাস, সেখান উই-ঢিবি অনেক। কোনো কোনো গোত্রের পিঁপড়ে যেমন মেগাপানেরা অ্যানালিস, উই পোকা খেয়ে বেঁচে থাকে। বহু পাখি ব্যাঙ টিকটিকি এদেরও খাদ্য পোকাটি। অনেক দেশের মানুষও উই পোকা খায়। বলা হয়েছে, উই ঢিবিতে কুঠুরির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে শ্রমিক বাহিনী। ভিন্ন ঘরের ভিন্ন তাপমাত্রা। শিশুর ঘরে এক রকম। ডিম মজুত থাকে ভিন্ন তাপমাত্রায়। তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মরুভূমির প্রচণ্ড তাপে কেমন করে বাঁচবে? গরম হাওয়া আটকাতে কোনো কোনো কুঠুরিতে থাকে দুটো করে দেওয়াল। বাইরের তাপ কম ঢুকবে। আর বিশেষ উপায়ে তাপ প্রবাহ বাইরে বের করে দেয় উই বাহিনী। টানেলের মধ্য দিয়ে উপর দিকের পথে এবং শেষে বাইরের পরিবেশে। অদ্ভুত কৌশল। জ্ঞান-গরিমায় শ্রেষ্ঠ মানব প্রজাতিকে তাক লাগিয়ে দেয়। এখনও অজানা অনুন্নত মস্তিস্কের পতঙ্গ কী করে আয়ত্ত করল এমন কৌশল।

এই উপায়ে আমরা কি ঘর বাড়ি বানাতে পারি না। নিশ্চয় পারি। তৈরি হয়েছে, হচ্ছে সেই রকম ইমারত। জিম্বাবোয়ের হারারে শহরের শপিং মল, ইস্ট গেট সেন্টর। প্রাকৃতিক উপায়ে ঠাণ্ডা রাখা হয়। বিল্ডিঙের নক্সাই তেমন। উত্তর-দক্ষিন খোলা। নিচের গরম বাতাস টানেলের মধ্য দিয়ে উপরে পৌঁছে যায়। উই পোকার কাছ থেকেই এই কৌশল শিখেছে মানুষ। বায়ো মিমিক্রি অর্থাৎ প্রকৃতির জিনিষকে অনুকরণ। উচ্চ গতির ট্রেনের সামনেটা পাখির ঠোঁটের মত সরু। কোনো কোনো গাড়ির গড়ন গুবরে পোকার মত প্রায় গোলাকার। সুরক্ষার কারণেই এমন গঠন।

উই পোকার অন্ত্রও বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এক খণ্ড কাগজ থেকে এরা দু’লিটার হাইড্রোজেন তৈরি করতে পারে। কোন কৌশল? কেমন করেই বা পোকাটি হজম করে গাছ কাঠের সেলুলোজ? এদের অন্ত্রের এনজাইম সেলুলোজ পলিমারকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে ফেলে। ফলে তৈরি হয় গ্লুকোজ আর হাইড্রোজেন। এদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া এগুলো থেকে তৈরি করে সেলুলোজ অ্যাসিটেট। এই রাসায়নিক পদার্থটি শক্তি সরবরাহ করে উই পোকাদের। সমগ্র জীব জগত, কীট মানুষ গাছপালা পশুপাখি নিয়েই বাস্তুতন্ত্র। কোনো এক জায়গায় আঘাত লাগলেই বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি। প্রকৃতি পরিবেশ জীব বৈচিত্র রক্ষা করাই এযুগের চ্যালেঞ্জ। উই নিধনের আগে একটু যদি আমরা ভাবতে পারি!