বহুকোষী প্রাণীদের বেঁচে থাকবার জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। কোষের ভিতর মাইটোকন্ড্রিয়া অক্সিজেন ব্যবহার করে খাদ্য থেকে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করে। কিন্তু কোষে অক্সিজেনের সরবরাহ সবসময় সমান থাকে না। যেটুকু অক্সিজেন পাওয়া যায়, সেই অনুযায়ী কোষকে প্রস্তুত থাকতে হয়, অক্সিজেনের হেরফের অনুযায়ী নানাভাবে বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। বিষয়টি বহুদিন ধরে মানুষের জানা। ১৮৫৮ সালে লুই পাস্তুর দেখিয়েছিলেন, প্রাণীকোষে অক্সিজেন ব্যবহারের এক জটিল ভারসাম্য আছে এবং নানাপথে নানা উপায়ে কোষে খাদ্য থেকে শক্তিতে রূপান্তর ঘটে। এরপর অটো ওয়ারবার্গ দেখিয়েছিলেন, আসলে কোষের শ্বসনে (রেসপিরেশন) এনজাইমের ক্রিয়ার ফলে খাদ্য থেকে শক্তিতে এই রূপান্তর ঘটে। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৩১ সালে ওয়ারবার্গ নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।
মানুষের গলার দুইদিকে দুটি প্রধান রক্তবাহী নালীর (লার্জ ব্লাড ভেসেল) প্রায় গা ঘেঁসে রয়েছে ক্যারোটিড অঙ্গ যার মধ্যে অবস্থিত বিশেষ ধরণের কোষ রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কতটা রয়েছে তা বুঝতে পারে। ক্যারোটিড অঙ্গের মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বুঝে নিয়ে নার্ভতন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠিয়ে কিভাবে শ্বাসপ্রশ্বাসের হার ক্যারোটিড অঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে তা দেখান কর্ণেইল্লি হেইম্যানস। ১৯৩৮ সালে হেইম্যানস এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রার হ্রাসবৃদ্ধিতে কোষ কিভাবে সাড়া দেয় তা অবশ্য অজানা থেকে যায়। আসলে প্রকৃতির রহস্য ধাপে ধাপে পরতে পরতে উন্মোচিত হয়।
২০১৯ সালে শারীরতত্ত্ব বিজ্ঞান তথা চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেছেন তিনজন বিজ্ঞানী। (১) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়াম জি. ক্যায়েলিন জুনিয়র, (২) ইংলন্ডের স্যার পিটার জে র্যাটক্লিফ এবং (৩) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেগ এল. সেমেনজা। তাঁরা দেখিয়েছেন দেহের প্রতিটি কোষ অক্সিজেনের মাত্রার হ্রাসবৃদ্ধিতে কিভাবে সাড়া দেয়, কিভাবে নিজেদের মানিয়ে নেয়। পরিবর্তনশীল অক্সিজেন মাত্রায় সাড়া দিয়ে জিনের কার্যকলাপ কিভাবে একেবারে কোষপর্যায়ের কলাকৌশল (মলিকুলার মেশিনারি ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তা তাঁরা সনাক্ত করেছেন। অক্সিজেনের মাত্রার হ্রাসবৃদ্ধি কোষের বিপাক ও শারিরীক ক্রিয়াকলাপকে কিভাবে প্রভাবিত করে তা এই আবিষ্কারের ফলে আরো ভালভাবে বোঝা গিয়েছে।
তাঁদের এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের এইসব আবিষ্কারের ফলে রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া),ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাকসহ হৃদযন্রের কিছু অসুখ, স্ট্রোক এবং অন্যান্য বেশ কিছু অসুখের খুব সম্ভাবনাময় নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি চালু হতে চলেছে। আবিষ্কৃত হতে চলেছে কার্যকরী নতুন নতুন ওষুধ। ইতিমধ্যেই চিন তার নিজের বাজারে ছেড়েছে রক্তাল্পতার নতুন ওষুধ রক্সাডাস্টাট এবং ড্যাপ্রোডাস্টাট। