সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখ। দুর্গা পূজোর আর বেশী দেরি নেই।প্রতি রবিবারের মতই আমাদের আসর বসেছে পরাণ দার চায়ের দোকান কাম রেস্টুরেন্টে।
সেদিনের আসরেও গোবিন্দ বাবু, অমল ত্রিপাঠি, অপূর্ব বাবু, দেবাশীস বাবু, সমীরণ বাবু, মহিলা সদস্যা থিটা সবাই হাজির। শুধু তখনও এসে পৌঁছান নি নকা মামা। গোবিন্দ বাবু ফুট কেটে বললেন, ‘দেখুন কোথায় আবার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেছেন!রোজই তো ওঁর নেমন্তন্ন লেগে আছে।নিমন্ত্রণ না করলেও যেচে নেমন্তন্ন নেবার ব্যাপারে ওঁর জুড়ি নেই।’ কথাটা একেবারেই পছন্দ হল না মামার বিশেষ অনুরাগী অপুর্ব বাবুর।
" তাতে আপনার কি মশাই , ওঁর নামডাক আছে তাই সবাই নেমন্তন্ন করেন। তাই যান।" কথাটা এত জোরে বললেন যে গোবিন্দ বাবু ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বললেন,” না, ওঁর স্বাস্থ্যের কথা কথা চিন্তা করেই কথাটা বলছিলাম।” সেই যে স্বাস্থ্যের কথা শুরু হল চলতে চলতে তা যে কখন গড় আয়ু,জাপানের লোকদের বেশী দিন বেঁচে থাকা, সবচেয়ে বেশী দিন বেঁচে থাকার রহস্য নিয়ে জোরদার তর্কের মধ্যে চলে গেছে তা আমরা আঁচ করতে পারি নি । সম্বিত ফিরলো দোকানে ঢুকতে ঢুকতে বলা মামার কথায়।
"আপনাদের ধারণা ভুল। জাপানের মানুষদের গড় আয়ু কিন্তু মোটেই সবচেয়ে বেশি নয়। "
"আমাদের ধারণা ভুল হলে আপনিই বলুন সবচেয়ে বেশি দিন বাঁচে কোন দেশের লোকেরা ?" প্রশ্ন ইতিহাসের শিক্ষক অমল বাবুর।
“এই দেশটা ভূমধ্য সাগরের তীরে অবস্থিত ছোট একটি দেশ। আশে পাশের অন্য সব দেশের মানুষের গড় আয়ু কিন্তু এখানের থেকে অনেক কম। তিন বছর আগে এই ব্যাপারটা আমার নজরে আসার পরে এর পিছনে রহস্য কি তা জানতে ফোন করেছিলাম ডেনমার্কের বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ কার্স্টেন রোমারকে। কার্স্টেনেরও জানা ছিল না এর উত্তর। দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে ঠিক হল এই রহস্যের সমাধানে আমরা যাব সেই দেশে।
কয়েকদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম দীর্ঘায়ুর রহস্যে ঘেরা সেই দেশে। কিছু অবাক করার মত ঠেকল না। অন্য আশেপাশের ইউরোপের দেশের মতই। স্থাপত্য থেকে আবহাওয়া, দৃশ্যপট সবই প্রায় একরকম। নানা জায়গায় খোঁজখবর করেও রহস্যের সুলুক-সন্ধান কিছু করতে পারলাম না আমরা। প্রায় একশ বছরের বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও তথ্য তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বিশেষ সুবিধা করতে পারলাম না। শুধু জানা গেল পঞ্চাশ বছর আগেও এমনটা ছিল না। গড় আয়ু আশেপাশের অন্যান্য ইউরোপের দেশের মতই ছিল।
হতাশ হয়ে যখন ফিরে আসার কথা ভাবছি ,তখন হঠাৎই ডিনারের টেবিলে এক ওয়েটার সন্ধান দিলেন এক ভদ্রলোকের যার কাছে মিলতে পারে এই রহস্যের কিনারা।
