সূচিতে ফিরুন

এশিয়ার কয়েকজন মহিলা  বিজ্ঞানী

লেখক - ড. শতাব্দী দাশ
img

রোসেলি ওকাম্পো ফ্রিডম্যান ( ২৩.১১. ১৯৩৭ - 8. ৯. ২০০৫) - ইনি একজন ফিলিপিনো - আমেরিকান বিজ্ঞানী যিনি গবেষণা করেছিলেন Extreme পরিবেশে সায়ানোব্যাক্টেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীবদের নিয়ে। ওনার স্বামী ইমর ফ্রিডম্যানের সঙ্গে তিনি সারা বিশ্বে ঘুরেছেন বিভিন্ন প্রকার শৈবাল ও অন্যান্য অণুজীব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য। আন্টার্কটিকার শুষ্ক উপত্যকা অঞ্চলের রস মরুভূমিতেও তাঁরা গেছেন, যেখানে জীবনের উপস্থিতি নেই বলেই ধরা হয়। তাঁরা একধরনের অণুজীব আবিষ্কার করেন যার নাম 'ক্রিপ্টোএন্ডোলিথস' (Cryptoendoliths), যারা প্রচন্ড শৈত্য সহ্য করতে পারে এবং গ্রীষ্মের সময় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তাঁরা এই অণুজীবটি পরীক্ষাগারে 'কালচার' করতে সমর্থ হন। নাসা (NASA) তাঁদের এই আবিষ্কারকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে জানায় যে এই ধরনের অণুজীব মঙ্গলগ্রহে থাকতে পারে, কারণ মঙ্গলগ্রহের পরিবেশগত অবস্থার সঙ্গে আন্টার্কটিকার পরিবেশের সাদৃশ্য রয়েছে। সারা বিশ্বের প্রায় একহাজার ধরনের অণুজীব তিনি সংগ্রহ করেছেন এইরকম বিভিন্ন Extreme পরিবেশ থেকে।

সুসান লিম (১8. ২. ১৯৫২- ২.৮.২০১8)- সুসান লিম একজন মালয়েশিয়ান প্যারাসাইটোলজিস্ট যিনি মোনোজিয়ান চ্যাপ্টাকৃমির ওপর গবেষণা করেন । এই চ্যাপ্টাকৃমি মাছের দেহে থাকে। এই কৃমিটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এরা মাছের খামারে মাছেদের আক্রমণ করলে তা অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। লিম এই ধরনের চ্যাপ্টাকৃমির প্রায় একশটি নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করেন। তিনি এইধরনের গবেষণার ক্ষেত্রে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব । তিনি মালয়শিয়ার প্রথম ও একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন জ্যুলজিক্যাল নমিনক্লেচার এর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁকে সম্মান জানাতে মনোজিয়ান চ্যাপ্টাকৃমির নামকরণ তাঁর নামানুসারে করা হয়েছে।

সুনেকো ওকাজাকি (৭.৬.১৯৩৩-) - ইনি একজন বিখ্যাত জাপানী বিজ্ঞানী যিনি 'ওকাজাকি ফ্রাগমেন্ট' আবিষ্কার করেছেন। D.N.A. র এই ছোট সিকোয়েন্স হল সেই অংশটি যেখানে রেপ্লিকেশন শুরু হয়, অর্থাৎ একটি লম্বা D.N.A strand তৈরির জন্য এই সিকোয়েন্সটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ও তাঁর স্বামী রেইজি ওকাজাকি তাঁদের পি. এইচ. ডি. ডিগ্রি পাবার পর একটি পরীক্ষাগার তৈরি করে গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু রেইজি লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র 88 বছর বয়সে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর দুই সন্তানকে বড় করে তোলার পাশাপাশি সুনেকো তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান অনেক লড়াই করে। পরে ওকাজাকি ফ্রাগমেন্ট আবিষ্কার করার পরে তিনি বহু সম্মানে ভূষিতা হয়েছেন। ২০০০ সালে পেয়েছেন ইউনেসকো পুরস্কার ।

ড.সেঁজুতি সাহা (২৩.8.১৯৯২- )- ইনি বাংলাদেশের একজন তরুণী বিজ্ঞানী, যিনি তাঁর দেশের শিশুদের জন্য উল্লেখযোগ্য গবেষণার কাজ করছেন। তিনি বর্তমানে ওই দেশের 'চাইল্ড হেল্থ রিসার্চ ফাউন্ডেশন' এর অধিকর্তা। তাঁর কাজের বিষয় হল মলিকিউলার মাইক্রোবায়োলজি। তিনি কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকিউলার জেনেটিক্স বিষয়ে পি. এইচ. ডি. করে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৬ সালে ঢাকায় ফিরে তিনি জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করতে শুরু করেন। শিশুদের প্রতিরোধযোগ্য ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে কাজ করছেন তিনি। আধুনিক মলিকিউলার প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁর গবেষণার কাজ চলছে।