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের দেশগুলিতেও এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। এই ওষুধগুলো খেলে রোগীর দেহ ভাবে, সে পর্বতশৃঙ্গের মত উচ্চতায় অবস্থান করছে, তার ফলে হাড়ের মজ্জা (বোন ম্যারো) থেকে বেশী বেশী করে রক্তের লোহিত কণিকা (এরিথ্রোসাইট) উৎপন্ন হয়ে রক্তে মেশে, রক্তে অক্সিজেন পরিবহনের হার বৃদ্ধি পায়। এর ফলে রক্তাল্পতা হ্রাস পায়। কিছু পরীক্ষামূলক ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে, যা ক্যানসারে পরিণত হওয়া টিউমারের মধ্যে রক্তসরবরাহ কমিয়ে দেয়, বিশেষ করে আক্রান্ত টিউমারের মধ্যে দ্রুত নতুন নতুন রক্তনালী সৃষ্টি ও ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করে দিতে পারে। আবার বিপরীতদিকেও কিছু পরীক্ষামূলক ওষুধ বার হয়েছে, যেগুলি হৃদযন্ত্রে বা ফুসফুসে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি করে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়িয়ে দেয় এবং এভাবে রোগ নিরাময়ের সহায়ক হয়। এই আবিষ্কারগুলি ইতিমধ্যেই মানবকল্যানে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে।
দেহে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে সেই অবস্থাকে বলা হয় হাইপোক্সিয়া (hypoxia), স্বাভবিক থাকলে বলা হয় নর্মোক্সিয়া (normoxia)। ক্যারোটিড অঙ্গ ছাড়াও হাইপোক্সিয়া অবস্থায় মানিয়ে নেওয়ার জন্য শরীর অন্যান্য প্রক্রিয়াও অবলম্বন করে। এর মধ্যে প্রধানতম হল এরিথ্রোপৈয়েটিন (ইপিও- EPO) হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, যার ফলে অস্থিমজ্জায় (বোন ম্যারো) রক্তের লোহিত কণিকার উৎপাদন বৃদ্ধি পায় (এরিথ্রোপৈয়েসিস)। ফলে রক্তে লোহিত কণিকারও পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ও রক্ত বেশী পরিমাণে অক্সিজেন পরিবহন করতে পারে। আমাদের কিডনির মধ্যে বিশেষ কোষে উৎপন্ন হয় ইপিও হরমোন। লোহিত কণিকার উৎপাদন বৃদ্ধিতে হরমোনের ভূমিকা আছে, একথা বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই জানা গিয়েছিল। কিন্তু এই প্রক্রিয়াকে অক্সিজেন কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তা জানা ছিল না।
অক্সিজেনের হ্রাসবৃদ্ধিতে কোষের সাড়া দেওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, কোষের এরকম এক প্রতিলিপি উপাদান (ট্রানস্ক্রিপশন ফ্যাক্টর) ১৯৯০ সালে গ্রেগ সেমেনজা সনাক্ত করেছিলেন। ১৯৯৫ সালের মধ্যে তিনি সেটিকে বিশুদ্ধ করে ক্লোন করতে সমর্থ হন। সেমেনজা এর নাম দিয়েছেন, হাইপোক্সিয়া ইনডিউসিবল ফ্যাকটর সংক্ষেপে এইচআইএফ (HIF)। তিনি দেখিয়েছেন, এইচআইএফ দুটি অংশ (কম্পোনেন্ট) দিয়ে গঠিত। একটি অংশ অক্সিজেন সংবেদী, তার নাম দেওয়া হয়েছে এইচআইএফ-১আলফা। দ্বিতীয় অংশটি অক্সিজেন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়না। আগে থেকেই এটি এআরএনটি (ARNT) নামে পরিচিত ছিল।
উইলিয়াম জি ক্যায়েলিন জুনিয়র এক বিরল ধরনের ক্যানসার ভন হিপ্পেল-লিন্ডাউ (ভিএইচএল-VHL) নিয়ে কাজ করছিলেন। এই ক্যানসারে প্রচুর অতিরিক্ত রক্তনালী তৈরি হয় এবং ইপিও হর্মোন অতিমাত্রায় উৎপন্ন হয়। বোঝা যায় যে, এর সঙ্গে অক্সিজেন ঘাটতির সম্পর্ক আছে। ১৯৯৫ সালে ক্যায়েলিন ভিএইচএল টিউমার অবদমনকারী জিন থেকে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘের ক্লোন পৃথক করে দেখান যে, এটি ভিএইচএল মিউট্যান্ট টিউমারোজেনিক সেল লাইনের টিউমার বৃদ্ধিকে রোধ করে। ক্যায়েলিন দেখালেন যে, ভিএইচএল জিনে এমন এক প্রোটিনের সঙ্কেতলিপি (কোড) রয়েছে, যা ক্যানসার সূত্রপাত হওয়াকে প্রতিরোধ করে। ক্যানসার আক্রান্ত কোষে সক্রিয় (ফাংশনাল) ভিএইচএল জিনের অভাব থাকলে, অতি উচ্চমাত্রার হাইপোক্সিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জিনের দেখা মেলে, কিন্তু সক্রিয় ভিএইচএল জিন