পরের দিন কাকভোরে বেরিয়ে চার ঘন্টা পরে পৌঁছালাম সাজানো গোছানো এক গ্রামের ছোট এক বাড়ির সামনে। দরজার বেল টিপতে বেরিয়ে এলেন অশীতিপর এক বৃদ্ধ। আমাদের পরিচয় দিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই বলাতে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসতে বললেন। তারপর নিজের হাতে কফি করে নিয়ে এসে আমাদের আসার উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন।
ও দেশের মানুষের দীর্ঘায়ুর পিছনের রহস্য সম্বন্ধে জানতে চাইলে উনি বললেন ,” সে এক বিরাট কাহিনী।
“ প্রায় ষাট বছর আগের কথা। হঠাৎই এক বিজ্ঞানী এই অজ গাঁয়ে এসে বানালেন এক গবেষণাগার। আমি তখন সবে একটি স্কুলে শিক্ষকের পদে যোগ দিয়েছি। আলাপ হয়ে গেল বিজ্ঞানী ভদ্রলোকের সঙ্গে। খুব স্নেহ করতেন আমাকে। বিভিন্ন সময়ে ঘরোয়া আলোচনায় জেনেছিলাম যে ওঁর গবেষণার বিষয় হল মানুষকে দীর্ঘায়ু কি ভাবে করা যায় তা নিয়ে। সফলও হয়েছিলেন তিনি। এর পিছনের বিজ্ঞানের বিষয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন তিনি। ”
“এর পরে কি বলেছিলেন সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক সেটাই বলবো এখন আপনাদের।“ বলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে খানিকক্ষণের বিরতি নিলেন নকা মামা। আমরা অধীর হলেও মামা তাতে বিশেষ আমল দিলেন না।
মিনিট দুয়েক পরে শুরু করলেন মামা। “এই রহস্যের পিছনে আছে জোম্বি কোষের খেলা।”
শুনেই একেবারে হা হা করে উঠলেন গোবিন্দ বাবু যিনি সাহিত্য জগত ঢোল গোবিন্দ ছদ্মনামে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। “হাইতির জোম্বিদের কথা শুনেছি,হলিউডে জোম্বিদের নিয়ে অনেক কাল্পনিক সিনেমাও দেখেছি, কিন্তু জোম্বি কোষের কথা কখনও শুনি নি। তা মশাই, শরীরের কোষেরাও আবার জোম্বি হয় না কি!”
গল্পের এমন বাধায় বেজায় ক্ষুব্ধ বিজ্ঞানের শিক্ষক অপূর্ব বাবু বললেন, আরে মশাই , আমরা অনেক কিছুই শুনি নি। সেসব অজানা বিষয় জানানোর জন্যই তো নকা মামা আছেন।
অপূর্ব বাবুর কথায় প্রীত হয়ে আবার শুরু করলেন মামা।
“বয়স বাড়ার সঙ্গে মানুষের শরীরের কোষ ক্রমশই বৃদ্ধ হতে থাকে। এই ভাবে বৃদ্ধ হতে হতে একসময় কোষের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও তখনও কোষরা শরীরে প্রদাহজনক অনু এবং টিস্যু অবক্ষয়কারী অনু নির্গত করা থেকে বিরাম নেয় না। জোম্বি কোষ হল এই সেনসেন্ট কোষ অর্থাৎ বৃদ্ধ কোষ যা বেঁচে থাকলেও তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে অক্ষম। এই জোম্বি কোষ তখন শরীরে থেকে অনেক বার্ধক্যজনিত রোগ এবং বার্ধক্যজনিত সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে। হৃদপিন্ডের রোগ থেকে ক্যান্সার,অ্যালজেইমার, অস্টিওপোরেসিস, কিডনির