সেঁজুতির জন্ম বাংলাদেশের ঢাকা শহরে। পরে তিনি ব্যাচেলর অফ সায়েন্স ডিগ্রি পান টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের Polio Transition Independent Monitoring Board এর WHO মনোনীত সদস্য। ২০২০ সালে তিনি ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা বাংলাদেশে SARS-COVID2র জিনোম সিকোয়েন্স Decoding এর কাজ করেছেন , যা খুবই উল্লেখযোগ্য একটি গবেষণা কাজ। এর আগে তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে মেনিনজাইটিস ও চিকুনগুনিয়া রোগের ভিতর একটি পারস্পরিক সম্পর্ক (Correlation) রয়েছে।

ড. শরিফা রাফিদা ওয়ান আলয়োই (১০.১০.১৯ু৮১- ) ইনি একজন বিশিষ্ট প্রযুক্তিবিদ। তিনি অধ্যাপনা করেন মালয়েশিয়ার টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল এন্ড এনার্জি এঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিতে। তাঁর কাজের মূল বিষয় হল সম্পদ সংরক্ষণ (Resource Conservation) । তিনি Process System Engineering বিষয়ে বিশেষ পড়াশোনা করেছেন। 2011 থেকে 2021 পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রসেস সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টার (PROSPECT) এর অধিকর্তা। তিনি ৮০ টি গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন , যার মধ্যে ১৭টি হল বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও কোম্পানী এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানের। তিনি প্রায় ৩০০ টি কোম্পানীর প্রযুক্তিবিদদের প্রশিক্ষিত করেছেন Sustainable Engineering Design and Management বিষয়ে। তাঁর গবেষণাপত্রের সংখ্যা ২৫০ এর বেশি। সারা পৃথিবীতে "Heat exchangers, retrofitting and design" বিষয়ে যত বিশেষজ্ঞ রয়েছেন তাঁদের মধ্যে তাঁর স্থান নবম এবং "Optimisation, cost and water" বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তাঁর স্থান পঞ্চম।

ড: শরিফা বর্তমানে জার্নাল অফ ক্লিনার প্রোডাকশনের সহযোগী সম্পাদক, অ্যাপ্লায়েড থার্মাল ইঞ্জিনিয়ারিং জার্নালের এবং ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ হায়ার এডুকেশন এন্ড সাসটেইনেবিলিটির সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য। এছাড়া তিনি 'ইউরোপীয়ান কমিটি ফর দ্য ইউজ অফ কমপিউটার্স ইন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এডুকেশন' (EURECHA) র আন্তর্জাতিক সদস্য। ১৬ টি আন্তর্জাতিক জার্নালের তিনি রিভিউয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি 'বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি' কমিটিতে দায়িত্বে রয়েছেন।

তাঁর ঝুলিতে রয়েছে ১২ টি পেটেন্ট, ২৮ টি কপিরাইট এবং তৈরি করেছেন ৭ টি সফ্টওয়্যার। তাঁর নেতৃত্বে গবেষকদল প্রতিষ্ঠা করেছে 'UTM Spin-Off Company' যার নাম Optimal Systems Engineering Sdn Bhd, যেখানে তিনি বোর্ড অফ ডিরেক্টরস এর একজন সদস্য।

তিনি পি. এইচ. ডি. করেছেন মালয়েশিয়া প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৬ বছর বয়সে। ২০০৮ সালে তিনি পেয়েছেন 'মাল হিজরাহ্' পুরস্কার। তাঁর পি. এইচ. ডি. গবেষণাপত্র পেয়েছে প্রিন্স সুলতান আব্দুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার অ্যাওয়ার্ড (২০০৮)। ২০০৯ এ জার্মানি থেকে পেয়েছেন 'গ্রীণ ট্যালেন্ট' পুরস্কার। ন্যাশনাল ইয়ং সায়েন্টিস্ট পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৫ সালে। ২০১৭ তে এশিয়ান সায়েন্টিস্ট একশ জনের তালিকায় এবং ২০২০তে এশিয়াজ রাইজিং সায়েন্টিস্ট দের তালিকায় রয়েছেন তিনি। ২০২১এ এশিয়ার আটজন মহিলা বিজ্ঞানীর তালিকায় রয়েছে তাঁর নাম।

২০১৬ সালে মাত্র ৩8 বছর বয়সে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়েছেন।

মালয়েশিয়ার বহু প্রযুক্তি সংস্থা ও প্রযুক্তি সম্মেলনে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন তিনি।

(এই নিবন্ধের সমস্ত চিত্র সূত্র অন্তরজাল)