নতুন করে যোগ করলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। এর থেকে সূত্র মেলে যে, হাইপোক্সিয়া নিয়ন্ত্রণে ভিএইচএল জিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে। ১৯৯৯ সালে পিটার র্যাডক্লিফ দেখান যে, ভিএইচএল এবং এইচআইএফ-১আলফার মধ্যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। এইচআইএফ-১আলফার ক্ষয় হয়ে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে ভিএইচএল। র্যাটক্লিফ এবং সেমেনজা দেখান যে, কেবলমাত্র কিডনি কোষেই নয়, বস্তুতপক্ষে দেহের সর্বত্র প্রায় সবধরনের কোষকলায় অক্সিজেন সংবেদী ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব জায়গাতেও ইপিও উৎপন্ন হয়। জীন পরিবর্তন করে দেওয়া ইঁদুরের সাহায্যে তিনি দেখান যে ইপিও জীনের ঠিক পাশের ডিএনএ-এর অংশ অক্সিজেন হ্রাস পাওয়ার ফলে উদ্ভুত হাইপোক্সিয়াতে সাড়া দেওয়াতে মধ্যস্থতা করছে।
যখন অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকে অর্থাৎ হাইপোক্সিয়া অবস্থায়, তখন এইচআইএফ-১আলফার ক্ষয় ঘটে না, তা জমা হয় কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে। সেখানে এটি এআরএনটি-এর সহযোগী হয়ে অবস্থান করে এবং হাইপোক্সিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নির্দিষ্ট জিনের হাইপোক্সিয়া রেসপনস এলিমেন্ট-এর (এইচআরই) সঙ্গে যুক্ত হয়। অক্সিজেন যখন স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে, তখন প্রোটিয়াসোম খুব দ্রুত এইচআইএফ-১আলফার ক্ষয়সাধন করে, এর সঙ্গে হাইড্রোক্সিল গ্রুপ যুক্ত করে অক্সিজেন এই ক্ষয়সাধনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রোটিয়াসোম হল কোষের বর্জ্য ফেলে দেবার আগে জমিয়ে রাখবার জায়গা। বর্জন করবার জন্য নির্বাচিত প্রোটিনের সঙ্গে ইউবিকুইটিন অণুর চিহ্ন লাগিয়ে এখানে এনে ফেলে দেওয়া হয়। এই আবিষ্কারের জন্য ২০০৪ সালে অ্যারন চিচেনওভার, আভরাম হারশকো এবং আরউইন রোজ নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।
ভিএইচএল প্রোটিন এইচআইএফ-১আলফার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক জটিল যৌগ তৈরি করে এর ক্ষয়সাধন ঘটায়। এই কারণে অক্সিজেন উচ্চমাত্রায় থাকলে কোষের ভিতর খুব সামান্য সংখ্যক এইচআইএফ-১আলফা উপস্থিত থাকে। র্যটক্লিফ এবং সহযোগী বিজ্ঞানীরা এরপর দেখান ভিএইচএল এবং এইচআইএফ-১আলফা পরস্পরের উপর ক্রিয়াশীল (interact) এবং স্বাভাবিক অক্সিজেন মাত্রায় এর ক্ষয়সাধনের জন্য এটি প্রয়োজন। ভিএইচএল যে এইচআইএফ-১আলফার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তা এইভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু রইলো বাকি ভিএইচএল এবং এইচআইএফ-১আলফার মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া অক্সিজেনের মাত্রা দ্বারা কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তা বোঝা। ক্যায়েলিন এবং র্যাটক্লিফ অনুমান করলেন যে, অক্সিজেন সংবেদী ব্যবস্থার চাবিকাঠি রয়েছে এইচআইএফ-১আলফা প্রোটিনের সেই নির্দিষ্ট অংশে, যেটি এইচ,আইএফ-১আলফার ক্ষয়সাধনের জন্য ভিএইচএল এর উপর নির্ভরশীল। ২০০১ সালে ক্যায়েলিন এবং র্যাটক্লিফ দেখালেন অক্সিজেনের স্বাভাবিক মাত্রায় এইচআইএফ-১আলফার নির্দিষ্ট দুটি স্থানে হাইড্রোক্সিল গ্রুপ স্থাপন করলে ভিএইচএল তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে। এভাবে ব্যাখ্যা পাওয়া গেল কিভাবে অক্সিজেন সংবেদী এনজাইমের সাহায্যে স্বাভাবিক অক্সিজেন মাত্রায় এইচআইএফ-১আলফার দ্রুত ক্ষয়সাধন নিয়ন্ত্রিত হয়।
(এই নিবন্ধের সমস্ত চিত্র সূত্র অন্তরজাল)