রোগ এমন কি বহুমূত্র , ছানিতেও এই জোম্বি কোষের ভূমিকা আছে। কোষের স্বাভাবিক কাজকর্ম না করতে পারলেও জোম্বি কোষ এমন অনেক রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যা আশেপাশের কোষের ক্ষতি করে। এর ফলে এই সব কোষের বেঁচে থাকা এবং ক্ষতিপূরণের সম্ভাবনায় প্রভাব পড়ে। এছাড়া এই বৃদ্ধ কোষরা যে সব প্রদাহজনক পদার্থ তৈরি করে তা বিপাকীয় ক্রিয়া এবং স্টেম কোষের কাজকেও পরিবর্তন করে দেয়।”
আবার থামলেন মামা। কম বয়স হওয়ার জন্য কর্পোরেটের ম্যানেজার থিটার ধৈর্য কম। এমন গল্পে বিরতি তার একেবারেই পছন্দ নয়। “ এর পর কি হল তাড়াতাড়ি বলুন। “কম বয়সের জন্য মামা থিটাকে বিশেষ স্নেহ করেন। তাই আর দেরি না করে শুরু করলেন পরবর্তী অধ্যায়।
“কম বয়স থাকার সময়ে ইমিউন সিস্টেম বা অনাক্রম্যতন্ত্র এই জোম্বি কোষকে নির্মূল করে দেয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তা হয় না। জমতে থাকে জোম্বি কোষ। আর এর ফলে ত্বরান্বিত হয় বার্ধক্য আর সৃষ্টি হয় নানা রোগ। আর এর ফলে ত্বরান্বিত হয় মৃত্যু। বিজ্ঞানী মানুষটি চেষ্টা করতে লাগলেন কি ভাবে এই জোম্বি কোষকে সাফ করা যায়। কেননা এই জোম্বি কোষকে নির্মূল করতে পারলে মানুষকে দীর্ঘ সুস্থ জীবন দেওয়া সম্ভব হবে এমনটাই মনে করতেন তিনি। বেশ কয়েক বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পড়ে উনি আপেল এবং পেঁয়াজ থেকে এমন দুটি পদার্থ আবিষ্কার করলেন যা শরীরকে জোম্বি কোষমুক্ত করে। এর থেকে যে দুটি ওষুধ তিনি নিষ্কাশন করেছিলেন তা মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন অত্যাশ্চার্য ওষুধ যা মানুষ্ কে অনেক জটিল রোগমুক্ত করে দীর্ঘজীবন দেয়। এই ওষুধ প্রায় পঁচিশ বছর ধরে তিনি প্রয়োগ করেন সেই দেশের পঞ্চাশ বছরের বেশি বয়সের মানুষদের মধ্যে। এর ফলে দেশটির গড় আয়ু অবিশ্বাস্য ভাবে বেড়ে যায়। ওঁর এই সাফল্যে তৈরি হয় অনেক শত্রুও। শত্রুদের মিথ্যা প্রচারে হতাশ হয়ে একদিন হঠাৎই আত্মহত্যা করেন প্রতিভাধর এই বিজ্ঞানী। আর তার সঙ্গেই হারিয়ে যায় তাঁর অসাধারণ এই আবিষ্কার।” থামলেন মামা।
ঘটনার পরিণতিতে আমরাও বিমর্ষ। এর মধ্যেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম , “এর পরে কি হল মামা ?”
এর পর ভগ্ন হৃদয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা রওনা দিয়েছিলাম আমাদের নিজেদের দেশের দিকে।
বিষয়টি আমাদের একেবারে হতবাক করে দিয়েছিল। প্রাচীনকাল থেকে যে আবিষ্কারের জন্য মানুষ অনেক ঘাম ঝরিয়েছে তা হাতের কাছে এসেও হারিয়ে যাওয়ায় সকলেই বিমর্ষ মনে খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে বসে থাকার পর আমরা যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
(এই গল্পের সমস্ত চিত্র সূত্র অন্তরজাল)